তারা বলেছেন, ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের হার ২ শতাংশ বাড়লে হৃদরোগের ঝুঁকি ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার ৩৪ শতাংশ বাড়ে।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, ট্রান্স ফ্যাট বা ট্রান্স-ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) হলো প্রাকৃতিক বা শিল্প উৎস থেকে আসা অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। প্রাকৃতিক ট্রান্স-ফ্যাটের মধ্যে রয়েছে দুধ, মাখন, ঘি, গরুর মাংস, ছাগলের মাংসের মতো প্রাণীজ উৎস। যা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত তেমন ক্ষতিকর নয়। কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে উদ্ভিজ তেলের হাইড্রোজেনেশনের সময় ট্রান্স ফ্যাট উৎপন্ন হয়। আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেলই শিল্পে উৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস।
সিঙ্গারা, সমুসা, পুরি, বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি পণ্য যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকে সেগুলো তৈরিতে হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক স্ট্রিট ফুড যেগুলো কড়া করে ভাজা হয় সেগুলোতেও ট্রান্স ফ্যাট থাকে। এছাড়া রান্নার কাজে একই তেল বারবার ব্যবহার করলেও তাতে ট্রান্স ফ্যাট উৎপাদিত হয়।
চিকিৎসকদের মতে, ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড অন্যান্য যেকোনো খাদ্যের তুলনায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল কমায়। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ এরও বেশি মানুষ অসংক্রামক রোগে (এনসিডি) আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। যা মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল, বাংলাদেশ’ অনুসারে ৩০-৭০ বছর বয়সের মধ্যে ২২ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগের কারণে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। আর অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ ট্রান্স ফ্যাট।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত আছি। ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের পক্ষে সম্ভব না। আরো বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। এক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে বৈঠক করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে শিল্পজাত ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে ২০১৯-২০ সালের মধ্যে খাবারের উৎস থেকে ট্রান্স ফ্যাট নির্মূল করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অগ্রাধিকারভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ডব্লিউএইচও-এর তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি সারাদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করতে পারবে। অর্থাৎ ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা ২ দশমিক ২ গ্রামের কম হবে। বর্তমানে এটি ২ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদিত আছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষ গড়ে কি পরিমাণ ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ করে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ কড়া করে ভাজা খাবারে টিএফএ’র পরিমাণ নির্ণয় করতে একটি গবেষণা শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
২০১৫ সালের একটি গবেষণায় জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ১০টি বিস্কুটের মধ্যে ৫ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। এটা ডব্লিউএইচও নির্ধারিত বর্তমানের পরিমাণের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ, শিশু-কিশোররা ও বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা প্রচুর পরিমাণে সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি, জিলাপির মতো কড়া ভাজা খাবার গ্রহণ করে। এই খাবারগুলো সাধারণত পাম তেল দিয়ে ভাজা হয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয়। ফলে এসব খাবারের ট্রান্স ফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই) আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেলে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। এই মান নিয়ন্ত্রণের জন্য রিফাইনারিগুলোকে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার দরকার পড়ে না। ফলে সহজেই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। এরপর ২০১৫ সালে এফএসএসএআই ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসে। পরবর্তী ধাপে তারা ডব্লিউএইচও নির্ধারিত মাত্রা পূরণ করবে। অথচ, বাংলাদেশ এখনো ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণের পথে যাত্রেই শুরু করেনি।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, দেশে হৃদরোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারকে খাদ্য ও তেলের ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতেও সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৯
এমএমএম/এমএ