ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেট। সামনে টুল পেতে বসে গালগল্প করতে ভীষণ ব্যস্ত দুই গেটম্যান।
তাদের সামনে দিয়ে হরদম যাতায়াত করছেন দর্শনার্থীরা। কোনো বিধিনিষেধ নেই। অথচ তাদের মাথার ঠিক উপরে গেটে ঝুলছে- হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি। সেখানে লেখা- গেট পাস নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করুন। গেট পাস ছাড়া হাসপাতালে প্রবেশ করবেন না। রোগীর সঙ্গে দু’জনের বেশি এটেনডেন্ট থাকবেন না।
কিন্তু দর্শনার্থী বা রোগীর স্বজনরা কেউই তোয়াক্কা করছেন না এসবের।
বুধবার রাতে মিনিট ১০ জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিয়ম না মানার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে জানতে চাইলাম গেটম্যান মিজানের (৩২) কাছে। বিষয়টিকে খুবই সামান্য করে নিজের মতো করে উপস্থাপন করলেন স্মিত হেসে। বললেন, রাইতে হাসপাতালে ঢুকলে পাস লাগে না।
গেটম্যানের উত্তরে রীতিমতো অবাক হয়ে আবারও জানতে চাইলাম, সাইনবোর্ডে তো শুধু দিনের বেলার জন্য এ নিয়ম এমন কথা লেখা নেই। এবার মিজান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছু সময় চুপ থেকে বললেন, এত খোঁচান ক্যান! পরিচালকের সাথে কথা কইন। আমরা কিছু জানি না।
মিজানের সঙ্গে কথা শেষ করে হাসপাতালের ভেতরে যাওয়ার সময় দুটি গেটের মাঝখানে গিয়ে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। এখানে আবার বিপরীত কথা!
এ ফোর সাইজের দুটি সাদা কাগজে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তি- ‘রোগীর দর্শনার্থীদের জন্য বিকাল ৪ ঘটিকা হইতে ৬ ঘটিকা পর্যন্ত ভিজিটিং টাইম। এ সময় ব্যতীত হাসপাতালে প্রবেশ নিষেধ। ’
তখন নিজের হাতঘড়িতে রাত সাড়ে ১০টা!
পাশের বিজ্ঞপ্তিতে রয়েছে ‘জরুরি বিভাগ হইতে গেট পাশ সংগ্রহপূর্বক হাসপাতালে প্রবেশের জন্য অনুরোধ করা হইলো। ’
এবার প্রথম গেটে দু’জন গেটম্যানের দেখা মিললেও এ গেট সদর দরজার মতোই। গেটম্যানের টিকিটিও নেই।
এ সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জানান, রাতে রোগীদের স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। পাস প্রথার সঠিক ব্যবহার না থাকায় এমনটি হচ্ছে।
হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের নার্সিং অফিসার জয়নাল আবেদিন জানান, ২৪ শয্যার বিপরীতে এখানে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে। প্রতি রোগীর সঙ্গে গড়ে ৪ থেকে ৫ জন করে লোক থাকেন। এটা একটা বাড়তি ঝামেলা।
রাতের হাসপাতালের এমন অরাজক পরিস্থিতি সম্পর্কে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ফসিউর রহমান বলেন, আমাদের লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণের জন্য। সব সময়ের জন্য পাসের নিয়ম বহাল রয়েছে।
জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাড়ি এলাকা থেকে এসেছেন সালমা বেগম (৩৫)। জরুরি বিভাগের লিফটে যাবেন হাসপাতালের ১২ নম্বর মহিলা ওয়ার্ডে। কিন্তু লিফট নষ্ট। শেষ পর্যন্ত ট্রলিতে শুয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওয়ার্ডে গেলেন তিনি।
জানতে চাইলে হাসপাতালের লিফটকর্মী লিয়াকত আলী জানান, ছয়টা লিফটের মধ্যে এখন তিনটিই নষ্ট। সচল তিনটি লিফটও মাঝে-মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট লিফটে আটকা পড়ে মাঝে-মধ্যে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। টেকনিশিয়ান এনে লিফট খুলতে হয়।
আলাপচারিতায় এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার অবতারণা করেন লিয়াকত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার হালহকিকত দেখতে আসেন ওই সময়কার স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকির। কিন্তু হাসপাতালের দু’তলার লিফটে ওঠার পর আধা ঘণ্টা লিফটে আটকা থাকেন প্রতিমন্ত্রী।
পরে টেকনেশিয়ান এসে বিকল্পপন্থায় লিফটের দরজা খুলে তাকে বের করে আনে। এ ঘটনার পরেও লিফটগুলো সচলের কোনো উদ্যোগ নেই, জানান লিয়াকত।
হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের লিফটে সাঁটানো সাদা কাগজে একটি বিজ্ঞপ্তি- ‘এই লিফট যান্ত্রিক কারণে আপাতত বন্ধ আছে। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ। ’
হাসপাতালের পাঁচশ শয্যার নতুন ভবনে পুরোদমে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় পুরনো পাঁচশ শয্যার ভবনে রয়েছে মারাত্মক শয্যা সংকট। এ সংকটে হাসপাতালের ভেতরে কিংবা বারান্দার মেঝেতে রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিতে হয়।
১২ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে শুয়ে আছেন জামালপুরের মেলান্দহ থেকে আসা থাকা এক রোগী। পাশেই বসে আছেন স্বামী রিকশাচালক আব্বাস উদ্দিন। তিনি জানালেন, চার দিন ধরে হাসপাতালের বারান্দায় আছেন। সিট নেই। ডাক্তার সকালের রাউন্ডে একবার আসেন। এরপর আর কাউকে ডেকেও পাওয়া যায় না।
এসব ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ফসিউর রহমান জানান, লিফট কখনো খারাপ হচ্ছে, কখনো ভালো হচ্ছে। এখন দুটি বা তিনটি লিফট খারাপ আছে। এগুলো সচল রাখার চেষ্টা চলছে।
শয্যা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শয্যা সংকট থাকবেই। দু’ভবন মিলিয়ে শয্যা আছে এক হাজার। কিন্তু প্রতিদিন দুই হাজারের মতো রোগী ভর্তি থাকে। এ সংকট কাটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৪