চিকিৎসা হচ্ছে আমাদের মৌলিক অধিকার। আমাদের দেশে এই অধিকারের চিত্র কেমন? এক সময় চিকিৎসা পাওয়ার মূল স্থান ছিলো সরকারি হাসপাতাল।
কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা কেমন? রোগী হয়ে সেখানে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খেতে হয় প্রচন্ড ভীড়ে। চোখ এদিক ওদিক ঘোরাবেন; নোংরা পরিরেশে গা রি রি করে উঠবে। তারপর ডাক্তারের খোঁজ। না। ডাক্তার নেই। যদিও বা ডাক্তার পেলেন, তিনি আপনার বেশভূষা পর্যবেক্ষণ করবেন। আপনার গায়ের জামা কাপড়ের উপর নির্ভর করবে আপনার সাথে ডাক্তারের আচার আচরণর। আপনি অসুখের কথা বর্ণনা শুরু করেছেন। এক ফাঁকে ডাক্তার কিন্তু আপনাকে বলে ফেলবেন ‘চেম্বারে গেলে তো ভালো করে দেখে দিতে পারতাম। ’ আপনি তখন জানালেন আপনার আর্থিক অসঙ্গতির কথা। ডাক্তার ততক্ষণে ব্যবস্থাপত্রে আপনার ঔষুধ লিখে ফেলেছেন। আপনি কিন্তু অসুখের কথা পুরো বলার আর সুযোগ পেলেন না। ব্যবস্থাপত্র হাতে নিয়ে হাপাতালের ডিসপেনসারিতে গেলেন। সেখানে ঔষূধ নেই। হাসপাতালের বারান্দায় থাকতেই আপনাকে ঘিরে ধরেছেন বিভিন্ন কোম্পানীর মেডিকেল রিপ্রেজেনটেইটিভ। কোন কোম্পানীর কোন ঔষুধ ডাক্তার লিখেছেন তা দেখার জন্য আপনার ব্যবস্থপত্র তাদের হাতে হাতে ঘুরবে কতক্ষণ।
আর গুরুত্বর অসুস্থ কিংবা দূর্ঘটনায় পড়ে অথবা অন্য কোনো কারণে আহত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে বুঝতে পারবেন আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব কাকে বলে। আপনি বেডে পড়ে আছেন। ডাক্তার তো আসার নামই নেই, তার উপর নাকে লাগছে উৎকট দুর্গন্ধ। শুরু হলো চিকিৎসা। ডাক্তার, নার্স, ব্রাদারদের কুৎসিৎ আচরণে আপনার মরে যেতে ইচ্ছে হবে। কয়দিন এই পরিবেশে থাকার পর সব আপনার গা সহা হয়ে যাবে। কপাল ভালো হলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। আর মন্দ কপাল হলে; হবেন লাশ।
দেশের প্রতিটি জেলা এমন কি কোনো কোনো উপজেলায়ও এখন সরকারি আধুনিক হাসপাতাল আছে। কিন্তু সেই আধুনিক হাসপাতালগুলো নামেই শুধু ‘আধুনিক’। অধিকাংশ চিকিৎসক আর কনসালটেন্টের চেম্বারে তালা ঝুলছে দেখবেন। খোঁজখবর নিলে জানবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সাপ্তায় একদিন অথবা দুইদিন কেবল চেম্বারে বসেন। জানতে চাইবেন এইসব নিয়ম কে করেছে? উত্তর তার; ডাক্তার সাহেবরা নিজেরাই। ভাগ্যক্রমে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেয়ে গেলেন। তার উগ্র আচার আচরণ আপনাকে সহ্য করতে হবে।
কেবল ডাক্তারদের কথা বলি কেনো? হাসপাতালের সেবক-সেবিকা ও কর্মচারীরাও কম কিসে! তাদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর। যে কারণে হাসপাতালের এক্সরে মেশিন, ইসিজি মেশিন প্রায়ই বিকল থাকে। সনোলজিস্ট না থাকায় আল্ট্রসোনোগ্রাম মেশিন বন্ধই থাকে। জীবানুমুক্তকরণ ছাড়াই রোগীর অপারেশন থেকে শুরু করে সকল সেবা কাজ পরিচালনা করা হয়। প্লাস্টার ও ড্রেসিং অদক্ষ নার্স ও ওয়ার্ড বয় দিয়ে করা হয়। এর পাশাপাশি আপনার সাথে চলবে খারাপ ব্যবহার, কর্তব্য পালনে অবহেলা করে আপনাকে অতিষ্ঠ করা হবে। এক সময় কোমল গলায় কোনো নার্স বা ওয়ার্ড বয় আপনাকে বলবে; ( প্রাইভেট হাসপাতাল/ ক্লিনিকের নাম উল্লেখ করে) ঐ হাসপাতাল অথবা ঐ ক্লিনিকে গেলে আপনার ভালো চিকিৎসা হত।
