অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করা জীবাণুর মধ্যে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া অন্যতম। ই-কোলাই হলো একটি গ্রাম নেগেটিভ, রড-আকৃতির, কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এসব তথ্য দিয়েছে। সম্প্রতি ‘ফাইন্ডিংস ফ্রম অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সার্ভিলেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের ৯টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাণসংহারী জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণা দলের প্রধান আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রিন্সিপাল সায়েন্টেফিক অফিসার ডা. জাকির হোসেন হাবিব জানান, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া প্রায় সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এই জীবাণু সাধারণত তিনভাবে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এটি মূত্রনালীর মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটিয়ে, যে কোনো কাটা বা ক্ষত স্থানে সংক্রমণ ঘটিয়ে এবং আইসিইউতে থাকা রোগীর শরীরে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে।
অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর মধ্যে ইমিপেনেম ৯০ শতাংশ, অ্যামিকাসিন ৮০ শতাংশ, নাইট্রোফুরানটন ৭৭ শতাংশ, জেনটামাইসিন ৭০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে ই-কোলাই। এমনকি পঞ্চম প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক সেফিপিম ৪৫ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে এই জীবাণু। সেফিপিম হলো সেফালোস্প্রিন গ্রুপের সর্বাধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক। এটি বাজারে এসেছে মাত্র বছরখানেক। এরই মধ্যে ই-কোলাই এ ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা শিখে গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় পিডিআর বা প্যান ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স।
এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে মূত্রনালীর সংক্রমণ ঘটনানো জীবাণু ‘প্রটিয়াস’, ‘সিউডোমোনাস এরোজিনোসা’, ‘অ্যাসাইনোটা ব্যক্টর’, টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের জীবাণু ‘সালমোনেলা’ রক্ত আমাশার জীবাণু ‘সাইগেলা’ কলেরার জীবাণু ‘ভাইব্রো কলেরা’।
ডা. জাকির জানান, এসব জীবাণুর কোনটি এমডিআর বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স, কোনটি এক্সডিআর বা এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ যে রোগই হোক না কেন নিশ্চিন্তে ওষুধ থাওয়ার মতো অবস্থা এখন আর নেই।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বাংলানিউজকে বলেন, ‘জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠা অত্যন্ত আতংকের বিষয়। একজন মানুষ হাসপাতালে সংক্রমিত অবস্থায় থাকবে অথচ কোন ওষুধই তার কাজে আসবে না। এর চেয়ে নির্মম খবর আর কিছুই হতে পারে না। তাই এ বিষয়ে সর্বোচ্চ জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স অবস্থা থেকে দেশকে ও দেশের মানুষেকে নিরাপত্তা দিতে হলে অবশ্যই নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেট লাল রংয়ের করা যেতে পারে। যাতে করে প্যাকেট দেখে সবাই বুঝতে পারে এটা অ্যান্টিবায়োটিক। এটি ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা বা বিক্রি নিষিদ্ধ। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেটে কমপক্ষে ততোগুলো ওষুধ রাখতে হবে যাতে একটি কোর্স সম্পন্ন হয়। তাহলেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব।
তারা বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এখন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মহা আতংকের নাম। অপব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যারা মৃত্যুবরণ করছে, তাদের শরীরে পাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলোর ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থেকে। এটা হচ্ছে আমাদের জন্য ভয়ংকর খবর। যা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, দেশজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের অবস্থা খুবই খারাপ। ধারাবাহিকভাবেই গত ১৫ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ৫ থেকে ১০ বছর আগে খুবই কার্যকর ছিল, সেগুলোর প্রায় কোনটিই এখন আর তেমন কার্যকর নয়।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান খসরু বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষকে অপ্রয়োজনে বা ভুলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। যাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে তাদের অনেকেরই এটা প্রয়োজন নেই। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হলে একটা দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ডেভেলপ করাটা খুব স্বাভাবিক। ’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় দুই-আড়াই লাখ ফার্মেসি আছে। যাদের একটি বড় অংশই অনিবন্ধিত। এই দুই-আড়াই লাখ ফার্মেসি যদি একদিনে অন্তত ৫টি করে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে, তাহলে দেখা যায়, দিনে তারা ১০ থেকে ১৫ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে। যার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের হয়তো এটার প্রয়োজন ছিল। একজন দোকানদারের পক্ষে কোন অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর জন্য প্রয়োজন আর কোনটা প্রয়োজন নেই, এটা বোঝার সুযোগ নেই। এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পর্কে তাদের ধারণা না থাকায়, তারা রোগীদের দু’তিন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকে সাময়িক উপসমের জন্য। যা রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
এমএএম/এজে