বিজ্ঞানীদের অনুমান, হয়তো এখান থেকেই নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত চীনে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে।
চীনে যে ভাইরাসটি আতংক সৃষ্টি করেছে তা এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস হলো ভাইরাসের এক বিশেষ গোষ্ঠী যার অস্তিত্ব ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম মানুষের গোচরে আসে। কিন্তু এর উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই নাই। রাজা-রাণীর মাথায় ব্যবহৃত মুকুটের মতো দেখতে এই ভাইরাসের এমন নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণত মানুষ বা প্রাণীর শ্বাসতন্ত্রই এদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে। অনেক সময় অন্ত্রও আক্রমণ করে।
সাম্প্রতিক অতীতে নানা জাতের করোনাভাইরাসের প্রকোপ পৃথিবীতে দেখা গেছে। ২০০২-০৩ সালে চীন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স ভাইরাস। সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল এক জাতের ভাম বিড়াল থেকে। তারপর ২০১২ সালে মধ্য এশিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল মার্স ভাইরাস। মার্স ভাইরাসের উৎস ছিল এক জাতের উট। সার্স ভাইরাসে সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় দশ হাজার মানুষ। তার মধ্যে প্রায় ৮০০ জন মৃত্যুবরণ করেছিল। মার্স ভাইরাসের সংক্রমণের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার, কিন্তু এতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় সার্স ভাইরাসের মতোই।
আগের ভাইরাসগুলি থেকে পৃথক করতে এবারের ভাইরাসটিকে বলা হচ্ছে নোভেল করোনাভাইরাস, অর্থাৎ নয়া করোনাভাইরাস। বিজ্ঞানীদের কাছে এর নাম অবশ্য 2019-nCov ev COVID-19.
কিভাবে ছড়ায়: মূলত বাতাসের এয়ার ড্রপলেট এর মাধ্যমে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে, ভাইরাস আছে এমন কিছু স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করলে।
লক্ষণ: মানবদেহে প্রবেশের পর এই ভাইরাস ২-১৪ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যেমন-জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, নিউমোনিয়া হতে পারে, ডায়রিয়া, বমি বা বমিভাব হতে পারে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে যেতে পারে।
অধিক ঝুঁকিতে যারা: যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট বা লিভারের রোগ বা ক্যান্সার আছে তারা বেশি আক্রান্ত হয়। যুবকদের চেয়ে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের মৃত্যুর হার অধিক।
চিকিৎসা: কভিড-১৯ এর নির্দিষ্ট কোন এন্টিভাইরাল ওষুধ নেই। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফলের রস খেতে হবে। বিশ্রামে থাকতে হবে।
প্রতিরোধ: এখনো এর কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। এজন্য নিজেকে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন (অন্ততপক্ষে ২০ সেকেন্ড) এবং প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাঁচি কাশি দেওয়ার আগে টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা উচিত এবং ব্যবহারের পর ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে পরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেওয়া। আক্রান্ত অবস্থায় বাসায় অবস্থান করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহার করা যাতে অন্যদের কাছে রোগ না ছড়ায়, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা(কমপক্ষে ৩ ফুট), দুধ ও ডিম ভাল করে ফুটিয়ে এবং মাংস সঠিকভাবে রান্না করে খাওয়া, জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং হাত না ধুয়ে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ না করা।
কখন হাত ধুতে হবে: হাঁচি-কাশি দেওয়ার পর, রোগীর সংস্পর্শে আসার পর, খাবার খাওয়া ও রান্নার আগে এবং পরে, টয়লেট করার পর, পশু-পাখি স্পর্শ করার পর।
কারা মাস্ক ব্যবহার করবেন: আক্রান্ত ব্যক্তি, চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী, রোগীর পরিবারের সদস্য যারা তার সংস্পর্শে থাকে, সুস্থ মানুষের মাস্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন নাই।
সতর্ক থাকুন-সুরক্ষিত থাকুন: নোভেল করোনাভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক। চীন থেকে এই ভাইরাস অন্য দেশগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ ঢুকে পড়েছে আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারতেও। তাই এই মুহুর্তে নোভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জেনে রাখা সকলেরই একান্ত প্রয়োজন। এর সংক্রমণের লক্ষণগুলো মনে রাখুন। মাথায় রাখুন ভাইরাসটি থেকে আত্মরক্ষার নিয়মকানুন এবং এর সংক্রমণ মোকাবিলার পন্থা ও পদ্ধতি।
এরপর ভাইরাসটির গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে টিভি, খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত নজর রাখুন। তবে গুজব ছড়ানো চলবে না। আর গুজবে কান দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। সবাই সুস্থ থাকুন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাউদার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০২০
এসি/টিসি