ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতি-২

অপুষ্টি দূরীকরণে চলছে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৫
অপুষ্টি দূরীকরণে চলছে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতক্ষীরা: অপুষ্টি নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিল তিন মাসের শিশু শাহিন হোসেন। জন্মের প্রথম দিন থেকেই তাকে নিয়ে শঙ্কিত তার বাবা ইয়াছিন আলী ও মা মঞ্জুয়ারা খাতুন।



দু’পায়ে পানি জমে ফুলে ওঠায় ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শাহিনের। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের পুষ্টি কর্নারে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির সময় শাহিনের ওজন ছিল তিন কেজি ৮০০ গ্রাম। পায়ে জমে থাকা পানি কমে এলেও শঙ্কা কাটেনি। শাহিনের সার্বিক পরিচর্চায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের পুষ্টি কর্নারে নিয়োজিত রয়েছেন বেসরকারি সংস্থা এসিএফের সেবিকা নিলুফা ইয়াসমিন।

চিকিৎসা চলছে, চেষ্টার ত্রুটি নেই। সাতক্ষীরায় অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিকিৎসায় সরকারকে এভাবেই সহযোগিতা করছে একাধিক বেসরকারি সংস্থা।

সেবিকা নিলুফা ইয়াসমিন বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসার পর শাহিনের শরীরে জমে থাকা পানি কমে এসেছে। একই সঙ্গে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে। তার শরীরের বর্তমান ওজন দুই কেজি ৬০০ গ্রাম। তবে, অপুষ্টিতে না ভুগলে বর্তমানে শাহিনের স্বাভাবিক ওজন হতো প্রায় চার কেজি।

শাহিনের মা মঞ্জুয়ারা বলেন, শাহিনের বাবা ভ্যান চালান। অভাবের সংসারে শাহিন পেটে থাকা অবস্থায় সব সময় খাবার জুটতো না। আপারা (স্বাস্থ্য কর্মীরা) বলছে, বাচ্চা পেটে থাকলে নিজের শরীরের প্রতি একটু যত্ন নিতে হয়। নিয়মিত বেশি বেশি খেতে হয়। কি করবো? এখন ভুগতে হচ্ছে।

দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কারণে সাতক্ষীরায় শিশু অপুষ্টির হার কমানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১২-১৩ এ বলা হয়েছে, সাতক্ষীরার প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। যেখানে জাতীয় পর্যায়ে এ হার ২৬ শতাংশ।

সাতক্ষীরার সার্বিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে সহকারী সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে জেলার ২৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র তৃণমূল পর্যায়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত চেকআপ ও ওজন মাপার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া মায়েদের আয়রন বড়ি ও শিশুদেরও নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেক হাসপাতালে স্থাপিত পুষ্টি কর্নারে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় অপুষ্টির শিকার শিশুদের নিবিড় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

তবে সচেতনতার অভাব, অজ্ঞতা ও প্রচারের অভাবে অনেকেই কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগ ছাড়া সেবা নিতে আসেন না বলে জানান তিনি।  

কালিগঞ্জের রঘুনাথপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রহিমা খাতুন জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তাছাড়া গর্ভবতী মা ও শিশুদের ওজন পরিমাপ, চেকআপ, ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। মাঝে মধ্যে ওষুধ যা দেওয়া হয়, তাতে কুলায় না।

সাতক্ষীরায় কর্মরত জাতিসংঘের একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জনবল ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কলারোয়া, তালা, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুষ্টি কর্নারের কার্যক্রম। তবে, জেলা সদর, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুষ্টি কর্নারের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে।

এদিকে, ইউএন রিচের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের কৃষি, খাদ্য, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি ১৯টি ও ৩৫টি দেশীয় বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় সাতক্ষীরায় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির উন্নয়নে কাজ করছে।

এর মধ্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা সুশীলন ও এসিএফ তালা, দেবহাটা, আশাশুনি ও সদর উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে শিশুদের পুষ্টিগত পরীক্ষার মাধ্যমে তীব্র অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিকিৎসাগত খাদ্য সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে।

সুশীলনের জেলা সমন্বয়কারী মনিরুজ্জামান জানান, ২০১৪ সালে জেলার চারটি উপজেলার প্রায় তিন লক্ষ শিশুর পুষ্টিগত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্ণিত তীব্র অপুষ্টির শিকার ১০৫ জন (Severe acute malnutrition-SAM) শিশুকে পুষ্টি কর্নারে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আর এ কাজে কারিগরি সহায়তা করছে বেসরকারি সংস্থা এসিএফ।

