ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ নীতিমালায় দীর্ঘসূত্রিতা

পাঠান সোহাগ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২১
ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ নীতিমালায় দীর্ঘসূত্রিতা ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: খাদ্যের সঙ্গে উচ্চমাত্রার চর্বি জাতীয় পদার্থ ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এর কারণে হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যুও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন দেখা যায়, বিশ্বে ট্রান্সফ্যাটের কারণে হৃদরোগে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষ সার্বিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার মধ্যে চার দশমিক ৪১ শতাংশ অর্থাৎ পাঁচ হাজার ৭৭৬ জনের মৃত্যুর জন্য শুধু ট্রান্সফ্যাটই দায়ী।

এদিকে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতি প্রণয়নের কাজ করেছে। তবে খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের অগ্রগতি এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। যতই বিলম্বিত হচ্ছে ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন, ততই বেড়ে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা। এমনটাই ধারণা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, শুধু দ্রুত আইন প্রণয়ন ও কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অকালমৃত্যু সংঘটিত হচ্ছে তা পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি হলো সকল ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে  ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা, পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) সদস্য মঞ্জুর মোরশেদ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। খসড়া নীতিমালার ইংরেজি ভার্সন তৈরি হয়েছে। আরও মিটিং হবে। এখন এটার বাংলা করতে হবে। তারপর মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাধারণত প্যাকেটজাত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও বেকারি পণ্যে ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে। ট্রান্সফ্যাট এক ধরনের স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান, যা রক্তের এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। অপরদিকে এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। অথচ ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতি সম্পর্কে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষই ধারণা রাখে না।

শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। সম্প্রতি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণায় ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডসমূহের মোট ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে পিএইচও বা ডালডা সাধারণত ভাজাপোড়া, স্ন্যাক্স ও বেকারিপণ্য তৈরি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মঞ্জুর মোরশেদ আহমেদ বলেন, ১৯ জানুয়ারি ট্রান্সফ্যাট নিয়ে নীতিমালা প্রস্তুতি বিষয়ক একটি মিটিং ডাকা হয়েছে। এই মিটিংয়ে খসড়া নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হবে। তারপর শিল্পমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্টেকহোল্ডার এবং ভোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তবে খসড়া নীতিমালা তৈরিতে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যে সব দেশের ট্রান্সফ্যাট নিয়ে নীতিমালা আছে তাদের এটি তৈরি করতে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লেগেছে। আমরা এই নীতিমালা তৈরির কাজ ২০১৮ সালে শুরু করেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা সুপারিশ আছে। তারা বলছে এটা ২০২২ সালের মধ্যে শেষ করতে। আমরাও আশা করছি ট্রান্সফ্যাট নিয়ে নীতিমালার কাজ ২০২২ সালের আগেই আমরা শেষ করতে পারব।

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বাংলানিউজকে বলেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতি চূড়ান্ত করতে হবে। কোনো অজুহাতেই ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা যাবে না। ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের মাধ্যমে প্রতিবছর হৃদরোগের মারাত্মক ছোবল থেকে রক্ষা পাবে সারাদেশের হাজারো মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২১
পিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।