ঢাকা: মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের বিশেষায়িত হাসপাতাল রাজধানীর আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, মেটার্নিটি ক্লিনিক হিসেবে পরিচিত এ হাসপাতালটিতে নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও সেবা পেতে রোগীদের পদে পদে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
রোগীদের বক্তব্য, ‘সরকার তো বলে মেটার্নিটিতে সব ফি ফ্রি, কিন্তু কতো টুকু ফ্রি তা আমরা জানি। ডাক্তারের সিরিয়াল আগে পাওয়া, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করানো, পরীক্ষা শেষে একইদিনে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র পেতে সবক্ষেত্রেই বাড়তি অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়। ’
বুধবার (১৬ নভেম্বর) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাসপাতালের ভেতরে পর্যবেক্ষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের নিচতলায় বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীদের টোকেন দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন দু’জন। তাদের হাতে ৫০-১০০ টাকা গুঁজে দিলেই টোকেনের কোনো সিরিয়াল পেতে দেরি হয় না। সরাসরি ডাক্তারদের সাক্ষাৎ পেতে পারেন। না হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না।
বহির্বিভাগের সামনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো থাকায় তাদের টাকা নেওয়ার কৌশলটাও ব্যতিক্রম। রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনদের কথার ছলে একটু আড়ালে নিয়ে যান তারা। তারপর পকেট থেকে রোগীর স্বজন টাকা বের করেন আর ওই দায়িত্বে থাকা লোক টাকা নিজের পকেটে ভরেন।
কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে গর্ভবতী স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন মাসুম। তিনি বলেন, ‘যারা টেকা দেয়, তার সিরিয়াল আগে যায়। আর যারা টেকা না দিবো তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়া থাকোন লাগবো। ’
গর্ভবতী মায়েদের পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ায় এখানে রোগী সাধারণত গর্ভবতী মায়েরা।
ভেতরে স্ত্রীকে পাঠিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন শাকিল। তাকেও টাকা দিতে দেখে জানতে চাওয়া হলো ‘কতো টাকা দিলেন?’। তিনি বলেন, ‘একশ’ টাকা’।
‘কেন টাকা দিলেন?’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা দিলে তাড়াতাড়ি কাজ হয়। আজকেই আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নিবো। তাই টাকা দিলাম। এখন সব কাজ উনিই করবেন। ’
স্ত্রীকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়েছেন নয়াবাজার থেকে আসা সালাউদ্দিন। আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে একশ’ ১০ টাকা ও দুইশ’২০ টাকা নির্ধারিত ফি থাকলেও তার লেগেছে চারশ’ টাকা।
টাকা বেশি নিয়েছে এ কথা জানাতেই তিনি বলেন, আসলে কতো টাকা ফি আমি জানি না, যা বলেছে তাই দিয়েছি। প্রাইভেটে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতেও এমন টাকাই লাগে। সম্ভবত বেশি নিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন সর্বোচ্চ মাত্র ৬০ জনের আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয় বলে, প্রয়োজনে বাড়তি টাকা দিয়েই এ পরীক্ষাটি করাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।
সার্বিকভাবে কেমন খরচ এখানে জানতে চাইলে সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, সামনেই তার স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের তারিখ চলে এসেছে। যদি সিজার লাগে তাহলে শুধুমাত্র প্রসবের সময়ই ১০ হাজার টাকা লাগবে বলে তাকে জানানো হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালের গেটে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের টানাটানি। যখনই কোনো রোগী ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছেন তখনই একদল নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে ধরছেন। তারা ওই ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলছেন মোবাইলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তারা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি।
আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফার্মার প্রতিনিধি ইব্রাহীম বাংলানিউজকে বলেন, ডাক্তার কী ওষুধ লিখছে সেই তথ্য আমাদের অফিসে জানানো ফরজ। তাই লেখার ঝামেলা বাদ দিয়ে ছবি তুলে নিচ্ছি।
১২-১৫ জন নারী পুরুষের মধ্যে সবাই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তাদের এ বাড়াবাড়িতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন রোগীরা। রোগীর ভোগান্তির দিকে বিন্দুমাত্র নজর দিচ্ছেন না তারা।
তাহমিনা নামে একজন বলেন, এ অবস্থায় নিজের শরীর নিয়ে চলতে পারিনা, তার উপর বের হলে তাদের বাড়াবাড়ি খুবই বিরক্তিকর। সবসময়ই এমন করেন তারা।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে গেলে এই প্রতিবেদককে ‘ব্যস্ত আছি’ বলে প্রায় আধাঘণ্টা বসিয়ে রাখেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ইশরাত জাহান। তারপর তিনি এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতেই রাজি হননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৬
পিএম/এএটি/আরআই