ঢাকা: কখনও যাওয়া হয়নি মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। ৫০০ শয্যার এই নতুন হাসপাতালটির সেবা সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেক দিনের।
সুযোগ পেয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতে রওয়ানা দিই। সঙ্গী ছিলেন সহকর্মী ফটো সাংবাদিক মাহমুদ হোসেন পিয়াস।
প্রধান সড়কের (খিলগাঁও-সায়েদাবাদ) উপর কোনো রোড সাইন নেই। সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকও জায়গাটি চেনেন না। মধ্যরাত। রাস্তায় লোকজন নেই। যে কারণে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হলো। মুগদাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে হাজী কাদেম আলী রোড ধরে দেড়শ’ গজ এগিয়ে গেলেই অবাক হওয়ার পালা।
চমৎকার প্রধান ফটক। বেশ খানিকটা ভেতরে ১৩ তলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনটি। পাশেই দ্বিতল ভবন জরুরি বিভাগের। সামনে বিশাল মাঠ পরিপাটি করে সাজানো। দেখতে খানিকটা ফাইভ স্টার হোটেলের মতো।
এটা দেশের সরকারি একটি হাসপাতালের দৃশ্য ভাবতেও অবাক লাগছিলো। সচারচর এমন পরিপাটি দেখা যায় না। ফাইভ স্টার হোটেলের মতোই সুনসান নীরবতা। প্রধান ফটকের গার্ড রুমে দু’জন আনসার সদস্য উদাস ভঙ্গিতে বসে আছেন।
মাঠ পেরিয়ে জরুরি বিভাগের প্রবেশ পথে বাঁধা দিলেন একজন আনসার সদস্য। পরিচয় পেয়ে বললেন, অপেক্ষা করেন, অনুমতি নিতে হবে আগে। মিনিটখানেক পরেই ফিরে এলেন আনসার সদস্যটি। নিয়ে গেলেন জরুরি বিভাগের ডাক্তারের কাছে। কক্ষে ঢুকতেই চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলেন তিনি। মনোযোগ দিয়ে একটি ইসিজি রিপোর্ট দেখছিলেন। দেখা শেষে প্রেসক্রিপশন লিখলেন।
ওই কক্ষেই থাকা একজনকে ডাক দিয়ে বললেন, এই টেস্টগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে করিয়ে আনতে পারেন। রোগীকে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যান, তাহলে খরচ কম পড়বে। ভদ্রলোক হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বিদায় নিলেন।
জরুরি বিভাগটির পরিসর বিশাল। ৩১ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা হাসপাতালের চেয়েও দ্বিগুন স্পেস। দু’টি ইউনিটে ১২টি বেড রয়েছে। ভেতরটাও বেশ পরিচ্ছন্ন। নেই কোনো গন্ধ। হাসপাতাল বলে মনেই হচ্ছিল না। ভেতরেও সুনসান নীরবতা। একজন মাত্র রোগী শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা নিতে এসেছেন রাত ১০টায়। যাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডা. খালেদ মাহমুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেলো, এখানে সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা খুবই কম। অন্য হাসপাতালে যেখানে বেড পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেখানে মুগদা হাসপাতালে অনেক বেড ফাঁকাই পড়ে থাকে।
বৃহস্পতিবারও মেডিসিন বিভাগের ১০টি পেয়িং বেড ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। হাসপাতালটির প্রতিটি পেয়িং বেডের জন্য ২৭৫ টাকা করে মাসুল আদায় করা হয় রোগীর কাছ থেকে।
