দুদিন ধরে তাকে লক্ষ্য করার পর জানতে চাই, আপা আপনার কি প্রথমবার?
‘না, এ নিয়ে চারবার। ’
এতো হ্যাপা সামলাতে সমস্যা হচ্ছে না?
‘হ্যাপা থাকলেও শান্তি আছে।
কি রকম?
‘দুবছর আগে হাঁটুর সমস্যা নিয়ে এখান আসি। ঢাকার নাম করা এক বেসরকারি হাপাতাল তিন লক্ষ টাকা চেয়েছিলো অপারেশনের জন্য। সামর্থে কুলায় নি। একজনের পরামর্শে সিএমসি আসি। বিশ্বাস করবেন? ২শ' ৬২টি রুপির ওষুধ খেয়েছি। আর কয়েকটা ব্যায়াম দেখিয়ে দিয়েছিলো। এখনো সুস্থ আছি। এবার আমার এক আত্মীয়কে নিয়ে এসেছি। তার কিডনিতে সমস্যা। ’
তো কলকাতায় দেখান না কেনো?
‘কলকাতা আর ঢাকার চিকিৎসার মধ্যে কোনো তফাত পাই না এখন। ওই দুজায়গায় এখন শুধু ধান্দাবাজি। আর শত শত ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়ছে বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। কোনো ভরসা নেই কলকাতার চিকিৎসায়। এখানে বরং শত গুণে ভালো। ’
এখানে কি ব্যয় কম?
‘না মোটেই নয়, এটা ভুল ধারণা। গরীবের কেউ নেই। তবে টাকা খরচ করলেও শান্তি আছে সঠিক চিকিৎসায়। আমরা তো খরচ করেই বিদেশে চিকিৎসা করাতে এসেছি। আশা তো একটাই, শুধু ভালো চিকিৎসা পাই যেনো। ’
নাম কি আপা আপনার?
‘মাফ করবেন, নাম বলা যাবে না। যাই হোক, শত দোষ থাক, তবু আমার দেশ, বাংলাদেশ। ’
শুধু ইনি নন, হাজারে হাজারে বাংলাদেশি এভাবেই বলছেন। আশায় বুক বেঁধেছেন সবাই। আর কিছু না, চাই শুধু সুস্থ পরিবেশে সঠিক চিকিৎসা।
চিকিৎসা শুরুর আগে হোটেল এবং থানায় দুই বার অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন বিদেশি বলে। এবার আবার জানাতে হবে হাসপাতালে। ঢাকা থেকে হয়তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন ডাক্তারের। তবুও উপেক্ষা করা যাবে না হাসপাতালের ৯শ' নম্বর ভবনটিকে। এখানেও আপনার ও আপনার পরিবারের পরিচয় জমা দিতে হবে। কবে ভারতে প্রবেশ করেছেন, রোগীর স্বজন কতো, থানায় রেজিস্ট্রেশন হয়েছে কিনা ইত্যাদি। আর এই ৯শ' নম্বর ভবনটি শুধু বিদেশিদের জন্য। বাইরে গেটে লেখা ভারতীয়র প্রবেশ নিষেধ। এখান থেকেই মূলত পরিচালিত হয় বিদেশি রোগীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কার্যক্রম।
যদি নিজের দেশ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিয়ে আসেন, তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। যিনি নিয়ে এসেছেন তার সঙ্গে আপনার তফাৎ শুধু, আপনাকে ভোর পাঁচটা থেকে লাইন দিতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া শুরু হয় ৯টা থেকে। আর যিনি ঢাকা থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছেন, তিনি তার নির্ধারিত সময়ে ওপিডিতে প্রবেশ করতে পারবেন, ডাক্তার দেখাতে পারবেন, টেস্টও করাতে পারবেন।
