তবে দক্ষ জনশক্তির অভাব (বিশেষত চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনোলজিস্ট), ক্ষুদ্র ভূখন্ডে বিশাল জনগোষ্ঠী, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত, ডাক্তার ও নার্স এর অনুপাত কাঙ্খিত না হওয়ায় প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবার মান অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই সরকারি এবং বেসরকারিভাবে স্বল্প সময়ে বহুসংখ্যক মেডিকেল কলেজ, নার্সিং প্রতিষ্ঠান এবং হেলথ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ায় সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ।
এ খসড়াপত্রে আইনটি মোট ১৪টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এবং ৬৫ টি ধারা সন্নিবেশিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার আইন সময়ের দাবি। আইনটি বাস্তবায়িত হলে মানুষের অভিযোগ জানানোর একটা স্থান তৈরি হবে, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় রূপরেখা তৈরি হবে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহীতার অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হবে ইত্যাদি এই খসড়াপত্রের উল্লেখ্যযোগ্য অংশ। স্বাস্থ্যসেবায় ওষুধ উপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দায়দায়িত্ব, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এর দায়িত্ব এবং সরকারের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকালে অবহেলা, ক্ষতি ইত্যাদির ধারণা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিকারের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন, স্বাস্থ্যসেবা বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্লিনিক্যাল অডিট, মর্র্টালিটি অডিট এর ব্যবস্থার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যা আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠাগুলোতে অনেকটা নতুন সংযোজন। রোগীর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার এবং তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। তবে খসড়া আইনটির কিছু কিছু বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা এবং সাম্যক ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন।
আইনটির নবম পরিচ্ছদে অবহেলা, ক্ষতি ইত্যাদির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ভুল চিকিৎসা করা কিংবা রোগ নির্ণয়ে ভুল করা চিকিৎসকের অবহেলা হিসেবে দেখা হবে-এই অংশটি বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
কারণ আইনটিতে ভুল চিকিৎসা কিংবা রোগ নির্ণয়ে ভুল করা বলতে কি বুঝায় তার ব্যাখ্যা করা হয়নি।
আইনটিতে চিকিৎসকের বিভিন্ন অবহেলার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
যেমন:-
(১)। চিকিৎসক কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অর্থ্যাৎ-
ক. ভুল চিকিৎসা করা; খ. রোগ নির্ণয়ে ভুল করা; গ. ভুল ওষুধ প্রদান; ঘ. ভুল অঙ্গ অপসারণ;
ঙ. ভুল বা অতিরঞ্জিত রির্পোট প্রদান; চ. একাধিক রোগীকে একত্রে পরীক্ষা করা;
ছ. মাদকাসক্ত বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া; জ. জরুরি ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করা;
ঝ. অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট দেওয়া;
ঞ. ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন কোম্পানির একই ওষুধ বার বার প্রদান করা;
ট. প্রয়োজন ব্যতিরেকে নিজ ক্ষেত্রের বা এখতিয়ারের বাহিরে চিকিৎসা দেওয়া;
ঠ. কর্মস্থলে বিলম্বে আসা এবং কর্মঘণ্টা পূর্ণ হইবার পূর্বে কর্মস্থল ত্যাগ করা বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকা;
ড. চিকিৎসার নির্ধারিত প্রটোকল (Prorocol) অনুসরণ না করা;
ঢ. চিকিৎসকের কাজ নিজে না করিয়া নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয় বা অন্য কাহারও দ্বারা করানো;
ণ. প্রয়োজনের তুলনায় কম বা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রদান;
ত. ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিক (Medical Representative) সাক্ষাৎ দেওয়া।
থ. ইহা ব্যতিত অপরাপর সংশ্লিষ্ট অবহেলাসমূহ।