এই সবই বললাম জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে। আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা কেমন? সেখানে বড় বড় ডাক্তাররা থাকেন। সেগুলোতে ইন্টানী ডাক্তারদের কারণে কিছুটা চিকিৎসা রোগীরা পায় বটে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। মেডিকেল কলেজের বড় বড় ডাক্তাররা প্রতি সাপ্তায় ক্ষেপ মারতে জেলা ও উপজেলার চেম্বারে গিয়ে বসেন। আমি সিলেট অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, প্রতি শুক্রবার হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের হাট বসে। মেডিকেল কলেজের বড় বড় ডাক্তাররা এক দিনে ৫০ থেকে ১০০ রোগী দেখে যান। প্রতি রোগীর কাছ থেকে ফি নেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। স্বল্প সময়ে এতো অধিক রোগী দেখে তারা কি চিকিৎসা করেন তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন। তবে রোগীরা পায় সান্তনা। অমুখ বড় ডাক্তারকে দেখিয়ে চিকিৎসা করাছি এটা ভেবে। সিলেটের নামকরা এক চিকিৎসক একবার রোগীর ব্যবস্থাপত্রে রড, সিমেন্ট, পাথর লিখে দিয়ে ছিলেন। খ্যাতনামা এই চিকিৎসক ঐ সময় তার প্রাইভেট হাসপাতালের নির্মাণ কাজ করাচ্ছিলেন।
আমাদের দেশে হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা খরচ করে যারা বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা নেন, তারাও কতোটা সঠিক চিকিৎসা পান? আমি অনেক রোগীকে দেখেছি তারা চিকিৎসা নিয়ে স্স্থু হওয়ার পরও বুঝতে পারেন না এই চিকিৎসা ্তার আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কিনা। ডাক্তার তার যে অপারেশন করেছেন সেটার প্রয়োজন ছিলো কিনা। অপারেশন ঠিক মতো হয়েছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহে থাকতে দেখেছি। কারণ ডাক্তার যেসব টেষ্ট করিয়ে রোগ নির্ণয় করেছিলেন সে সব প্যাথলজি সেন্টারে ডাক্তার সাহেবের কমিশনের সস্পর্ক রয়েছে। প্যাথলজি সেন্টারে অভিজ্ঞ প্যাথলজিষ্ট চিলেন কি? টেষ্টে যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে সে সবের মেয়াদ ছিলো কি? দেখা গেছে একই পরীক্ষা দুই প্যাথলজি সেন্টারে করিয়ে দুই রকম রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
এই বছরের (২০১১) জুন মাসের ২২ ও ২৩ তারিখে ঢাকার একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাওয়া একজনের বিবরণ এই রকম; ‘প্রথমেই হাসপাতাল কাউন্টারের অভ্যর্থনাকারী মহিলা যে সব আচরন করেন তাতে তার বিকৃত রুচিরই পরিচয় বহন করে। কোন কিছু জিজ্ঞেস করলেই ক্ষ্যাপে যান। শুধু মাত্র মোটা অংকের ফিস আদায় করার ক্ষেত্রে বিরাট সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। তার পরও কাঙ্খিত নিউরো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগী দেখলেন। সময় ১ মিনিট। পরদিন তার নিদের্শমত পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিয়ে তার চেম্বারে গিয়ে দেখলাম ভয়াবহ অবস্থা। রোগী বসার কক্ষে একটা চেয়ারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য রোগী। ডাক্তার রোগী দেখতে সময় নিচ্ছেন মাত্র ১মিনিট। ’
এই ডাক্তারের খ্যতি নাকি পুরো বিশ্বে রয়েছে। এ রকম খ্যাতিমান ডাক্তারের চিকিৎসার সময় যদি এক মিনিট হয়, তবে অন্য ডাক্তরা কেমন চিকিৎসা দিচ্ছেন তা বুঝতে খুব একটা মাথা ঘামাতে হয় না।
সব নেতিবাচক কথার শেষেও কথা আছে। আছেন আমাদের দেশে হৃদয়বান চিকিৎসক। না হলে আমারা আছি কি ভাবে। কি ভাবে ঠিকে আছে এই বাংলাদেশ। তবে চিকিৎসকদের মনুষ্যত্ব আরো জাগ্রত হলে দেশের চিকিৎসা সেবার চিত্র অনেক বদলে যেতো। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। চিকিৎসা সেবার বিষয়ে আমি সেই আশায়ই রইলাম।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কলাম লেখক, কবি, গল্পকার, শিক্ষক।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি
প্রযত্নে: আবদুল হামিদ মাহবুব
২১১/৬ আরামবাগ
মৌলভীবাজার-৩২০০
মোবাইল: ০১৫৫৮-৩০৮৪০১