সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক অভিযান চালিয়ে বিষয়টির প্রমাণ পায়। অভিযানে কর্মকর্তারা দেখতে পান- হাসপাতালটিতে বেড প্রাপ্তি, সিরিয়াল ভেঙে ইসিজি ও ইকো করা, ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার সময় বিভিন্ন হারে ঘুষ দিতে হয়।
হাসপাতালটিতে ৪১৪ শয্যা হলেও দিনে প্রায় ১ হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। ফলে সিট সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সুযোগে সিট-বাণিজ্য চলছে দেদারসে। হাসপাতালটির পিসিসিইউয়ে (পোস্ট করোনারি কেয়ার ইউনিট) সিট-বাণিজ্য চলে সবচেয়ে বেশি। সেখানে দিনে-রাতে এক বেড দিনে ৩-৪ বার বিক্রি হয়।
হাসপাতালের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পুরুষ রোগী আর ৩ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা রোগী থাকেন। ওয়ার্ডগুলো ফ্রি বেডের হওয়া সত্বেও রোগীদের সিট পেতে দিতে হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এ বাণিজ্যের সঙ্গে ১০-১২ জনের একটি চক্র জড়িত। এরা সবাই ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওয়ার্ড মাস্টার বাহার উদ্দিন। অন্য সদস্যরা হলেন—পিসিডিইউর ওয়ার্ড বয় নুরুল ইসলাম ও আশরাফ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় শামিউল হক ও শামসুল আলম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় রেজাউল করিম, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের টেবিল বয় শফিউল ইসলাম ও ওয়ার্ড বয় আহসান হাবিব।
সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য নাম না প্রকাশ করে জানান, সিট-বাণিজ্যের সঙ্গে শুধু তারাই জড়িত নন, ওয়ার্ড মাস্টার বাহার এ থেকে মোটা অংকের কমিশন পান। এ ব্যাপারে জানতে ওয়ার্ড মাস্টার বাহার উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের নিচ তলার ১৩০ নম্বর কক্ষে ইসিজি, ইকো, ইটিটি, অল্টারের পরীক্ষা সরকার নির্ধারিত ফি নেওয়া হয়। একটি মাত্র কক্ষে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নেওয়ার কারণে সেখানে দীর্ঘ লাইন হয়। এই সুবাধে ওই সমস্ত বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা অসহায় রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন।
হাসপাতালটির বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১০০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। একজন রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রথমেই তাকে ইসিজি ও ইকো করতে দেন চিকিৎসকরা। দিনে পুরুষ রোগী ১৫০-২০০ জনের ইসিজি হয় এবং মহিলা রোগীর ইসিজি হয় শতাধিক। সরকারি ইসিজি ফি ৮০ টাকা।
পুরুষ রোগীর ইসিজির দায়িত্বরত টেকনিশিয়ান শহিদুজ্জামান ১০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইসিজি করে দেন। মহিলা ইসিজি রোগীদের দায়িত্বে রয়েছেন জাহানারা শিরিন। তিনিও শহিদুজ্জামানের মতো টাকা নিয়ে বিনা রশিদে ইসিজি করে দেন। পরে তারা রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা নিজেরা ভাগ-ভাটোয়ারা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইকো বিভাগেও একই ঘটনা। সাদা-কালো ইকো ফি ২০০ টাকা, কালার ইকো ফি ৬০০ টাকা। প্রতিদিন ২০০-২৫০ রোগীর ইকো হয়। ইকো কক্ষের কর্মরত ওয়ার্ড বয় সাইফ উদ্দিন প্রতিজনের কাছ থেকে ২০০-৫০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইকো করার ব্যবস্থা করে দেন। দৈনিক এ হাসপাতালে ২০-২৫ জন রোগীর ইটিটি হয়। ইটিটির সরকারি ফি ১০০০ টাকা।
ওই বিভাগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ৫-৭ জন রোগীর ইটিটি সরকারি ফি দিয়ে হয়, বাকি রোগীদের কাছ থেকে ৫০০-৭০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইটিটি করে দেওয়া হয়।
একই অবস্থা হল্টার মনিটরিং রুমে। দুদকের ভিজিলেন্স টিমের পরিদর্শনে অনিয়ম ধরা পড়ে, একটি মাত্র কক্ষে টাকা জমা দেয়ার ব্যবস্থা থাকার কারণে রোগী নিরুপায় হয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ছোটাছুটি করলে উল্লেখিত দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা এর সুযোগ নেন।
দুদক সূত্র জানায়, হৃদরোগ চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাদের হটলাইন-১০৬-এ প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ আসে। এরপর দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশে চার সদস্যের একটি টিম অভিযান চালায়। টিমের নেতৃত্ব দেন দুদকের সহকারী পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন।
অনিয়মের বিষয়ে হাসপাতাল প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানান দুদকের ওই সহকারী পরিচালক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৮
এমএএম/এমজেএফ