ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের হালচাল

মো. জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০২০
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের হালচাল ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া:  ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল। জেলার মানুষের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালটি।

সঙ্গে যোগ হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রম।  

কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণাধীন থাকায় জেনারেল হাসপাতালটিই ব্যবহার করা হচ্ছে অস্থায়ী ক্যম্পাস হিসেবে।  

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রোগীদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগানো, হয়রানি করা, ওষুধ না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ।  

সম্প্রতি করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের সেবা দান নিয়েও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের কিছুটা স্বীকারও করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে এমন তথ্যই জানা গেছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টারও অভিযোগ করলেন জিসান নামে এক ভুক্তভোগী।

১৮ বছর বয়সী এ যুবক কাজ করেন কুষ্টিয়ার একটি শিল্প কারখানায়। সেখানে এক মাস আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলে বাম হাতের হাড় ভেঙ্গে যায় তার।  

জিসান বাংলানিউজকে বলেন, আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে যাই এক মাস আগে। যেদিন পড়ে যাই, সেদিনই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিক সার্জারি) ডা. রতন কুমার পালকে দেখাই। তিনি শহরের লালন শাহ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলেন আমাকে। সেখানে গিয়ে ওনার কাছে চিকিৎসা নেই। এরপর ডা. রতন কুমার পাল বলেন, অপারেনশন করতে হবে। এজন্য ২৫ হাজার টাকা লাগবে। টাকা না থাকায় সেখান থেকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে চলে আসি। তবে এ হাসপাতালে এসে পড়ি মহাবিপদে। ডা. রতনের স্বাক্ষর ছাড়া আমাকে ভর্তি নেবে না। পরে তার স্বাক্ষর এনে ভর্তি হই। একটানা ১৫ দিন এ বেডে পড়ে ছিলাম। কোনো চিকিৎসকই আমাকে দেখেননি। যেই এসেছেন, বলেছেন এটা ডা. রতনের রোগী। উনি না এলে কোনো কাজ হবে না।

অথচ ডা. রতনও আসছিলেন না। তিনি না আশায় আমি বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১৫ দিন পর ১৩ জুন আমার অপারশেন করেন ডা. রতন, বলেন জিসান। পরে ১৭ জুলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি।

আক্ষেপ করে তিনি আরো বলেন, আমরা গরিব মানুষ, এটাই কি আমাদের অপরাধ? সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হয়েও এখানে চিকিৎসা দিতে গড়িমসি করেন। অথচ প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে ঠিকই চিকিৎসা দেন, অপারেশন করেন।

জিসানের বাবা দাউদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমি ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। ক্লিনিকে শুধুমাত্র অপারেশন করতেই ২৫ হাজার টাকা চেয়েছিলেন ডাক্তার। এতো টাকা কোথায় পাব? তাই সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসি। সরকারি হাসপাতালে অপারেশন করতে কোনো টাকা লাগেনি, শুধু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। ডা. রতনের কথা না শোনায় এখানে বিনা চিকিৎসায় ১৫ দিন থাকার পর অপারেশন করা হয়েছে। আমার ছেলের পরে যারা ভর্তি হয়েছিল, তাদের অপারেশন হয়ে গেছে আগেই। শুধুমাত্র ডা. রতনের কারণে আমার ছেলের অপারেশনে দেরি হয়েছে।

ওষুধ কেনার রশিদ দেখিয়ে জিসানের মা বলেন, ১৫ দিন হাসপাতাল থেকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি আমার ছেলেকে। শুধুমাত্র গ্যাসের ও ব্যথার ওষুধ আর ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। অপারেশনের পর হাসাপতাল থেকে কোনো ওষুধই দিচ্ছিল না। প্রায় আড়াই হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।

সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে নেওয়ার অভিযোগ অধিকাংশ রোগীর স্বজনদেরই। যারা কুষ্টিয়া শহরের নামী দামী প্রাইভেট হাসপাতালে খরচ বহন করতে না পেরে এ সরকারি হাসপাতালে আসেন, তাদের বেশিরভাগের অবস্থাই জিসানের মতো হয় বলে অভিযোগ রোগী ও স্বজনদের।
 
