খুলনা: খুলনা বিভাগের সর্ববৃহৎ সরকারি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (খুমেক)। সব শ্রেণী মানুষের চিকিৎসা সেবার এ কেন্দ্রটিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে।
কর্মস্থলে পূর্ণ সময় অবস্থান না করে প্রাইভেট চেম্বার বা ক্লিনিকে রোগী দেখা, চিকিৎসকদের সনদ বাণিজ্য, আন্তরিকভাবে রোগী না দেখা, রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, অযথা অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে এ সব পরীক্ষার ফি থেকে সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন ভোগ করা, ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন ও উপহার গ্রহণ করে নিম্নমানের ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেওয়া ইত্যাদি বিষয় এখন নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, লেবার ওয়ার্ডসহ কিছু পদে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকেন একই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তাদের রীতিমতো ‘ম্যানেজ’ও করতে হয় তাদের। হাসপাতালটি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বহির্বিভাগের দালালদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে হাসপাতালের বেশ কিছু কর্মচারীরও।
দালাল নির্মূলে ও দালাল থেকে সাবধান করতে মাইকিং করার দায়িত্বে নিয়োজিত কবির নিজেও দালাল চক্রের সঙ্গে সখ্যতা রাখেন। এছাড়া রয়েছে আলোচিত মনির নামে অপর এক দালাল; যিনি নিজেকে হাসপাতালের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেন। যদিও তিনি এখানে চাকরি করেন না।
এসব দালাল বিভিন্ন কৌশলে রোগীদের বাইরের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নেয়। রোগীদের জন্য কেনা ওষুধ ও মূল্যবান অপারেশন থিয়েটার (ওটি) সামগ্রী কর্মচারীদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়, যা প্রশাসনের হাতে ২০১৩ সালে ধরাও পড়েছে।
খুমেক হাসপাতালের নামকরা চিকিৎসকদের অনেকেই প্রাইভেট হাসপাতালের মালিকও, যার কারণে বেতনভুক সরকারি এসব চিকিৎসকদের শতভাগই ব্যস্ত থাকেন ব্যক্তিগত অনুশীলনে। মূলত তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই চলছে খুলনার প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।
এছাড়া এ হাসপাতালে চলছে প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসানোর জন্য রমরমা ‘ব্যবস্থাপত্র’ বাণিজ্য। হার্ড গ্রিবার ও সিম্পল গ্রিবার মেডিকেল সদন নিতে ৫-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, নার্সিং ইনস্টিটিউটের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর বাকিদুল ও কুক মশালচি (বাবুর্চি) পরিমলের মাধ্যমে চলছে সনদের রমরমা এ বাণিজ্য। সনদে অসঙ্গতি থাকায় ইতোপূর্বে আরএমওকে আদালতে তলব ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলা দায়ের করলেও এ বাণিজ্য থামছে না।
এ হাসপাতালে এলেই যে কোনো রোগীকে সহ্য করতে হয় ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) যন্ত্রণা। কেননা, তারা ব্যবস্থাপত্র কেড়ে নেন, ছবি তোলেন। পরামর্শ দেন, কোথায় গেলে ওষুধ পাওয়া যাবে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি আগের সেই পুরনো পদ্ধতির কলম-প্যাডের পরিবর্তে চেম্বারে কিংবা চিকিৎসকের বাসায় ফ্রিজ, টেলিভিশন, বিলাস বহুল গাড়ি, এসি দিয়ে থাকেন। বিনিময়ে চিকিৎসকেরা ওই কোম্পানির ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন।
অনুসন্ধানীতে জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে আড়াইশ শয্যা থেকে পাঁচশ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল বাড়ানো হয়নি। জনবল সংকট মাথায় নিয়েই হাসপাতাল চলছে, যার কারণে সমস্যা দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
পাঁচশ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক হাজার ছয়শ ৫০ জনের কাজ চলছে ৩৮২ জন দিয়ে। হাসপাতালে মোট ২৩টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৪০টি কেবিন রয়েছে। এ সব ওয়ার্ড ও কেবিনের মধ্যে বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ২/৩ গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকছে প্রতিনিয়ত।
অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরাই সাধারণত কেবিন পেয়ে থাকেন। আর গরিবরা পান বারান্দার মেঝে।
জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা নগরীর নিরালা এলাকার স্কুল শিক্ষক আল-আমিন খান বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণ রোগীরা সুলভে সরকারি চিকিৎসাসেবার পরিবর্তে পান চরম অবহেলা ও দুর্ব্যবহার। সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলার ফুরসৎ পান না, তিনিই প্রাইভেট হাসপাতালে নিজের চেম্বারে বসে একই রোগীর সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠেন।
হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর আত্মীয় নাজমুল শেখ বলেন, হাসপাতালের বাথরুম, টয়লেট, উপরে ওঠার সিঁড়ি, ওয়ার্ডের দেওয়ালসহ চারপাশের পরিবেশ খুবই নোংরা।
তিনি জানান, এই যদি হয় হাসপাতালের অবস্থা তাহলে এখানে এসে রোগীরা সুস্থ হবেন কী করে!
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসকদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় চিকিৎসকদেরই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সে সঙ্গে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট রোগী দেখা কমিয়ে ও ভিজিটের সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে।
তিনি জানান, চিকিৎসকেরা যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি জানান, আর্তের সেবায় একজন চিকিৎসক যেমন প্রশংসা পান, তেমনি একটু ভুলের কারণে তার ভাগ্যে ঘৃণাও জোটে।
এবিষয়ে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মাহবুবুল আলম ফরাজী বাংলানিউজকে বলেন, যেসব সংকট ও অভিযোগ রয়েছে, সে সম্পর্কে তো আপনারা লিখছেন, আরো লেখেন। দালাল কিংবা রিপ্রেজেন্টটিভ ধরার দায়িত্ব আমাদের নয়। পুলিশ কেন তাদের ধরছে না! আমাদের হাতে তো আর অস্ত্র নেই যে, তাদের তাড়া দেবো!
তিনি আরো বলেন, সনদ বাণিজ্য বলতে আমার কিছু জানা নেই।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সব জায়গাতেই বাণিজ্য হচ্ছে। বাস-ট্রেনের টিকিট কাটতে গেলে বাণিজ্য হয়, আদালতেও দালালরা বাণিজ্য করে। পারলে এগুলোও লিখবেন!
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আব্দুস সামাদ বাংলানিউজকে বলেন, সনদ বাণিজ্য আগের চেয়ে অনেক কমেছে। জনবল সংকট ও যন্ত্রপাতি সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানিয়ে তালিকা করে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদশে সময়: ০০০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৪