অতিরিক্ত ওজন শুধু বেশি খাওয়ার কারণেই হয়না, এটি একটি রোগও বটে। বেশি খাওয়ার কারণে শরীরে যে পরিমান এনার্জি জমা হয় তা ঠিক মতো ব্যবহার না করলেই মানুষ মোটা হয়।
১. অতিরিক্ত খাওয়া বিশেষ করে হাই ক্যালরির খাদ্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গ্রহণ করা
২. আয়েশী জীবন যাপন অর্থাৎ খাওয়া ও বসে বসে টেলিভিশন দেখা, প্রত্যক্ষ শারীরিক কাজকর্ম না করা, টানা অনেকক্ষণ কম্পিউটার গেমস খেলা, না হেটে অযথা গাড়ি বা রিক্সা ব্যবহার ইত্যাদি;
৩. কিছু হরমোন জনিত রোগ যেমন- হাইপোথাইরোডিজম, কুশিং সিনড্রোম ইত্যাদি
৪. জন্মগত বা জেনেটিক কারণ অর্থাৎ পিতা মাতার নিকট থেকে পাওয়া
৫. ভাইরাস জনিত যেমন- শতকরা ৩৩ ভাগ অতিরিক্ত মেদবহুল মানুষ এডিনো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত
৬. মেটাবলিজম অর্থাৎ খাদ্যে ও শরীরের ভেতর পরিপাক ও প্রক্রিয়াজনিত অসুবিধা। অর্থাৎ একই পরিমান খাদ্য দুজন সমান বয়সী ও সমান ওজন প্রাপ্ত মানুষকে খাওয়ালেও একজনের জন্য তা স্বাভাবিক ও অন্যজনের জন্য তা মোটা হওয়ার কারণ হতে পারে।
মেপে নিন স্থুলতা:
অতি সাধারণ একটি পদ্ধতিতে স্থূলতা মেপে নেওয়া যায়। আপনার সঠিক উচ্চতা নিন মিটারে এবং ওজন নিন কেজিতে। তারপর আপনার বিএমআই বা বডি ম্যাস ইনডেক্স করে নিন নি¤œলিখিত সমীকরণে: বিএমআই=ওজন (কেজি)/(উচ্চতা)২ । আপনার বিএমআই যদি ১৮.৫ থেকে ২৫ হয় তবে আপনি স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী। বিএমআই যদি হয় ২৫.১ থেকে ৩০ তবে আপনাকে ওভার ওয়েট রাখা হবে। যদি বিএমআই হয় ৩০.১ থেকে ৩৫ তবে আপনি অবিস এবং যদি তা ৩৫.১ এর উপরে চলে যায় তাহলে আপনার মরবিড অবিসিটি রয়েছে। এই তিনটি পর্যায়কে আমরা বাংলা পরিভাষায় অতিরিক্ত ওজন, মাত্রাতিরিক্ত ওজন এবং মৃত্যু ঝুকিপূর্ণ মাত্রাতিরিক্ত ওজন হিসেবে বলি। স্থূলতা পরিমাপে কোমর ও নিতম্বের মাপও নেওয়া যেতে পারে। একজন পুরুষের কোমরের বেড় যদি ১০২ সে.মি. এর উপরে হয় এবং একজন নারীর কোমরের বেড় যদি ৮৮ সে.মি. এর উপরে হয় তবে এদেরকেও অবিস পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় একজন মাত্রতিরিক্ত ওজনের মানুষ একজন স্বাভাবিক ওজনের মানুষের চেয়ে কমপক্ষে ১৫ বছর আগে মারা যায়। অবিসিটি বিভিন্ন রকম মারাত্বক রোগের কারণ হতে পারে, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, স্লিপ এপনিয়া, গিড়া ও শিরদাড়া ব্যথা ও লিপিড জনিত রোগ ইত্যাদি।
ওজন কমানোর কিছু টিপস:
১. ডায়েট: কোন শারীরিক কাজ না করলে দিনে ১৫০০ কিলো ক্যালোরির বেশি এনার্জি সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ না করা। এর পরিমাপ করাও সহজ, যেমন ১ গ্রাম ভাত বা রুটি দেয় ৪ কিলো ক্যালোরি, ১ গ্রাম চর্বি জাতীয় খাদ্য দিবে ৯ কিলো ক্যালোরি এবং ১ গ্রাম আমিষ (মাছ, মাংস) দিবে ৪ কিলো ক্যালোরি। যেহেতু সবধরনের খাদ্যই প্রয়োজন রয়েছে শরীরের, তাই এই হিসাব থেকে অতি সহজেই যেকোন পুষ্টিবিদ সবচেয়ে ভালো খাদ্য ফরমুলা দিতে পারবে।