তবে কি ফল এলো বা পরবর্তী চিকিৎসা কি হবে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বার ডাক্তার দেখাতে পারবেন না, যতক্ষণ না ৯শ' নম্বর ভবনটিতে প্রবেশ করবেন। দ্বিতীয়বার ডক্টরের সাক্ষাতের জন্য ভবনটিতে যেতে হবে বিকেল ৫টা নাগাদ। দুবেলা মিলিয়ে প্রতিদিন এখানে ৮০০ রোগী আসে কেবল বাংলাদেশ থেকেই। এছাড়া নেপাল, শ্রীলঙ্কা তো আছেই। আর প্রতি রোগীর সঙ্গে গড়ে থাকে একজন করে স্বজন। তাই ভোর হোক বা বিকেলবেলা, এখানে অলসতা দেখালে চিকিৎসাই পিছিয়ে যাবে। কারণ, এখানে সপ্তাহে তিনদিন ওপিডি হয়। আবার শনি-রবি বন্ধ থাকে ভবনটি।
এখানকার স্টাফদের গলার স্বর ও চাহনিতে রুক্ষ মনে হলেও খুবই সহযোগী তারা। একমাত্র এখানে অনেকটাই বাংলা বোঝেন তারা। অাপনি যদি অাধা হিন্দি বোঝেন, তাহলে আপনার আলাপ বাংলাতেই করতেও পারেন। উত্তরে তারা আধা বাংলা আধা হিন্দিতে বুঝিয়ে দেবে।
তবে রোগীর কেস হিস্ট্রি নিয়ে আসতে হবে মনে করে। কেনো সিমএমসি এসেছেন, কি সমস্যা ছিলো সবই দেখবে তারা। খুবই মজার বিষয়, এরা বোঝে, আপনি সমস্যার শুরুতেই আসেননি। অনেক দিনের না হওয়া সমস্যার সমাধান করতে এসেছেন। এখানে কেবল বাংলাদেশি প্যাথলজিকাল রিপোর্টগুলো একটু গুরুত্ব পায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞান এখানে খুবই উন্নত। নাম করা অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে আছে বিশ্বমানের আধুনিক যন্ত্রপাতি।
ভারতীয়দের জন্য ডক্টর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে সিএমসি মেইন গেটের সামনে সিলভার গেট নামে ভবনটি থেকে। এখানে ভারতীয়দের বিস্তর লাইন।
চিকিৎসা হয় না এমন কোনো রোগ নেই এখানে। অাউটডোরে রোগী দেখা শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটা থেকে। একবার ভেতরে ঢুকলে বিকাল চারটের অাগে বের হওয়া সম্ভব হয় না। প্রতি পদক্ষেপে এগোতে হবে লম্বা লাইনের মধ্য দিয়ে।
প্রতিদিন গড়ে দশ হাজার রোগী দেখা হয় এখানে। আপনার চিকিৎসার সব তথ্য ও টাকা- পয়সা থাকবে ক্রিশ কার্ডে। তাতে দিতে পারবেন আপনার মন মত পাসওয়ার্ড। হারিয়ে গেলেও জমানো সঞ্চয় নিরাপদেই থাকবে। ক্রিশ কার্ড হাসপাতাল থেকেই বানিয়ে দেয়। এটি সারা জীবনের সম্পদ। যতবার আসুন কার্ডটা নিয়ে আসুন। রোগীর সমস্ত তথ্য এক মুহূর্তে বের হয়ে আসবে।
আর যদি অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তবে রোগীর পরিবারের রক্ত সম্পর্কের কোনো স্বজনকে ভেলোর আসতেই হবে। না হলে অপারেশনই করবে না হাসপাতাল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এখানে প্রতিটা রোগী দালালমুক্ত চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন । এক টাকা কমিশন বা কোনো অর্থিক সহযোগিতা চাইলেও দেবে না এরা। আপনি লাখো রোগী এনে দিলেও। হাসপাতালে কেউ যদি প্রয়োজনের বাইরে টাকা নেয় ( যদিও তা হয় না), তাহলে সরাসরি নির্ভয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিন। নাম গোপন রেখে, দুষ্টের দমন করা হবে। কারণ এটা মিশনারী প্রতিষ্ঠান। এমটাই জানালেন ৯০০ নং ভবনের কর্মকর্তা ভেঙ্কটেশ।
দালালের মাধ্যমে চিকিৎসা সিএমসিতে হয় না। তবে ভারতের সেরা চিকিৎসা এখানেই হয়।
ভেলোরে চিকিৎসা পেতে দরকার সময় আর ধৈর্য
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৭
ভিএস/ এমসি/জেডএম