পেশাগত অবহেলার সংজ্ঞা হিসেবে যেটা বহুল প্রচলিত তাহলো: Professional negligence is defined as lack of reasonable care, skill or knowledge or willful negligence on the part of the doctor during practice of medical profession so as to lead damage to the patient- যার বাংলা অর্থ - পেশাগত অবহেলা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত যত্ন, দক্ষতা, জ্ঞানের অভাব অথবা চিকিৎসকের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত অবহেলা যার ফলশ্রুতিতে রোগী শারীরিক (আরোগ্য বিলম্বিত হওয়া কিংবা মৃত্যু), মানসিক অথবা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকের অবহেলা প্রমানের জন্য ৪টি উপাদানের প্রয়োজন: ১। অভিযুক্তি চিকিৎসক/প্রতিষ্ঠান অভিযোগকারী রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন এবং ২। সেই দায়িত্বে অবহেলার করেছেন এবং ৩। যার ফলশ্রুতিতে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং 4। এই ক্ষতি চিকিৎসকের অবহেলার প্রত্যক্ষ ফলাফল।
উপাদানগুলির ২,৩ এবং ৪ প্রমানের জন্য অবশ্যই জুরিবোর্ড/অন্য চিকিৎসকের মতামত নিতে হবে। কেননা চিকিৎসকের দায়িত্ব তার দক্ষতা, অবস্থা এবং সময়ের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন এমবিবিএস চিকিৎসক আর একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে সমান দক্ষতা, জ্ঞান আশা করা যায় না। আবার উপজেলা শহর হাসপাতালের এবং ঢাকার বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসা প্রটোকল এক রকম হবে না। কারণ উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবা প্রদান এবং রোগ নির্ণয়ের সুযোগ সুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট কম। আবার একই ডিগ্রিধারী সব চিকিৎসকের মেধা একরকম হবে না। এটাই বাস্তবতা। সেজন্য এই ভিন্নতা নিয়ে পেশাগত অবহেলাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য Standard of care/ রোগী সেবার মানদণ্ডের কথা এসেছে।
বিভিন্ন দেশের আইনেStandard of care/ রোগী সেবার মানদণ্ডের সংজ্ঞায় বলা হয় - Standard of care is defined by law as that which equally qualified physicians would exercise for a specific patient under similar circumstances. The test of competence is the standard of the ordinary skilled man exercising and professing to have that special skill. A man need not possess the highest expert skill. In the case of a medical man, negligence means failure to act in accordance with the standards of reasonably competent medical men at the time. There may be one or more perfectly proper standards and if he conforms to one of these proper standards then he is not negligent. The standard of care is thus judged by reference to the status of the doctor. A general practitioner is judged by the standards of a general practitioner and a consultant by the srandrads of a specialist. The standards expected from a super specialist are ever higher than those expected of a consultant. যার বাংলা সারমর্ম করলে দাড়ায়: কোন নির্দিষ্ট রোগীর সেবায় একই যোগ্যতা চিকিৎসকগণ একই পরিস্থিতিতে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে সেটাই Standard of care/ রোগী সেবার মানদণ্ড।
আবার একই রোগের চিকিৎসার একাধিক প্রতিষ্ঠিত উপায়/মতোবাদ থাকলে চিকিৎসক তার সুবিধামতো কোনো মতোবাদ গ্রহণ করতে পারবেন। আইন একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দক্ষতা আশা করে না বরং সাধারণ মানের দক্ষতা প্রত্যশা করে। আবার একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনারের দক্ষতা অন্য আরেকজন জেনারেল প্র্যাকটিশনারের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, একই ভাবে একজন বিশেষজ্ঞের দক্ষতা অন্য আর একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। আমাদের দেশে চিকিৎসাকালীন অবস্থায় রোগীর মৃত্যু হলে কিংবা রোগের অবনতি হলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভুল চিকিৎসায় কিংবা ভুল রোগ নির্ণয়ের কারণে যেমন রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশাপাশি সবচেয়ে দক্ষ চিকিৎসকের দ্বারা সমস্ত সুযোগ সুবিধাসহ চিকিৎসা করালেও রোগীর পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে কিংবা মৃত্যু হতে পারে। কাজেই অবহেলা কিংবা রোগ নির্ণয়ে ভুল করেছেন প্রমাণ করার জন্য উপরে উল্লেখিত চারটি উপাদানই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা না হলে শুধুমাত্র রোগীর স্বজনদের দাবিতে কিংবা সংবাদপত্রে প্রচারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে চিকিৎসকের প্রতি অবাস্তব ও ন্যায়ভ্রষ্ট আচরণ করা হবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে (যেমন ভুল অঙ্গ অপসারণ, অপারেশন স্থানে গজ/কাচি ইত্যাদি রেখে সেলাই করে ফেলা ইত্যাদি) জুরিবোর্ড/অন্য চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে না যাকে বলা হয় রেস ইপসা লকুইটর (Res ipsa Loqitur)।
