ঢাকা: করোনারভাইরাসে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা সারাবিশ্বে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, করোনা মহামারি সমাপ্তির পথে রয়েছে।
সম্প্রতি করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, দেশটিতে করোনা আর মহামারি আকারে নেই। বিশ্বজুড়ে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানির পর এটি একটি স্বস্তির খবর।
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে স্বস্তির খবর প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশের চিত্র উল্টো। দেশে ফের বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ঊর্ধমুখী রয়েছে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।
বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৩৪৬ জনের। এদিন নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৬৭৮ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ২০ হাজার ১৪৮ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৫ শতাংশ। এমন অবস্থায় করোনা থেকে বাঁচতে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে এবং তার ফলে এটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে লোকজনকে টিকা দেওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়েছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এসব থেকে ধরে নেওয়া যায় যে ইতোমধ্যে কোভিড মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে।
করোনাভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। এটি আগের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক হলেও, রোগীকে আগের মতো কাবু করতে পারছে না। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হারও অনেক কম। তবে বৃদ্ধ এবং যাদের বড় রকমের শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে, ‘এন্ডেমিক কোভিডে’ তাদের কারো কারো মৃত্যুও হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি মানুষের মাঝে ছড়াবে ভাইরাসটি দিনে দিনে ততোই দুর্বল হয়ে পড়বে। অন্যদিকে বিপরীত সম্ভাবনাও রয়েছে, যখনই কোনো ভাইরাস ব্যাপকহারে সংক্রমণ ঘটায়, তখন ভাইরাসের আরও বেশি মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। তখন হয়তো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আবার নতুন কোনো মিউটেশনের মাধ্যমে শক্তিশালীও হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস পৃথিবী থেকে একবারে বিদায় নেবে না, থেকে যাবে। কিন্তু সেটা 'প্যান্ডেমিক' হিসেবে নয়, থাকবে 'এন্ডেমিক' হিসেবে। বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ঋতুতে করোনা সাধারণ জ্বর, ফ্লু বা সর্দি কাশির মত ফিরে ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্সের সাবেক উপাচার্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, করোনার যে ধরনটি এখন রয়েছে, এটা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না। এটা একটা দুর্বল ধরন, এতে আক্রান্ত হলে সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বরের মতোই কিছু উপসর্গ দেখা দেবে। সংক্রমণ কম বেশি ওঠানামা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তারপরেও আমাদের সাবধানে থাকা উচিৎ, নিয়মিত এই ভাইরাসকে সার্ভিলেন্সে রাখা দরকার, বিপজ্জনক কোনো মিউটেশনে এটা মোড় নেয় কিনা?
তিনি আরও জানান, করোনা একেবারে নির্মূল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা কোথাও বাড়বে, আবার কোথাও কমবে। করোনার পরিপূর্ণ বিহেভিয়ার বুঝতে আমাদের আরও সময় লাগবে। তবে এটা পরিষ্কার যে, যদি না আবার কোনো বিপজ্জনক ধরন তৈরি হয়, যার সম্ভাবনা এখনও তেমন একটা দেখা যায়নি, তবে হতেও পারে। যাদের বিভিন্ন কোমরবিডিটি রয়েছে এবং বয়স্ক যারা আছেন, তাদের অবশ্যই সাবধানে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত জিনোম সিকোন্সিং করে সব সময় নজদারি করতে হবে, খারাপ কোনো ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলেন, মানুষের সঙ্গে ভাইরাসের সম্পর্ক হচ্ছে, সেযব ভাইরাস খুব বেশি প্রাণঘাতী, হোস্ট ছাড়া তারা নিজেরাও বাঁচতে পারে না। তারা হোস্টকে (মানুষকে) মেরে ফেললে তারাও নিজেরাও নির্মূল হয়ে যায়। যেমন ২০০৩-০৪ সার্চ কোভ-১ যেটা ছিল, সেটার মৃত্যু হার ছিল নয় থেকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সিঙ্গাপুর এবং কোরিয়ায় সার্চ ভাইরাস এসে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালের দিকে মধ্য এশিয়ার মার্চ ভাইরাস দেখা দিয়েছিল, যার মৃত্যু হার ছিল প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এগুলো পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ যেসব ভাইরাসে মৃত্যু হার বেশি, তারা নিজেরাই নির্মূল হয়ে যায়।
কিন্তু কোভিড-১৯ মৃত্যু হার সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশতেও পৌঁছায়নি। আমাদের দেশে দুই এর নিচে ছিল। কোভিড- ১৯ এ যেহেতু মৃত্যু হার কম ছিল, আমরা অনুমান করছিলাম, যেটাকে সিমবায়োসিস বলে, মানুষের সাথে ভাইরাসের সহ অবস্থান, অর্থাৎ হোস্টও বাঁচবে, ভাইরাসও বাঁচবে। আমার মনে হচ্ছে আমরা সেই পর্যায়ে অর্থাৎ করোনা মহামারি প্যান্ডামিক সিচুয়েশন থেকে এখন এন্ডেমিক পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি। এখন করোনাভাইরাস স্থান সময় ভেদে ওঠানামা করবে। তারপরেও করোনাভাইরাসকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই, যেহেতু ভাইরাসটির গতি বিধি এখনও পুরোটা বোঝা যায়নি। আমাদেরকে মাস্ক পড়তে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২
আরকেআর/এসএ