যে কারণে অতি অল্পতেই ঘাম ছাড়াও বৈরী পরিবেশের কারণে গলা শুকিয়ে তেষ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছে রাজধানীবাসীর।
বাইরে চলাফেরার সময় এই গরমে আমরা শান্তির আশায় রাস্তা থেকে জারের পানি (যা ফিল্টার করা বলে পরিচিত) বা ওই পানি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পানীয় পান করে থাকি।
কেননা ঢাকার সুয়ারেজ সিস্টেমের সঙ্গে ওয়াসার লাইনের সংযোগ হয়ে যায় কোথাও কোথাও। আবার লাইনের বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে লিকেজ হয়ে দূষিত পদার্থ খাবার পানির সঙ্গে মিশে যায় বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যেসব কারণে মূলত ডায়রিয়া ও শিশুরোগের পরিমাণ আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের করা এক গবেষণায় রাজধানীর বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করা জারের পানির ৯৭ ভাগ পানিতে মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু (কলিফর্ম) পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে টোটাল কলিফর্মের বেলায় ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বোচ্চ ১৬০০ ও সর্বনিম্ন ১৭ এমপিএন (মোস্ট প্রোবাবল নম্বর) এবং ফেকাল কলিফর্মের বেলায় সর্বোচ্চ ২৪০ ও সর্বনিম্ন ১১ এমপিএন পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকদের মতে, গরমে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রোগের জীবাণুগুলো দ্রবীভূত হওয়ার সুযোগ পায়। যে কারণে তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে রোগ সংক্রমণ করে। আর ঢাকার ওয়াসার পানিতে ও বাইরে পাওয়া জারের পানি থেকে ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডসহ মারাত্মক সব রোগ হতে পারে।
এই পানিতে এক ধরনের শৈবাল থাকে যা কলেরা সৃষ্টির জন্য মোক্ষম উপাদান। আবার গরমে রান্না করা খাবারগুলো বেশিক্ষণ ভালো থাকে না। অনেক সময় নষ্ট হলেও টের পাওয়া যায় না। এগুলো না বুঝে খেয়েও ফুড পয়জনিং হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, রাস্তায় চলাফেরা করার সময় আখের রস, বিভিন্ন রকম ফলের জুস পান করি যা চূড়ান্ত মাত্রার ক্ষতিকর। কেননা এগুলোর পুরো প্রসেসিংটাই অপরিষ্কার। সর্বপরি ওয়াসার দূষিত পানি যা, ফিল্টার বা ফুটিয়েই হোক না কেনো সম্পূর্ণ পরিষ্কার করাও সম্ভব না।
রোববার (৬ এপ্রিল) দেশের ডায়রিয়া চিকিৎসার জন্য অন্যতম মহাখালীর ইন্টারন্যশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া রিসার্চ অব বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মুমূর্ষ রোগীদের ঢল। গত ৩ মে ৯৮২ জন, ৪ মে ৯৪৮ জন, ৫ মে ৮৭২ জন ও ৬ মে বিকাল পর্যন্ত ৫০০ জন ডায়রিয়ার আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর আগে ২০ এপ্রিলের পর থেকে ৭০০ থেকে ৭৫০ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছিলো।
আইসিডিডিআরবিসূত্রে জানা যায়, এ হাসপাতালে সাধারণত গরমে সাড়ে তিনশ রোগী ভর্তি হয়। এবারই সর্বোচ্চ পরিমাণ রোগী ভর্তি হয়েছে যা আইসিডিডিআরবি’র জন্য রেকর্ড। যে কারণে হাসপাতালের ওয়ার্ডের বাইরেও আলাদা তাবু খাটিয়ে রোগীদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে অল্প কয়েকজন হলেও কলেরা রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। আর এদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আইসিডিডিআরবিতে সাধারণত অত্যন্ত দরীদ্র মানুষেরাই চিকিৎসা নিতে আসে। যাদের পক্ষে পানি পরিষ্কার করে পান করাটাও সম্ভবপর হয় না।
এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি’র সহযোগী বৈজ্ঞানিক ডা. লুবাবা শাহরিন বাংলানিউজকে জানান, এখন এত রোগী আসছে যে এদের সবার মল পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে এতো ডায়রিয়ার কারণ কী? তবে যতদূর দেখছি বা রোগীর ক্লিনিক্যাল ইতিহাস পর্যালোচনা ও অনেকের মল টেস্ট করে এখন পর্যন্ত দূষিত পানির কারণেই এত ডায়রিয়া হচ্ছে। এছাড়া আমাদের ক্লিনিক্যাল প্রেডিকশনের মাধ্যমেও তা নিশ্চিত হচ্ছি। পানিতে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার বা এশেরেশিয়া কোলই (ই কোলই) ব্যাকটেরিয়ার কারণে এরকম মারাত্মক আকারে ডায়রিয়া হচ্ছে। তবে ছোটদের ভাইরাল ডায়রিয়া আর বড়দের এই ব্যাকটেরিয়াল ডায়রিয়া হচ্ছে।
আর এ থেকে সাবধান থাকার উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, এ রোগ থেকে দূরে থাকতে আমাদের করণীয়গুলো হচ্ছে:
• পরিষ্কার পানি খেতে হবে তবে পানি খাওয়া কমানো যাবে না
• রাস্তার খাবার ও পানীয় পরিহার করতে হবে
• সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে
• খাওয়ার আগে পরে, বাথরুমে যাওয়ার আগে পরে এমনকি বাইরে থেকে এসেও হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ধুতে হবে
• এছাড়া ডায়রিয়া হলে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওরস্যালাইন বা খাবার স্যালাইন খেতে হবে
• বড়রা প্রতিবার টয়লেটের পর ১ গ্লাস ও ছোটরা ওজন অনুসারে প্রতি কেজিতে এক চামচ পরিমাণ স্যালাইন খাবে
• মসলাযুক্ত খাবার ছাড়া সব খাবার খাবে, কোনোভাবেই খাবার-দাবার বন্ধ করা যাবে না
• ডায়রিয়া নিরাময়ে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। সেই অপেক্ষা করতে হবে। তবে অবস্থা বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে আনতে হবে।
এদিকে ডায়রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বারছে শিশুরোগও। ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়েও দেখা গেছে মুমূর্ষ শিশুরোগীদের ঢল। যার ক্ষেত্রেও একই কারণ ও রোগ প্রতিরোধে একই পরামর্শ দিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আজীজ বাংলানিউজকে জানান, শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম থাকে তাই রোগও বেশি হয়। এই গরমে শিশুদের জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, ডাইরিয়াসহ অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গুও দেখা যাচ্ছে। তবে এখন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুরোগীর সংখ্যাই বেশি। তাই গরমে তাদের প্রতি অবিভাবকদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৫ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৮
এমএএম/এসআইএস