আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মানসম্পন্ন কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নয়। যদিও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) নিশ্চিত করছে বাংলাদেশে কেউ আক্রান্ত নয়।
তাদের মতে, এ ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে অনেক মানুষ রাখা হয়েছে। যারা একই টয়লেট ব্যবহার করছেন, একই সঙ্গে খাবার খাচ্ছেন। যা এ ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে এ ব্যবস্থা মোটেও উপযুক্ত নয়। কেননা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ছয়জনকে একসঙ্গে বা জীবাণুমুক্ত এক রুমে রাখা যায় বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ না করায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের এক অধ্যাপক বাংলানিউজকে বলেন, আমেরিকার ২০টি বিমানন্দরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাত্রীরা আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারে। কোয়ারেন্টাইনে সর্বোচ্চ চার থেকে ছয়জনকে একসঙ্গে রাখা যায়। এর বেশি হলে সেটা আর কোয়ারেন্টাইন নয়।
সরকার অনেকটাই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীন থেকে এত মানুষকে এই মুহূর্তে দেশে আনা উচিত হয়নি, তারা সেখানেই ভালো এটা তাদেরই স্বীকারোক্তি। নিয়ে আসলেও ব্যবস্থাপনাটা সঠিক করা জরুরি ছিল। যদিও সরকার বলছে কেউ আক্রান্ত নয়। অস্ট্রেলিয়া তাদের লোক ফিরিয়ে নিয়ে নির্জন দ্বীপে রেখেছে। এদিকে আমরা অনেক জনবহুল একটি দেশ। আর এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুসারে এপিডেমিওলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট, এনভায়রনমেন্টাল, মেডিসিন স্পেশালিস্টের সমন্বয়ে একটি টিম করে কাজ করা উচিত।
এর আগে এক সেমিনারে জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রটেও সায়েন্স সেন্টারের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর বলেছিলেন, চীন থেকে আগত ৩০২ বাংলাদেশিকে যেভাবে হজক্যাম্পে রাখা হয়েছে সেটা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নয়। কোয়ারেন্টাইনে প্রত্যেককে পৃথকভাবে রাখাতে হয়। একজন আরেক জনের সংস্পর্শে না এসে যেন প্রত্যেকেই নিরাপাদে থাকতে পারে। সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। তাছাড়া তারা একই টয়লেট ব্যবহার করছেন। একই সঙ্গে খাবার খাচ্ছেন। যা কোয়ারেন্টাইনের স্বাভাবিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
কিন্তু ভিন্ন মতামত জানানো হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী হয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা আর আমাদের ব্যবস্থা এক হবে না। আমাদের উচিৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচারিত গুজবকে যথাযথভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে জবাব দেওয়া।
বিশ্ব পরিস্থিতি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিবেশিত তথ্যে জানা যায় এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ২০ হাজার ৬৩০ জন নিশ্চিত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত (গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ২৪১ জন আক্রান্ত হয়েছেন)। চীনে ২০ হাজার ৪৭২ জন নিশ্চিত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত (গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ২৩৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন)। এদের মধ্যে মারাত্মক অবস্থায় আছেন ২ হাজার ৭৮৮ জন (নতুন ৪৯২ জন), মৃত্যুবরণ করেছেন ৪২৫ জন (গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন)। চীনের বাইরে নিশ্চিত করোনা ভাইরাস আক্রান্ত আছেন ২৩টি দেশের ১৫৯ জন (গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন), মৃত্যুবরণ করেছেন একজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়নে ঝুঁকির মাত্রা চীনে অতি উচ্চ, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চ এবং সারা বিশ্বে উচ্চ। চীনের সব রোগীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ হুবেই প্রদেশের। চীনে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪২৫ জন। রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার চীনে ২ দশমিক ১ শতাংশ, হুবেই প্রদেশে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। রোগীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ৬০ বছরের বেশী বয়সী, ৭৫ শতাংশ রোগী অন্যান্য রোগেও আক্রান্ত, মৃত্যুবরণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি: সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বাংলানিউজকে তিনি জানান, এ পর্যন্ত দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে মোট ৭ হাজার ২৮৪ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে (গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯৫ জন)। আইইডিসিআর এ পর্যন্ত ৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে (গত ২৪ ঘণ্টায় ৭ জন)। এদের কেউই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নয়।
তিনি আরও বলেন, আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ান্টাইন কেন্দ্রে ৭টি ডরমিটরিতে চীন ফেরত ৩০২ জন অবস্থান করছেন। চিকিৎসাসেবা ও নার্সিং সেবা কার্যক্রমে সেনা কর্তৃপক্ষের মেডিক্যাল সার্ভিস পুরোটাই সহায়তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা সব ওষুধ সরবরাহ করছে। জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে ওষুধ কেনা হচ্ছে। আইইডিসিআর যাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও যাত্রীদের রোগতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করছেন। সামরিক বাহিনীর মিলিটারি পুলিশ কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। তাছাড়া এ উদ্দেশ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৩০ শয্যার আইসোলেশন শাখা খোলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক প্রফেসর ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় সবার খাবার, শিশু খাদ্য, শিশুদের ডায়াপার ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছে। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অফিস কোয়ারান্টাইন ভবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিধনসহ ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ পুলিশ কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রের চারপাশে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনে অবস্থিত বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন জ্বরে আক্রান্ত এক শিশুকে বাবা-মাসহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানা যায়, জেলা পর্যায়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ব্যবস্থা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশন কক্ষ প্রস্তুত হচ্ছে। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ২৫০ শয্যার আইসোলেশন কক্ষ স্থাপন হয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
** ‘হজ ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কোয়ারেন্টাইন নয়’
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০
এমএএম/ওএইচ/