ঢাকা: অকালমৃত্যু ও মানবদেহের জন্য নীরব ঘাতক ট্রান্সফ্যাট। খাবারে থাকা ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে খসড়া নীতি প্রণয়ন করেছে সরকার।
ট্রান্সফ্যাট মানবদেহের ‘ভালো’ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ‘খারাপ’ কোলেস্টরেলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত মাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘটে অকাল মৃত্যু।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার মধ্যে ৪.৪১ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রান্সফ্যাট হলো ক্ষতিকর চর্বিজাতীয় খাবার। ট্রান্সফ্যাট বা ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস মূলত দুটি। প্রাকৃতিক, গবাদি পশু-প্রাণীর অন্ত্রে এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়, যার ফলে গরু-ছাগলের মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার যেমন, ঘি, মাখন ইত্যাদিতে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট থাকে।
আরেকটি হচ্ছে কৃত্রিম বা আংশিক জারিত ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল-পিএইচও) করা হলে তরল অবস্থা থেকে কঠিন বা অর্ধ-কঠিন অবস্থায় রূপান্তর হয়। যাকে আমরা ডালডা বা বনস্পতি নামে জানি। এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এই আংশিক জারিত তেলই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস। এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট থাকে বলে গবেষণায় দেখা গিয়েছে।
এছাড়াও খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া ও বেকারি খাদ্য পণ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ এবং পণ্য দীর্ঘসময় ভালো রাখার জন্য আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেল (পিএইচও) ব্যবহার করে থাকে। একই তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করার সুপারিশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে হাসপাতাল এবং রিসার্চ সেন্টারের হ্রদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা বলেন, ট্রান্সফ্যাট হচ্ছে এক ধরনের ফ্যাট। খাবারের সাথে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের ফলে আমাদের শরীরে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে আমাদের হৃদরোগ এবং স্ট্রোক হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকেই বেশি অকালমৃত্যু ঘটছে। খাবারে যদি ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ কমাতে পারি তাহলে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও কমাতে পারবো।
এ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, কোন রকম বিনিয়োগ ছাড়াই শুধু নীতিমালা করে আমরা ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা যদি খাবারের মধ্যে টোটাল ফ্যাটের ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট থাকতে হবে, এটা যদি নির্ধারণ করে দেই, তাহলে খাবার থেকে ট্রান্সফ্যাট কমে যাবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশেও উদ্যোগ নিলে ট্রান্সফ্যাট পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুল কাইউম সরকার বলেন, ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে আমরা একটা খসরা নীতিমালা করেছিলাম, আমাদের টেকনিক্যাল কমিটি কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। তাদের প্রস্তাবনার আলোকে আমরা নীতিমালায় কিছু সংশোধন এনেছি। এরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার জন্য পাঠানো হবে। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে এটা চূড়ান্ত করা হবে।
চূড়ান্ত নীতিমালা পেতে কতদিন লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনমন্ত্রণালয়ের ভেটিংসহ গেজেট ভুক্ত হতে কমপক্ষে আরও ছয়মাস লাগতে পারে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সগঠনগুলো বলছেন, ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে কোনো নীতিমালা না থাকায় ভোক্তা স্বাস্থ্য চরম হুমকিতে রয়েছে। শিল্পোতপাদিত খাবার থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে নীতিমালা প্রণয়নে যত বিলম্ব করা হবে, ততোই ভোক্তার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২১
আরকেআর