খুলনা: রাত থেকেই চোখে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন খুলনার তেরখাদার নাঈমা। খুব ভোরে নাঈমাকে স্বামী রুস্তম নিয়ে আসেন খুলনা জেনারেল হাসপাতালে।
কিন্তু সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, অভিজ্ঞ চিকিৎসক নেই। তাই, এখানে কিছুই করা যাবে না। বাধ্য হয়ে নাঈমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মহানগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। আর এভাবেই জেনারেল হাসপাতালে ভোগান্তির শিকার হয়ে প্রতিদিন রোগী কমছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৩৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মেটারনিটি ওয়ার্ড ও এক্সরে বিভাগের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় খুলনা জেনারেল হাসপাতালের।
বর্তমানে এটি ১৫০ এ হাসপাতালের। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রথম শ্রেণীর ৩৪টি পদের মধ্যে আটটি পদ দীর্ঘদিন শূন্য।
হাসপাতালের সার্জারি ও চক্ষু বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ দুটিতে চিকিৎসক না থাকায় বর্তমানে গুরুতর কোনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, সহকারী নার্সসহ তৃতীয় শ্রেণীর অনেকগুলো পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য হয়ে আছে।
হাসপাতালটিতে জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধ রাখার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্টোর রুম নেই। সে কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে একটি পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ ভবনে। দুটি আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনের একটিতে পরিষ্কার ছবি আসে না। আর অপরটি চালুই হয় না। হাসপাতালের তিনটি এক্সরে মেশিনের মধ্যে দুটি নষ্ট। জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে একটি।
রূপসার রামনগর গ্রাম থেকে নাজমা বেগম বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে এসেছেন। এসে দেখেন, বহির্বিভাগে রোগীদের টিকিট দেন যিনি, তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন।
তিনি জানান, লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্ট করে যখন টিকিট কেনার জন্য ১০০ টাকার নোট দিলেন, তখন তিনি খুচরা টাকা দিতে বললেন।
নগরীর মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, এ হাসপাতালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জরুরি বিভাগে। রাতে রোগী নিয়ে এলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীর আত্মীয়-স্বজনদেরও।
তিনি জানান, সম্প্রতি তার স্ত্রীর পা কেটে যাওয়ার পর তাকে সন্ধ্যায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ইমারজেন্সি বিভাগে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। পরে বাধ্য হয়ে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, নামমাত্র মূল্যে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেখানে এ হাসপাতালে বিনামূল্যে মেলে হয়রানি আর সীমাহীন অবহেলা। মানুষের দুরবস্থাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর চিকিৎসক এবং কর্মচারী জাঁকিয়ে বসেছেন অসৎ বাণিজ্যে।
তারা আরো অভিযোগ করেন, হাসপাতাল থেকে ডাক্তাররা যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, তার অধিকাংশই ডাক্তারদের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে বলেন।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, নানা সংকটে হাসপাতালটি নিজেই যেন রোগাক্রান্ত! রোগী হয়রানির ব্যধি সবখানে। দালাল আর মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসকদের অপেশাদারি বাণিজ্যিক মনোভাবও।
হাসপাতালের টয়লেটের অবস্থা খুবই শোচনীয়। পানি অনেক সময় পাওয়াই যায় না। বাথরুমের পাশে এক মিনিট দাঁড়ানোও সম্ভব হয় না। সেখানে অনেক দুর্গন্ধ। রোগীরা সুস্থ হওয়ার জন্য এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এছাড়া বেশ কয়েক বছর আগে নতুন দুটি ভবন নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে চারটি ভবন একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। নতুন ভবনের একটি সংস্কারযোগ্য। তবে দীর্ঘদিন ধরেও এখানে সংস্কারের ছোঁয়া পড়েনি। অপরিষ্কার আর নোংরা নিয়েও অভিযোগের কমতি নেই রোগীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক টেকনিশিয়ান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। চক্ষু, ইএনটি, ডেন্টাল, সার্জারি ও গাইনি বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে চিকিৎসকেরও; যার কারণে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
খুলনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইয়াসিন আলী বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসক ও জনবল সংকটতো রয়েছেই, সেই সঙ্গে জরাজীর্ণ ভবনে আমাদের অফিস করতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জনবল সংকটের তালিকা তৈরি করে ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মামুন পারভেজ বাংলানিউজকে বলেন, খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালে ছয়শ’ তিনজন চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। এসব শূন্য পদে সরকার নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছে।
আশা করছি, অচিরেই চিকিৎসক সংকট কেটে যাবে।
তবে কত চিকিৎসক খুলনায় আসবেন সে সম্পর্কে জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য পরিচালক।
** উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবায় ধস
** রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি খুমেক হাসপাতালে!
বাংলাদেশ সময়: ১০২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