আবার চিকিৎসা প্রয়োগে কিংবা রোগ নির্ণয়ে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয় না। যেটারে বলা হয় Error of Judgment. কখনও কখনও সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগের পরেও অপ্রত্যাশিত/অনাকাংখিত ফলাফল হতে পারে যাকে বলা হয় দৈব দুর্বিপাক বা Act of God. কাজেই অবহেলার অভিযোগে তদন্তে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন।
আইনটিতে অসদাচরণে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে “অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দেওয়া এবং বিনিময়ে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ, ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন কোম্পানির একই ওষুধ বারবার প্রদান করা এবং বিনিময়ে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ এবং বিশেষ প্রয়োজনে ব্যতিরেকে নিজে ক্ষেত্রের বা এখতিয়ারের বাহিরে চিকিৎসা দেওয়া”। অসদাচরণের আরও উদাহরণ হতে পারে- অবৈধ অপারেশন/গর্ভপাত, অদক্ষ জনবল নিয়ে কাজ করা, দালাল মারফত রোগী আনাকে উৎসাহিত করা, মিথ্যা সনদ প্রদান, অপ্রয়োজনে অপারেশন করা, নিজস্ব অর্জিত বিষয়ের বাইরে চিকিৎসা প্রদান করা, জরুরি অবস্থার চিকিৎসায় অবহেলা করা কিংবা উপস্থিত না হওয়া, অতিরিক্ত চার্জ/ ফি গ্রহণ, ভুল কিংবা অতিরিক্ত ওষুধ প্রদান, দূর্বোধ্য ব্যবস্থাপত্র কিংবা কোড ব্যবহার ইত্যাদি।
চিকিৎসা সেবায় অবহেলা কিংবা চিকিৎসকের অসদাচারণের আইনগত সমাধানের বিষয়টি টর্ট বা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত কিংবা ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে দেখা হয় (Civil/Tortious & Criminal liability)। টর্ট বা ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে বিচারককে সাক্ষ্য প্রমাণের সাম্ভব্যতার ভারসাম্যের উপর (Balance of Probability) সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং ক্ষতিপূরণ এর প্রতিকার এবং চিকিৎসার সেবায় বেশিরভাগ অবহেলাই এই প্রকৃতির। অপরপক্ষে ফৌজদারী অপরাধ কিংবা criminal liabilaty এর ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে হয় এবং এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নয় বরং অভিযুক্তের শাস্তির বিধান থাকে। প্রস্তাবিত আইনটিতে মূলত: ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বলা হয়েছে। কোনো অপরাধ ফৌজদারী হবে তা বলা হয়নি।
আইনের খসড়ার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “যে কোনো রোগে আক্রান্ত এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণেচ্ছুক ব্যক্তি দেশের যে কোনো চিকিৎসক বা সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালসহ সব প্রকারের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হইতে স্বাস্থ্যসেবা পাইবার অধিকারী থাকিবে”।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সব চিকিৎসক কিংবা সব প্রতিষ্ঠান সবধরনের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুত নয় কিংবা সব রোগ বিশেষজ্ঞ নয়। এক্ষেত্রে জরুরি, প্রাথমিক এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর জন্য উপরের ধারাটি প্রযোজ্য কিন্তু বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে শুধুমাত্র রেফার্ড রোগীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিউরোলজি হাসপাতালে এসে আইনের এই অধিকার প্রয়োগ করলে সময়ের অপচয় এবং রোগের অবনতি হওয়ার আশংকাই বেশি। এছাড়া ও অসংখ্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/বিভাগ রয়েছে যারা শুধুমাত্র নিজেদের তালিকাভূক্ত মানুষের (স্টাফ ও তাদের পরিবারের) সেবা প্রদান করে- এই ধারার ফলে এই হাসপাতালগুলো কি জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে? ঢাকার সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল প্রধানত তাদের নিজস্ব রোগীদের সেবা প্রদানই নিয়োজিত। যদি সকলের জন্য এগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তাদরে গুণগত মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সর্বোপরি আইনটি রেফারেল সিষ্টেম প্রবর্তনের অন্তরায় হতে পারে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীর অধিকার ও দায়িত্ব নির্নয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে চিকিৎসা আরম্ভ বা অপারেশনের পূর্বে রোগী বা তার অভিভাবকের স্বেচ্ছায় সম্মতি প্রদানের সুযোগ দিতে হবে (বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতিত)। আমাদের দেশে সাধারণভাবে প্রচলিত যে সম্মতিপত্র প্রচলিত আছে সেটা আরও বিস্তারিত হওয়া প্রয়োজন যাতে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে রোগী বা তার অভিভাবক অবহিত থাকেন, রোগীর অবস্থা, সম্ভাব্য সকল বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি, সম্ভাব্য ঝুঁকি , চিকিৎসার সম্ভব্য ব্যয় ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত রাখা প্রয়োজন-আমাদের দেশে এই অংশটি যথেষ্ট দুর্বল (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে) এবং এর অধিক চর্চায় অনাকাংখিত ঘটনা অনেকাংশেই কামানো সম্ভব।
