নুন আনতে পান্তা ফুরায় জয়েন উদ্দিনের। শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে বাড়ি থেকে বের হন তিনি।
এরপর গ্রামের মেম্বার জলিল মিয়ার সহায়তায় ১০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমালজি অ্যান্ড অর্থপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন-নিটোর) আসেন তিনি।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) হাসপাতালে এসে টাকার অভাবে ট্রলি পাচ্ছেন না জয়েন উদ্দিন। ট্রলির জন্য ২০০ টাকা দিতে পারেনি জয়েন উদ্দিনের ছেলে ধলা মিয়া। ফলে ট্রলিও পায়নি সে। তাই বাধ্য হয়েই বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে হাসপাতালের ফ্লোরে ফ্লোরে ছুঁটছেন ধলা মিয়া। জয়েন উদ্দিনের বাম পা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। এরপরও ট্রলির সুবিধা পাচ্ছেন না জয়েন উদ্দিন।
এই প্রসঙ্গে ধলা মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘ট্রলি দেয় না। ট্রলি আছে, অ্যানে বলে ট্রলি নাই। ট্যাকা নিবো। বাবার জমি জায়গা নাই। ট্যাকা পয়সাও নাই। আমি অটো রিকশা চালাই। ট্যাকা পামু কই। কয়েকদিন ঘুম নাই। ’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ডাক্তারদের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ভালো। কিন্তু ডাক্তারদের কাছে পৌঁছানোর আগেই দালালদের খপ্পরে পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। নিয়ম অনুযায়ী নিটোরে রোগীরা এলেই বিনামূল্যে ট্রলি সেবা পাওয়ার কথা। অথচ নিটোরে ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা সেবা পেতে প্রতি পদে পদে লাগছে টাকা।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ময়মনসিংহের ভালুকার মহাদেব সাহা। ছোট একটা ব্যবসা করেন। ছয় সদস্যের পরিবার বসবাস করেন টঙ্গী এলাকায়। মহাদেব সাহার দুই পা ও ডান হাত ভেঙে গেছে। নিটোর হাসপাতাল চত্বরে এসে তার স্বজনরা ট্রলির জন্য ভবনের ভেতরে অনেকক্ষণ ঘুরেও ট্রলি আনতে পারেননি। যেখানেই ট্রলি দেখেন, সেখানেই বলা হয়, এটা দেওয়া যাবে না। মহাদেব তখন নিটোর হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।
হঠাৎ এক নারীকর্মী এগিয়ে এসে বললেন, ‘২০০ টাকা দিতে পারলে ট্রলি আইন্যা যেইহানে যাওন লাগবো লইয়া যামু। ’
মহাদেব সাহার স্ত্রী রীণা সাহা বলেন, ‘ট্রলি নিতে চায় ২০০ টাকা। পরে আমার দাদারা কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্ট করে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। ’
মেহেরপুরের রায়হান উদ্দিন তার ছেলে টিটুকে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর নিটোরে ভর্তি করান। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা ভেঙে যাওয়াসহ কেটে যায়। কোনো মতে তার পা ডাক্তারেরা রাখতে পেরেছেন। এর জন্য প্রায় ১২ বার অপারেশন থিয়েটারে নিতে হয় টিটুকে। যতবার হাসপাতালের বেড থেকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় ততবারই ট্রলির জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়। ফলে প্রায় দুই হাজার টাকা শুধু ট্রলির জন্যই দিতে হয়েছে রায়হান উদ্দিনকে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘টাকা না দিলে ট্রলি কেউ দেয় না। ট্রলি বাথরুমের ফ্লোরে তালা মারা থাকে। আগে টাকা দিলেই পরে ট্রলি হাতে দেয়। ’
রায়হান উদ্দিনের কথা শোনার পর বাথরুমে গিয়ে দেখা গেছে, ট্রলিতে তালা লাগানো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিটোরে দালালদের দৌরাত্ম্য যেন থামছেই না। পেশাদার দালাল ছাড়াও হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। দু’টি শ্রেণির দালালরাই নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে ট্রলি নিয়ে। দালালদের হাতে প্রতারণার শিকার হচ্ছে গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল মানুষগুলো। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিয়ে অনেক সময় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকা। এই হাসপাতালে রোগীর স্বজনেরা একপ্রকার জিম্মি দালালচক্র আর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কাছে। হাসপাতালে পা দেওয়ার পর থেকেই যেকোনো রোগীকেই পড়তে হয় দালালচক্রের হাতে। এসব দালাল চক্রের কেউই হাসপাতালের কোনো স্টাফ নয়। তারপরও রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসার যাবতীয় কাজই টাকার বিনিময়ে তারাই করে দেয় রোগীদের। হাসপাতালের বেড পাওয়া, লিফটে ওঠা, ট্রলি পাওয়া, খাবার পাওয়া, যেকোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ যাবতীয় কাজের জন্য রোগীদের গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ।
এ প্রসঙ্গে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল গনি মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালে একটি চক্র এখনো আছে। তবে এরা হাসপাতালের বাইরের লোক। আশপাশের বস্তি থেকে এসেছে। তবে কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে ছবিসহ আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবো। সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবো না। ’
হাসপাতালের ট্রলির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে শত শত ট্রলি আছে। হাসপাতালে ট্রলির অভাব নেই। আমরা দালাল চক্রের সিন্ডিকেট ভেঙে দিচ্ছি। এটা চলমান থাকবে। বহিরাগত কিছু দালাল এখনো রয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০
এমআইএস/এইচএডি/