ইউএন রিচের তথ্য মতে, অপুষ্টি দূরীকরণে জন্মের পরপরই ও ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়াতে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা। ছয় থেকে ২৩ মাস পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খাওয়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণেও একাধিক বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। কয়েকটি এনজিও অপুষ্টির শিকার শিশুদের মধ্যে পুষ্টি গুড়া বিতরণ করছে।

অপরদিকে, মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতকরণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সমন্বিত কৃষি ও স্বাস্থ্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রায় একই ধরনের কাজ করছে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডেজিনাস নলেজসহ একাধিক বেসরকারি সংস্থা।
   
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার স্থানীয় গবেষক শাহীন ইসলাম জানান, পুষ্টি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি দরকার বাড়িতে বিভিন্ন সবজি, দেশীয় ফলমূল ও মাছ উৎপাদন করা। এর সঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাও দরকার। কেনা খাবারের ওপর কখনোই পুষ্টি নিরাপত্তার ভার দেওয়া ঠিক না। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে আপেল, কমলা, আঙ্গুর- এসবে বেশি পুষ্টি। ধনীরাতো পুষ্টিকর হিসেবে এগুলোই বেশি খায়। কিন্তু মানুষ এটা জানে না যে আমাদের চারপাশে প্রাপ্ত দেশীয় ফল, সবজি ও মাছে বেশি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। অনেক এনজিও পুষ্টি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু তা প্রজেক্ট ভিত্তিক। মেয়াদ শেষ হলে কাজ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষকে যদি তার নিজের জ্ঞানকে চর্চা করে পুষ্টি নিরাপত্তার কথা বোঝানো যায়, তাহলে তা কখনো শেষ হবার নয়।

তিনি বলেন, শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের অল্পনা রানীর বাড়ি দেখলে প্রাণ জুড়াবে যে কারো। তার বাড়ির নাম কৃষি বাড়ি। নিজ বাড়িতে সবজি ও মাছ চাষ করে এবং ফলদ, বনজ ও ঔষধি উদ্ভিদ লাগিয়ে যে পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ অল্পনা রানীর কৃষি বাড়ি।

আসলেই অল্পনা রানীর কৃষি বাড়ি পরিদর্শন করে অবাক হবে যে কেউ। ঔষধি ও ফলদ বৃক্ষসহ কমপক্ষে ৩৫ ধরনের মৌসুম ভিত্তিক স্থানীয় জাতের সবজি রয়েছে তার বাড়িতে। পুকুর ভরা কৈ, শিং, মাগুর, মলা, শৌল, ঢেলা, টাকি, ব্যাদলাসহ বিভিন্ন মাছে। যেন পুষ্টির ভান্ডার।

বাংলানিউজকে অল্পনা রানী বলেন, একটি গবেষণা সংস্থার সহায়তায় পুষ্টির ভান্ডার গড়ে তুলেছি। এতে পরিবারের সদস্যরা পরিমিত পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারছে। এতে যে আমি শুধু নিজে উপকৃত হচ্ছি, তা নয়। আমার প্রতিবেশীরাও প্রয়োজনে ছুটে আসেন আমার কাছে। বিনামূল্যে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় সবজি, বীজ ও পরামর্শ।

তিনি এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেন সবাইকে।

ইউনিসেফের নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট ড. মুহাসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশগত বিপর্যয় সাতক্ষীরার পুষ্টিহীনতার অন্যমত প্রধান কারণ। এসব কারণে একই ধরনের খাদ্য উৎপাদন হয়। উৎপাদনে বৈচিত্র্য থাকে না। ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা যায়। অনেকে মনে করেন, পুষ্টিকর খাবার মানেই বেশি দামের খাবার। কিন্তু দেশীয় ফলমূল ও সবজি উৎপাদন পুষ্টিহীনতা দূরীকরণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, মা ও শিশুর পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নয়নে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরও গ্রহণ করেছে কর্মজীবী গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচি। একই ধরনের প্রকল্প রয়েছে বেশ কয়েকটি এনজিওর।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. সালেহ আহমেদ জানান, জেলার পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করতে প্রতি তিন মাস অন্তর একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায়ই অপুষ্টি দূরীকরণে বাস্তবায়িত কর্মসূচির দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তিনি আরো বলেন, পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, সবার সহযোগিতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।