এই দালালদের আবার নিয়ন্ত্রণ করে ঢামেকের ৪র্থ শ্রেণীর কিছু কর্মচারী। এরা হলো ওয়ার্ড বয়, সরদার ও ওয়ার্ড মাস্টার।
এই ট্রলি-দালালদের আয়-রোজগার ট্রলির উপরেই। ঢামেকের জরুরি বিভাগে রোগী আসামাত্র ট্রলি-দালালরা রোগীর পাশে হাজির হয়। ট্রলিতে রোগীকে নিয়ে জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসারের রুমে যায়। জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার রোগীর রোগ-বৃত্তান্ত শুনে রোগীকে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠান। ট্রলি-দালালরা তখন রোগীকে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে আসে।
এরপর এর এরা রোগীর স্বজনদের কাজ থেকে ২'শ থেকে ৫'শ টাকা পর্যন্ত জোর করে আদায় করে থাকে।
মিরপুর থেকে পেটব্যাথা নিয়ে ঢামেকে আসেন বিলকিস আক্তার (২০)। জরুরী বিভাগে থেকে রোগীর স্বজন সুমন টিকেট কাটেন। সঙ্গে সঙ্গে এক ট্রলিম্যান বিলকিসকে ট্রলিতে ওঠায়। পরে জরুরী বিভাগ থেকে নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। আধা ঘন্টা থাকার পরে সুমন খুশি হয়ে ট্রলিম্যানকে ৫০টাকা দেন। এই ৫০ টাকা নিতে ট্রলিম্যান রাজি না হলে ১৫০টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করেন।
রংপুর মিঠাপুকুর থেকে বার্ধক্যজনিত কারণে সেলিম রেজাকে ঢামেকে নিয়ে আসেন তার ছেলে মুজিবুর রহমান। তিনি জরুরী বিভাগ থেকে একটি টিকেট কেটে রোগীকে নতুন ভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলিতে উঠান। ওই ট্রলিম্যানকে রোগী বহনের জন্য টাকা দিতে হয় ছেলের। কত টাকা দিতে হলো ছেলে স্বপনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব জানার দরকার নাই। যদি আবার আমার বাবার চিকিৎসা না হয়!
তবে দুই রোগীর স্বজনরা ট্রলিম্যানদের নাম বলতে পারেননি বা বলেননি।
তিন শিফটে একেকজন ট্রলি-দালাল প্রতিদিন ৮/১০ জন রোগীকে ট্রলিতে করে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে আসে। কোনো রোগীর পিছনে ট্রলি দালালরা আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা পর্যন্ত সময় পার করে। নিদির্ষ্ট ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসকদের নির্দেশে রোগী বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢামেকের অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্যই রোগী ধরার জন্য এরা ওঁত পেতে থাকে। রোগীদের ট্রলির প্রয়োজন পড়ামাত্র এরা রোগীকে ছেঁকে ধরে। ট্রলিতে রোগীকে ওঠানোর পর কাজ শেষে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে এক রকম জোর করেই টাকা আদায় করে থাকে এরা।
তবে এই টাকা শুধু ট্রলি-দালালরা পায় তা নয়। এই টাকার ভাগ এদের যারা ট্রলি বহন করার দায়িত্ব দিয়েছে তাদের ট্রলিপ্রতি দিনে ২'শ টাকা করে দিতে হয়। অর্থাৎ টাকার ভাগ জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয়, কর্মচারী সরদার ও ওয়ার্ড মাস্টাররা পায়।
জরুরি বিভাগে তিন শিফটে মোট ৬ জন সরদার আছে। এরা সকাল, বিকাল ও রাত—প্রতি শিফটে দুজন জন করে ‘দায়িত্বে থাকে’। একেকজন সরদারের অধীনে থাকে ১৫ থেকে ২০জন ট্রলি-দালাল। এই সরদারদের আবার জবাবদিহি করতে হয় জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক ট্রলি-দালাল জানায়, তাদের প্রত্যেককে সরদারদের প্রতিদিন ২'শ টাকা করে দিতে হয়। শুধু তাই নয়, ট্রলিতে রোগী টানার ‘দায়িত্ব’ পেতে অগ্রীম এককালীন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সরদারদের দিতে হয়।
আরো এক দালাল বলে, টাকা ছাড়া ট্রলি মেলে না। ঢামেকের জরুরি বিভাগের সরকারি কিছু কর্মচারী আকাইম্মা তারা কাজ করেন না। ডিউটিতে এসে খালি হাজিরা খাতায় সই করেন। ডিউটি শেষে কার আন্ডারে কত জন ট্রলি দালাল আছে তাদের প্রতেকের কাজ থেকে ২'শ টাকা করে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এভাবেই ঢামেক জরুরি বিভাগে সরকারি ৪র্থ শ্রেণীর কিছু কর্মচারির কার্যক্রম চলছে।
সরকারি লোকবল কম থাকার কারণে মূলত দালালরাই ট্রলিতে রোগী বহনের কাজ করে থাকে। ট্রলি-দালালদের বেশিরভাগই বিবাহিত। এদের সংসার আছে। ঘরভাড়া থেকে শুরু করে সংসার চালানোর সব খরচ এরা মেটায় এই ট্রলি থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে। তাছাড়া আবার প্রতিদিন বাধ্যতামূলক সরদারদের ২'শ টাকা করে দিতে হয়। এমন কি একদিন কাজে না এলেও পরের দিন এসে আগের দিনের নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধ করতে হয়।
‘তাই রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে জোর করে না হলেও সুকৌশলে টাকা আদায় করা হয়’ বলে স্বীকার করেছে একাধিক দালাল।
ওয়ার্ড বয় ও সরদাররা ট্রলি-দালালদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিদিন যে ২শ'টাকা করে নিয়ে থাকে তার ভাগ দিতে হয় জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেনকে। ‘টাকার ভাগ না দিলে বা কম দিলে ওয়ার্ড মাস্টার কাজ করতে দেয় না’ বলে জানায় কয়েকজন ট্রলি-দালাল।
এদের মধ্যে পুরাতন কিছু দালাল আছে যারা খুবই ক্ষমতাধর। এমনটা এরা নিজেরাই বুক ফুলিয়ে দাবি করেছে। এরা প্রায় সময়ই ওয়ার্ড মাস্টারের রুমে গিয়ে বসে থাকে। এসব অতি-ক্ষমতাধর ট্রলি-দাললের মধ্যে আছে ইয়াসিন ও স্বপনসহ কয়েকজন। এরা ওয়ার্ড মাস্টারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেনে সাথে কথা বলতে গেলে তিনি ‘আমার সময় নেই। আগামীকাল আসেন’ বলে দ্রুত সটকে পড়েন।
ট্রলি-দালালদের এহেন দৌরাত্ম্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সরকারি লোকবল কম থাকায় বাইরের লোক দিয়ে ট্রলি ঠেলার কাজ করাতে হয়। এক্ষেত্রে রোগীর স্বজনরা যদি খুশি হয়ে তাদের বকশিস দেন তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে জোর করে টাকা আদায় করে থাকে এমন অভিযোগ পেলেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীরা, যেমন সরদার ওয়ার্ড বয় ও ওয়ার্ড মাস্টাররা, যে ট্রলি চালকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায় করে থাকে, এই মর্মে লিখিত কোনো অভিযোগ আমার কাছে নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়:১৭২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৭/আপডেট ২০৪৪ ঘণ্টা
এএস/ জেএম