এদিকে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে রোগীদের যেসব ওষুধ সরবারহ করার কথা, সেগুলো নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের সতত্যাও মেলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের পাশের ফার্মেসিগুলোতে গিয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি ফার্মেসির মালিক জানান, এখানে গ্যাস, পেট ব্যথা, সাধারণ ব্যথা ও বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক বেশি বিক্রি হয়। যার বেশিরভাগই হাসপাতাল থেকে রোগীকে দেওয়ার কথা।
  
যে সময় এ প্রতিবেদক হাসপাতালে গিয়েছিলেন, তখন অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. রতন কুমার পালকে তার কক্ষে পাওয়া যায়নি। তার কক্ষটি তালাবদ্ধ ছিল। এছাড়া একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারীকে দিয়ে ফোন রিসিভ করান।  

সংবাদ কর্মী পরিচয়ে একাধিকবার কথা বলার সুযোগ চেয়ে অনুরোধ করলেও তার সঙ্গে কথা বলতে দেননি ওই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সহকারী।

এদিকে, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের দেওয়া তথ্য মতে, এ হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিনই তিন শতাধিক রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন। চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির ৬৩টি পদের মধ্যে রয়েছেন ৩৭ জন। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মিলে কর্মচারীর সংখ্যা ২৯৯। এখানে পদ ফাঁকা রয়েছে ১০২টি।

এদিকে করোনা রোগীদের সেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরিবর্তে নার্স ও স্টাফ দিয়ে সেবা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটি স্বীকারও করেছে।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তাপস কুমার সরকার বাংলানিউজকে বলেন, করোনাকালে সব চিকিৎসক একসঙ্গে হাসপাতালে না এসে ডিউটি ভাগ করে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যাদের করোনার মৃদৃ লক্ষণ থাকে, তারা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং যাদের শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মোবাইলে আমরা প্রতিনিয়ত রোগীদের খোঁজ নিচ্ছি।

হাসপাতালের বাইরের একটি ছাত্রাবাসকে করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে সব সময় চিকিৎসকদের পক্ষে রোগীদের চোখে চোখে রাখা সম্ভব না। ওখানে সার্বক্ষণিক যারা দায়িত্বে থাকেন, তারাই সেবা দেন। নার্সরা যদি মনে করেন, তখন চিকিৎসক গিয়ে দেখেন। ওয়ার্ড বয়, আয়া, ১৯ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সাতজন নার্স এবং রোস্টার ডিউটিতে দু’জন করে চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন করোনা রোগীদের।

করোনাকালে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কম উল্লেখ করে ডা. তাপস কুমার সরকার বলেন, করোনার আগে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হতো। এখন রোগীর সংখ্যা কম। যেখানে প্রতিদিন ৭০০ রোগী ভর্তি থাকতেন এবং বহির্বিভাগে প্রতিদিন দেড় হাজার থেকে দুই হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নিতেন, সেখানে এখন সে সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। করোনা আতঙ্কে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ হাসপাতালে আসছেন না।
বিশেষ ধরনের কিছু ওষুধ ছাড়া হাসপাতালে সচারচর যেসব ওষুধ রোগীদের বেশি প্রয়োজন হয়, সেগুলোর সরবরাহ রয়েছে। মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হতে পারে। এছাড়া করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।  

তিনি আরো বলেন, কুষ্টিয়ায় চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা নেই। চিকিৎসকরা হাসপাতালের গাড়িতে যাতায়াত করছেন।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোসা. নূর-নাহার বেগম বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে আসা রোগীদের ভাগানোর ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর আগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বেশ কিছু দালালকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। আর কতদিন পরে রোগীর অপারেশন করা হবে, সেটা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকই ভালো জানেন। আর রোগী ভর্তি করতে কোনো চিকিৎসকরে স্বাক্ষর লাগে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।