আইনটিতে“কোনো রোগীর চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, ভাষা, শিক্ষা, আর্থিক, ব্যবস্থা,পেশা,পদবী, জাতীয়তা,জন্মস্থান কিংবা অন্য কোনো কারণে কোনোরুপ বৈষম্য করা যাইবে না”। এই আইন ভঙ্গে জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক সময় রোগের গুরুত্বের চেয়ে রোগীর পেশা এবং পদবী দলীয় অবস্থান বাস্তবতার নিরীক্ষে অবস্থান অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। এই আইন বাস্তবায়িত হলে এই অনিয়ম বন্ধ হবে বলে আশা করি।
আইনটিতে “প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে নিজের ইনডেমনিটি ইন্সুরেন্স গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে”। সরকারি হাসপাতালের কিংবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কেনো এই সুপারিশ করা হলো না তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না বরং সবক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন।
এই আইনে বলা হয়েছে“ কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো চিকিৎসাককে, যে নামেই হোক না কেনো, কোনো কমিশন বা আর্থিক সুবিধা বা কোনো উপহার প্রদান করা বা গ্রহণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হইবে, এই ধরনের কোন অপরাধ সংঘঠিত হইবার সংবাদ গোচারীভুত হইলে ট্রাইবুন্যাল স্বপ্রণোদিত হইয়া আমলে গ্রহণ করিতে পারিবে”। আইনটি বাস্তবায়িত হলে দেশে ওষুধ, স্টেন্ট (Stent), অন্যান্য মেডিকেল আইটেম এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ কিছুটা কমবে বলে আশা করি।
প্রস্তাবনা রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠান আবশ্যিক ভাবে রোগীর চিকিৎসাকালীন সময়ের তথ্যাবলী সংরক্ষণ করিবে: এইসব তথ্যাবলীর মধ্যে রোগীর পূর্বের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যাবলী, রোগীর প্রাপ্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য, রোগীর বর্তমান অবস্থা সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার তথ্যাবলী এবং প্রদত্ত চিকিৎসার নির্দেশনা অন্তভূক্ত থাকিবে এর অন্যথায় চিকিৎসক এবং প্রতিষ্ঠানের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে । এটি বাস্তবায়িত হলে রোগীর অসুস্থতার একটি ধারাবাহিকতা পাওয়া যাবে যা তার চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইনটিতে অষ্টম পরিচ্ছেদে সরকারের দায়দায়িত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, সরকার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে জোষ্ঠ্যাতা,যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসরে রোগী প্রতি ফি নির্ধারণ করিবে এবং সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার সর্বোচ্চ মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারণ হইবে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি ভালো লাগলেও কাজটি অনেক কঠিন এবং অনেকাটা অবাস্তব মনে হয়। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে ফি নির্ধারণ করে দিলে চিকিৎসক নতুন প্রযুক্তি, সূক্ষ্য কাজগুলো শিখতে এবং প্রয়োগ করতে অনীহা বোধ করতে পারেন। একজন অভিনয় শিল্পী কিংবা খেলোয়ারের তার পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঠিক নয়। কেননা সেক্ষেত্রে তার উন্নতির উদ্দীপনা নষ্ট হয়ে যাবে একই কারণে চিকিৎসকের পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঠিক হবে না। আবার যোগ্যতার চেয়ে বেশি ফি নির্ধারণ করলে রোগীরা নিশ্চয়তা সেই চিকিৎসকের কাছে যাবে না।
উক্ত আইনে আরও বলা হয়েছে বিভিন্ন টেস্টের সর্বোচ্চ মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিবে। আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের কথা বলি। মেশিনটির বাজার মূল্য ৫ লাখ টাকা থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত রয়েছে এবং দামী মেশিনগুলোতে একাধিক অপশন থাকে। আবার প্রতিনিয়তই প্রযুক্তির সংযোজন ঘটছে। কাজেই সর্বোচ্চ মূল্য যদি লাভজনক না হয় তবে অনেক নতুন মেশিন কিংবা প্রযুক্তি ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন যারা এই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