২. ব্যক্তিগত অভ্যাসে পরিবর্তন: টিভির রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া উচিত। অল্প দুরত্বে গাড়ি বা রিক্সা পরিহার করা উচিত। অনর্থক কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা কমিয়ে দেওয়া উচিত।
৩. খাদ্যাভাস: সময়মত, পরিমানমত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। তিন বেলার খাদ্যের মাঝের ¯œ্যাক্স বাদ দেওয়া উচিত। যদি ক্ষুধা লাগে তাহলে সব্জী জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। খাবার পরপরই পানি বা পানি জাতীয় কোন কিছু গ্রহণ না করলেই ভালো। খাওয়ার ১ ঘন্টা পর পানি পান করা শ্রেয়। টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া উচিত নয়; এতে নিজের অজান্তেই অনেক বেশি খাওয়া হয়ে যায়। কোমল পানীয়, প্যাকেটজাত ফলের রস সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, কাঁচা আমড়া, জাম্বুরা, সাদা জামরুল, কাঁচা কামরাঙা, শসাতে ক্যালরির পরিমান একদম নেই বললেই চলে, সুতরাং কারো বেশি ক্ষিদে পেলে, এই ফলগুলো খেতে পারবেন। এতে অন্যান্য অধিক ক্যালরি যুক্ত খাবারের চাহিদা কমে আসবে এবং তা শরীরের কোন ক্ষতি না করেই ওজন কমাতে সহায়তা করবে।
৪. ব্যায়াম ও শারীরিক কাজকর্ম ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। নিয়মিত ব্যায়াম করা একটি প্রয়োজনীয় অভ্যাস। সাঁতার কাটা সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম। সাইকেল চালালে এবং দ্রুত হাঁটলেও বেশ উপকার পাওয়া যায়।
৫. যদি সবকিছুই বিফলে যায় তাহলে মেডিক্যাল বা সার্জিকাল চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।
বিএমআই যদি কোনভাবে ২৩ এর বেশি হয় তাহলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমানোর চেষ্টা করা উচিত। আর যদি তা ৩০ এর উপর হয় তবে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
দুঃখের কথা হলো এখন পর্যন্ত তেমন কোন ঔষধ বের হয়নি যার সাহায্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ওজন কমানো যায়। সিবুট্রামিন বা অরলিস্ট্যাট বাজারে পাওয়া যায় এমন দুটি ঔষধ- কিন্তু লম্বা সময় ধরে সেবন করার পরও মাত্র ১% থেকে ২% পর্যন্ত ওজন কমে।
বর্তমানে বিভিন্ন রকম অত্যাধুনিক শল্যচিকিসার সাহায্যে এধরনের রোগীর চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। এধরনের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো পাকস্থলির আকৃতি কিছুটা কমিয়ে দেওয়া যাতে অল্প পরিমান খাদ্যেই পেট ভরে খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করা যায়। আগে এসব অপারেশন করতে পেট কাটতে হতো তবে এখন এসব সার্জারি ল্যাপারোস্কপির সাহায্যেই সম্ভব। এর সাহায্যে ইদানিং পাকস্থলির ব্যান্ডিং ও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তবে এসবের জন্য সার্জারি এখনও ব্যয়বহুল এবং রোগীদের নিয়মিত চেকআপ দরকার হয়।
বারডেম হাসপাতালের রুম নং ১০১ এ প্রত্যেক রোববার সকাল ১০ টায় এসব রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ এবং অপারেশন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১১