ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে তার শরীরের রক্তসহ তিন ধরনের নমুনা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যে তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এ বিষয়ে ভর্তিকৃত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, নিপাহ পজেটিভ হলে অবশ্যই তাদের হাসপাতাল ছেড়ে যেতে হবে। চলতি মৌসুমে এর আগেও দু’জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। যাদের একজন মৃত্যুবরণ করেন।
মঙ্গলবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ধানমন্ডির ওই হাসপাতালে গিয়ে জানা গেছে, যেহেতু রোগটি ছোঁয়াচে, তাই তাকে হাসপাতালের এইচডিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে সেখানকার ছয়টি শয্যা খালি রাখা হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য রোগীরাও আতঙ্কগ্রস্ত হবে। তাই বিশেষ নিরাপত্তায় তার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে পরীক্ষার রিপোর্টে নিপাহ ধরা পড়লে তাকে রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে, এমনটি জানিয়েছে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালটির চিকিৎসকরা বাংলানিউজকে বলেন, প্রাথমিকভাবে রোগীকে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে ধারণা করায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) রোগীর বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে রোগী যেখানে আক্রান্ত হয়েছে সেখানে সার্বিলেন্স টিম পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া রোগীর রক্তসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। আগামী দু’একদিনে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও মানুষকে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। এ কারণে এবার নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৯ বছরের তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে কাঁচা খেজুরের রসের মাধ্যমেই নিপাহ ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এদেশে এ রোগ ছাড়ানোর প্রধান বাহক বাদুড়। কেউ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে পরিবারের সদস্য এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে নিতে মৃত্যুবরণ করে।
গত ১৯ বছর ধরে দেশে নিপাহ রোগটি রয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩০৫ জন। একই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ২১১ জন। মৃত্যুর হার ৬৯ দশমিক ৬৪ ভাগ।
রোগীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের অধিবাসী এ রোগী সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহীর সারদায় প্রশিক্ষণরত ছিলেন। রোগীর নিপাহ হয়েছে এমন ধারণার পর বর্তমানে এ হাসপাতাল থেকেও রোগীকে নিয়ে যেতে বলা হয়। তাছাড়া কোনো হাসপাতাল থেকেই সাড়া পাচ্ছেন না তারা। তবে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতায় এখানেই তার চিকিৎসা আপাতত চলছে।
এ প্রসঙ্গে রোগীর চাচা সুনামগঞ্জের সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজের শিক্ষক মো. শহীদুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার ভাতিজা রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় প্রচণ্ড জ্বরের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি এসআই পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রশিক্ষণ শুরু করে। সারদার পুলিশ মেডিকেল সেন্টারে দু’দিন থাকার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ১৮ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তিনি জ্বরের ঘোরে প্রলব বকতে বকতে জ্ঞান হারাতে থাকে। এরপর বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত এগারোটার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ঢামেকে উপস্থিত হলে আইসিইউ খালি নাই এমন অজুহাতে আমার ভাতিজাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে আইসিইউ নেই বলে জানানো হয়। তখন রাজারবাগের উল্টাদিকে প্রশান্তি হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতালের আইসিইউতে তাকে ভর্তি করি। পরে শুক্রবার সাড়ে ৬টার দিকে এ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা সন্দেহ করছে, তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত। গত রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) আইইডিসিআর থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে, তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা।
তিনি আরও জানান, ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা করেন এবং পুলিশের তহবিল থেকে সহায়তার নির্দেশসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এছাড়া সারদা থেকেও একটি তহবিল আসার কথা রয়েছে। তাছাড়া পুলিশের সহযোগিতায় ঢামেকে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রোগীর তথ্য জমা দিয়েছি।
এ সময় মো. শহীদুল্লাহ অনুযোগ করে বলেন, এ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে রাখতে চাচ্ছে না। তারা আমাদের চলে যেতে বলছে। অন্য কোনো হাসপাতালও রোগীকে ভর্তি নিতে নিতে চায় না। অনেক যোগাযোগ করেও কারো কোনো সাড়া পাচ্ছি না। আমার ভাতিজার সুচিকিৎসা সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
বেসরকারি ওই হাসপাতালে সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, চিকিৎসকরা প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ করেছে তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত। তার চিকিৎসার জন্য আমাদের ছয় শয্যার এইচডিইউ ইউনিট ফাঁকা রাখা হয়েছে। নিপাহ আক্রান্ত হলে তার আশেপাশের রোগীরা দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে। কেননা রোগটি ছোঁয়াচে। তাছাড়া সরকারি নির্দেশনা রয়েছে এধরনের সংক্রামক রোগীদের সাধারণ হাসপাতালে রাখা যাবে না। আমরা অপেক্ষা করছি আইইডিসিআর-এর রিপোর্টের জন্য। রিপোর্টে নিপাহ পজেটিভ হলে অবশ্যই রোগীকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চলে যেতে হবে। তাছাড়া আমরা এ ব্যাপারে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবো বলে আশ্বাস দিয়েছি। আর তাদের এ কথাটা জানানোর পর তারা প্রচণ্ড দুঃচিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেটাও স্বাভাবিক। তবে রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত রোগী এখানেই থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯
এমএএম/এসএইচ