মাগুরা: চিকিৎসক ও ওষুধ সঙ্কট, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাশন- এ সবই মাগুরা সদর হাসপাতালের বর্তমান চিত্র। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শয্যা সংখ্যার তিনগুণ রোগী নিয়ে চলছে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম।
দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকায়, কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীরা। অন্যদিকে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার জন্য সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার ফলে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা।
১৯৬৮ সালে শহরের ঢাকা-খুলনা হাইওয়ের পাশে চার একর ৯৪ শতক জমির উপর হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয়। ৫০ শয্যা দিয়ে শুরু করা হলেও, ১৯৯৮ সালে এটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।
জানা যায়, বর্তমানে এ হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, সার্জারি, মেডিসিন, ইএনটির চারটি পদের মধ্যে একটি পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি রয়েছে। জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থোপেডিক্স, গাইনি, শিশু, প্যাথলজি, এনেসথেসিয়া পাঁচটি পদের মধ্যে খালি রয়েছে দুইটি। এছাড়া, মেডিকেল অফিসারসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একাধিক পদও শূন্য রয়েছে।
অন্যদিকে, ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী ভর্তি হন। মাগুরার পাশাপাশি আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকেও রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। এ কারণে বেশিরভাগ রোগীকেই হাসপাতালের বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে বারান্দায় রোগীর গাদাগাদি। সেখান থেকে ওয়ার্ডের গেট ছাড়িয়ে রোগীরা সিড়িঘর পর্যন্ত বিছানা বিছিয়েছেন। তিনতলা হাসপাতালের প্রতিটি তলাতেই একই অবস্থা।
জানা যায়, ১৫ শয্যার পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ৪২ জন, নয় শয্যার মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ৪৪ জন, ১২ শয্যার পুরুষ সার্জারী ওয়ার্ডে ৩১ জন, আট শয্যার মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে ২৫ জন, ১১ শয্যার গাইনী ওয়ার্ডে ৩৬ জন, ১০ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে ৪৭ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এছাড়াও, পুরুষ অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ছয় শয্যার বিপরীতে ২২ জন, চার শয্যার মহিলা অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এভাবেই বেশিরভাগ ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার দুই থেকে তিনগুন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা যায়।
মেডিসিন ওয়ার্ডে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র স্টাফ নার্স বাংলানিউজকে জানান, পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ২৪ শয্যার বিপরীতে সব সময় ৮০ থেকে ৯০ জন রোগী ভর্তি থাকে। এ ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টায় পালাক্রমে মাত্র ছয়জন নার্সকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। যা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ইচ্ছা থাকলেও তারা রোগীদের পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারেন না।
প্রকট শয্যা সঙ্কটের কারণেই বেশিরভাগ রোগীকে ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধময় পরিবেশে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
দেখা যায়, সদর উপজেলার সত্যপুর গ্রামের মিতা বেগম চারদিন ধরে, শ্রীপুর উপজেলার তারা উজিয়াল গ্রামের সবিতা রানী পাঁচদিন ধরে তাদের বাচ্চাসহ শিশু ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। শহরের দোয়ারপাড়ের রওশন আরা ও সদরের ধলহরা চানপুর গ্রামের মীরা বেগম একইভাবে বেডের অভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালের বারান্দায়।
সবারই অভিযোগ, গোটা হাসপাতাল জুড়ে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা এখানে পড়ে রয়েছেন। এর পাশাপাশি রয়েছে ওষুধ সঙ্কট। অধিকাংশ ওষুধই বাইরের দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তারা শহরের ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ময়লা-আবর্জনা ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্যের স্তূপ পড়ে রয়েছে। বাথরুমগুলো অপরিচ্ছন্ন। দুর্গন্ধময় পরিবেশে অস্বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবস্থান করছেন রোগী ও তার স্বজনরা।
এ ব্যাপারে মাগুরার সমাজকর্মী ও শিক্ষক এটিএম আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাগুরা সদর হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার কথা আমরা শুনছি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এ কাজটি শুরু হচ্ছে না। এর ফলে আমাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মাঝে প্রশ্ন জাগছে, এটি কি শুধুই আই ওয়াশ?
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. সুনীল চন্দ্র রায় বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতালে ওষুধের তেমন কোনো সঙ্কট নেই। কিছু কিছু ওষুধ বরাদ্দ না থাকায় রোগীদের বাইরের দোকান থেকে কিনতে হয়। এছাড়া ধারণ ক্ষমতার তিনগুন রোগী ভর্তি থাকার কারণে সবাইকে ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। রোগীর সাথে আসা স্বজনরা অনেকসময় বাথরুমসহ হাসপাতালের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করেন।
তিনি বলেন, ১০০ শয্যার বরাদ্দ দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৩০০ রোগী ম্যানেজ করতে হচ্ছে। এ কারণে মাঝে মধ্যে কিছু সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।
তবে দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে হাসপাতালের ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। এটি হয়ে গেলে হাসপাতালের চিকিৎসার মান আরো বাড়বে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