খসড়া আইনটিতে আরো কিছু বিষয়ের সংযোজন করা যেতে পারে। যেমন চিকিৎসা সেবা গ্রহণে ফটো আইডি অথবা ভোটার আইডি কার্ডের ব্যবহার। কেননা, একজন চিকিৎসক যখন রোগী দেখেন তাকে সম্পূর্ণভাবে রোগীর অথবা তার স্বজনদের দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়। শাস্তির আইনটি বাস্তবায়িত হলে রোগী সনাক্ত করণে জটিলতা দেখা দিতে পারে কিংবা দুষ্টচক্র ভিন্ন ভাবে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। চিকিৎসকদের আচরণ শুধুমাত্র আইন এবং বিধিবিধান দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত না, বরং এর সংগে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে- মেডিকেল এথিকস ও জেনেভা ঘোষণা। কাজেই আইনটিতে এ বিষয়ের উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যবীমার ব্যাপারে আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র ট্যাক্সের টাকায় এবং ব্যক্তি আয় দিয়ে চিকিৎসার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। দেশের সব জনগণের দায়িত্ব অসুস্থদের সহযোগিতা করা এবং স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
মৃত্যু ঘোষণার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে আইনগত একটি ভিত্তি থাকা দরকার। মানুষের শরীরে স্নায়ু যন্ত্র কিংবা শ্বাসযন্ত্র একই সাথে মৃত্যুবরণ করে না। দেখা যায় স্নায়ুর কিংবা মস্তিস্কের মৃত্যু (ব্রেইন ডেথ) হয়েছে অথচ হৃদ কিংবা শ্বাসযন্ত্র ভেন্টিলেটর মাধ্যমে বা ভেন্টিলেটর ছাড়াই দীর্ঘদিন সচল রয়েছে। কাজেই কোনো পর্যায়ে বা কোনো ফর্মূলা অনুসরণ করে মৃত্যু ঘোষণা করা হবে তার সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। মৃত্যু ঘোষণার জন্য একাধিক মতোবাদ রয়েছে যেমনঃ সুইস ফর্মূলা, র্হাভাড ফর্মূলা, হাঙ্গেরিয়ান ফর্মূলা , অস্টেলিয়ান প্রস্তাব ইত্যাদি।
যে কোন ওষুধ কিংবা অপারেশনের সাফল্যের সম্ভবনা কোনো অবস্থাতেই শতকরা একশত ভাগ নয় কিংবা আরোগ্য নিশ্চিত নয়। চিকিৎসা প্রয়োগে রোগীর আরোগ্যের সম্ভবনা থাকে তবে এই সংগে অন্তনির্হিত কারণে কিছু রোগীর কোনো লাভ নাও হতে পারে। আবার কিছু সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা প্রদানের কারণে তার অবনতি ও হতে পারে। এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা এবং এটা মেনে নিয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞান চলছে। তবে প্রতিনিয়তই চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন হচ্ছে এবং চিকিৎসকদের উচিত সমসাময়িক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা । এজন্য বহু দেশেই চিকিৎসকদের সি এম ই(CME-Combined medical education) এর প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে চিকিৎসককে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর (সাধারণত ৫ বছর পরপর) কর্মদক্ষতার পূর্নমূল্যায়ন করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে হয় তার রেজিস্ট্রেশন রিনিউ করার জন্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল একেবারে বিশ পচিশ বছরের জন্য চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন দিয়ে দিচ্ছেন। প্রস্তাবিত আইনটিতে সিএমই বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
আইনটিতে চিকিৎসা অবহেলা ও অবহেলজানিত ক্ষতিসহ এ সংক্রান্ত বিরোধসমূহ নিস্পতির জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইবুন্যাল গঠণের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এর কর্মপরিধি কার্যত: সংকুচিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রাইবুন্যাল করার চেয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আরো সক্রিয় করা অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।
সবশেষে বলা প্রয়োজন মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা, বাস্তবমুখী পরিকল্পনা, আর্থিক প্রণোদনা, সুষ্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং মেডিকেল সাংবাদিকতায় ইত্যাদির গুণগত মান উন্নোয়নে মনোযোগী হলে আর্ন্তজাতিক মান সম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
ডাঃ মোঃ তারিকুল ইসলাম
এমবিবিএস, এমডি, এফসিপিএস
সহকারী অধ্যপক
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল আগারগাঁও, ঢাকা- ১২০৭।
E-mail: [email protected]