ঢাকা : বাড়িতে তুলসী গাছে গড় হয়ে প্রণাম করছে বাঙালি বধূ। তার পরণে গরদের লাল পাড়ের সাদা শাড়ি।
এমন দৃশ্য আমাদের মাঝে উপস্থাপনে গণমাধ্যমেরও জুড়ি নেই। নাটক-নবেল থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রেও উঠে এসেছে এমন দৃশ্য।
তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম থেকে শুরু করে সবার বাড়িতেই তুলসী গাছ থাকেই। এটি একটি ঔষধি গাছ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। মোটামুটি সবাই গাছটির ভেষজ গুন সম্পর্কে জানে এবং ছোটখাট অসুখে বাড়িতে বসেই এ গাছের পাতা দিয়ে টুকটাক ওষুধ বানিয়ে নেয়।
তুলসী একটি ঔষধি গাছ। তুলসী অর্থ যার তুলনা নেই। তুলসী এর ইংরেজি নাম Holy basil এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Ocimum basilicum Linn.
তুলসী আমাদের দেশে জন্মানো খুবই সাধারণ একটি উদ্ভিদ। তবে সাধারণ হলেও অসাধারণ গুণ তুলসীর মধ্যে বিদ্যমান। হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে লাগে বলে বাড়িতে-মন্দিরে তুলসী গাছ লাগিয়ে থাকে। হিন্দু দেবতা নারায়ণের প্রসাদ লাভের জন্য তাঁর চরণে একটি করে তুলসী পাতা দেওয়া হয়।
তুলসী পরিচিতি : তুলসী সাধারণত একটি ঘন শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট ২-৪ ফুট উঁচু বড় বিরুৎ বা ছোট গুল্ম জাতীয় কটু তিক্তরস যুক্ত উদ্ভিদ। এর পাতায় এক ধরনের সুগন্ধী তেল থাকে তাই তুলসী গাছ সুগন্ধযুক্ত।
এর পাতা সরল, ডিম্বাকৃতি, ছোট রোমযুক্ত ও কিনারা সাধারাণত খাঁজকাটা। এর বীজ চ্যাপ্টা, মসৃণ ও ফিকে লাল। সারাবছর এর পাতা সংগ্রহ করা যায়।
সাদা তুলসী গাছটাই সাধারণত চোখে পড়ে তবে কালো তুলসী গাছ ও দেখা যায়, যাকে বলা হয় কৃষ্ণ তুলসী। জুলাই আগস্ট বা নভেম্বর ডিসেম্বরে এতে মঞ্জুরি দেখা যায়। ভারতে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ করা হয়।
তুলসীর ব্যবহার : শুধু যে পুজো-অর্চনাতেই লাগে তা কিন্তু নয়। এর পাতা, বীজ, ডাল সবকিছুই মানুষের উপকারে লাগে। আয়ুর্বেদে তুলসীকে ভেষজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর এই শীতে সর্দিকাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, জ্বর জ্বর ভাব দূর করার জন্য তুলসী পাতার রস খুবই উপকারী।
তুলসীর গুন : তুলসী গাছের গুনের কথা বলে শেষ করা কঠিন। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রোগে এর রস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গাছটি কৃমিনাশক, বায়ুনাশক, হজমকারক ও রুচিবর্ধক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। বহুবিধ ব্যবহারের জন্য তুলসী পাতা কে বলা হয় ‘কুইন অব হার্ব’ বা ওষধি গাছের রাণী।
তুলসীর উপকারীতা :
• এই শীতে কাশি থেকে রক্ষা পেতে তুলসী পাতা ও আদার রসের সঙ্গে একটু মধু মিশিয়ে খেতে পারেন এতে উপকার পাবেন।
• সকালবেলা খালি পেটে তুলসী পাতা চিবিয়ে খেলে মুখের রুচি বাড়বে।
• ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে, বলিরেখা ও ব্রণ দূর করতে তুলসী পাতার রস লাগাতে পারেন।
• ম্যালেরিয়া জ্বরে তুলসী পাতার রস খেলে দ্রুত জ্বর ভাল হয়ে যায়।
• তুলসী পাতা গরম পানিতে সেদ্ধ করে সে পানিতে গড়গড়া করলে মুখ ও গলার রোগজীবাণু মরে, শ্লেষ্মা দূর হয় ও মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়।
• তুলসী চা শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ায়।
• এই ঠাণ্ডা মৌসুমে ছোট বাচ্চাদের তুলসী পাতা খাওয়ালে কৃমি দূর হবে এবং মাংসপেশি ও হাড় হবে শক্তিশালী।
• তুলসী গাছের বীজও যথেষ্ট উপকারী। এর বীজ শুকিয়ে মিহি করে খেলে প্রস্রাবের ইনফেকশনজনিত সমস্যা ভাল হয়।
• চর্মরোগ দূর করতে তুলসী পাতা দুর্বাঘাসের ডগার সঙ্গে বেটে মাখলে উপকার পাবেন।
• শরীরে কোনোরকম ঘা থাকলে তুলসী পাতা ও ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে লাগাতে পারেন।
• এটি উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে হৃদপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
• এটি যকৃতের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
• চোখের সমস্যা দূর করতে রাতে কয়েকটি তুলসী পাতা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ওই পানি দিয়ে সকালবেলা চোখ ধুয়ে ফেলুন।
এই ওষধি পাতা শুধু শীতে না সারাবছরই ব্যবহার করা যায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছ আমাদের পরিবেশে, বনে-ঝোপে প্রাকৃতিক পরিবেশে খুব বেশি আর টিকে নেই। তুলসী গাছের বাতাস ও যথেষ্ট উপকারী। তাই সম্ভব হলে বাসার ব্যলকনিতে বা ফুলের টবে অন্তত একটি তুলসী গাছ লাগান।
লেখক : ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট, লেজার মেডিক্যাল সেন্টার
বাংলাদেশ সময় : ১৩১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২