ঢাকা শহরের অন্যান্য মেডিকেলে সারাদেশ থেকে রোগী আসে। কিন্তু এখানে যারা আসেন তাদের ৯০ শতাংশই স্থানীয়। আর বাইরে থেকে আসে মাত্র ১০ শতাংশ রোগী। যাদের আত্মীয়স্বজন এই এলাকার বাসিন্দা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৫ জন রোগী ভর্তি হওয়ার তথ্য জানালেন ওয়ার্ড বয় দীপেন চন্দ্র দাস। সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা যেমন কম, তেমন সেবা প্রদানকারীরও সংকট রয়েছে।
হাসপাতালটিতে ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার (ইএমও) পদে কোনো ডাক্তার নেই। ৫ জন ডাক্তার ডেপুটেশনে এই বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। যাদের প্রত্যেককে মাসে ৭ থেকে ৮দিন করে নাইট ডিউটি করতে হয়, যা অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
নার্স ও বয় থাকলেও আয়া নেই। পুরো জরুরি বিভাগের জন্য রয়েছে মাত্র একজন আয়া। যিনি সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ডিউটি পালন করেন। এরপর চলে যান। রাতের বেলা ফ্লোর পরিষ্কারের প্রয়োজন হলে নার্সকেই হাত লাগাতে হয়।
জরুরি বিভাগের সামনে রয়েছে বিশাল টিকিট কাউন্টার। কিন্তু সেখানে কোনো লোককে দেখা গেলো না। নার্স সোনিয়া আক্তার খানিকটা আক্ষেপ করে বললেন, দেখেন না, আমার দুই পকেট টাকায় ভর্তি। আমাকেই সব করতে হয়। রোগী এলে রেজিস্ট্রেশন করা থেকে টাকা নিয়ে টিকিট প্রদান সবই করতে হয়।
রাতে আয়া না থাকায় পরিচ্ছন্ন রাখতে অনেক কষ্ট হয় বলে জানালেন সোনিয়া আক্তার। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করেও কোনো রোগীর দেখা মেলেনি। হাসপাতালের গেটে চায়ের দোকানি লোকমান মিয়া জানালেন, নিত্যদিনের এই চিত্র। তাই রাত একটার মধ্যে দোকান বন্ধ করে দেন।
বৃহস্পতিবার দিনে-রাতে (দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা) রোগী এসেছে মাত্র ৬৫ জন।
হাসপাতালটির অনেকগুলো বিভাগ এখনও চালু করা যায়নি। ইনডোরে মেডিসিন সার্জারি, শিশু মেডিসিন, গাইনি, নাক-কান-গলা, ইউরোলজি, কার্ডিওলজি ও অর্থোপেডিক বিভাগ চালু রয়েছে। তবে ইনডোরের চেয়ে বেশ কয়েকটি বেশি বিভাগ আউটডোরে সেবা প্রদান করছে। মাত্র ১০ টাকার টিকিটে বহির্বিভাগে রোগী দেখছেন ডাক্তাররা।
বার্ণ ইউনিট চালু রয়েছে। তবে মাসখানেক আগে ডাক্তার অবসরে চলে যাওয়ার পর নতুন ডাক্তার এখনও যোগদান করেননি। তাই সংকটের মধ্যে রয়েছে বার্ন ইউনিট।
প্রাইভেট যে কোনো হাসপাতাল থেকে এক-তৃতীয়াংশ মূল্যে বিভিন্ন ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করছে এ হাসপাতাল। সিসিইউ চালু রয়েছে। আইসিইউ রেডি, তবে ডাক্তারের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস রয়েছে ব্লাড ব্যাংকের।
বেসরকারি কোনো হাসপাতাল হলে হয়তো প্রচারণার জন্যই বিশাল আয়োজন থাকত। কিন্তু এই হাসপাতালটির পাশে প্রধান সড়কের উপরও নেই কোনো রোড সাইন। চিপা গলির মধ্যে থাকা সুরম্য ভবনটি রয়েছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। যে কারণে বিশাল এই হাসপাতালটিতে এখন শুধু স্থানীয়রাই আসছেন চিকিৎসা নিতে। অথচ ঢের বেশি রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মতো অবকাঠামো ও সক্ষমতা তাদের রয়েছে, যেখানে মাত্র ২৫ টাকায় চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এসআই/আরএম