ঢাকা: দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেশ কিছুদিন থেকেই এর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের ঘরে ওঠানামা করেছে।
শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৩৫১ জনের। এদিন নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩৫০ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ২১ হাজার ১১৮ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা দেশে করোনার আরেকটি ঢেউ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে বলছেন, দেশে করোনার ভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য ওমিক্রনের নতুন দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট (উপ-ধরন) দায়ী। পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে করোনা ভীতি না থাকায়, স্বাস্থ্য বিধি চরমভাবে অবহেলিত হওয়ার কারণেও করোনার ফের আরেকটি ঢেউ দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের নতুন দুই উপ-ধরনের স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনের ফলে সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। বাংলাদেশে এখন যে সংক্রমণ বাড়ছে, সেটা বিএ৪৫ এবং বিএ২.৭৫ কারণে। এর মধ্যে আবার বিএ২.৭৫ বেশি সংক্রামক। ওমিক্রনের নতুন এ দুই ধরণ মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (এন্টিবডি) বা টিকাকে ফাঁকি দিতে পারে। ফলে নতুন এ উপ-ধরনে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে সবাই। সংক্রমণ অনেক বেশি হলে মৃত্যুও বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যারা টিকা নেননি, বয়স্ক এবং বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন তাদের ঝুঁকিটা আরও বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন মোট ১৩ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৩৪ জন, দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১২ কোটি ১৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৪৫ জন, বুস্টার ডোজ পেয়েছেন ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৬ জন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনার টিকা বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। তাদের প্রায় ৭৭ শতাংশকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ২৬ শতাংশ লোককে। আর দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ৭১ শতাংশের কিছু বেশি। এখনও প্রায় ৩৩ লাখ লোক প্রথম ডোজ টিকা নেননি এবং প্রায় ৯৪ লাখ লোক দ্বিতীয় ডোজ নেননি।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ বাড়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে অমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেহে করোনার বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা, সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, টিকা নেওয়ার বিষয়ে শুরুর দিকে বলা হল, করোনায় দুই ডোজ টিকা নিলেই হবে। পরে দেখা গেল, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার কিছুদিন পরে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, লোকজন আবার আক্রান্ত হচ্ছে। তখন আবার বুস্টার ডোজ টিকা নিতে বলা হল। কিন্তু বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরেও এন্টিবডি আবারও কমে যায়। ফলে দেখা গেল, দ্বিতীয় ডোজ এবং বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রায় ৩৩ লাখ লোক এখনো একটি ডোজ টিকাও পায়নি। এ জনগোষ্ঠী আবার গ্রামীণ, বয়স্ক, বস্তিবাসী এবং অশিক্ষিত। এই লোকগুলো আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতো রয়েছেই, তাদের জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরেও যেহেতু অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাহলে বুস্টার ডোজ আরও বেশি করে দিতে হত। আমরা অনেক কম সংখ্যক লোককে বুস্টার ডোজ দিতে পেরেছি। বেশির ভাগ লোক বুস্টার ডোজ পাইনি। তার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সবাই এখন করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, যারা এক ডোজও করোনার টিকা নেয়নি, তারা মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে। যারা এক ডোজ টিকা নিয়েছেন, তারা হয়তো মৃত্যু ঝুঁকিতে নেই, কিংবা কম মৃত্যু ঝুঁকি আছেন। কিন্তু তাদের সিভিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের ঝুঁকি একটু কম, তবে শূন্য ঝুঁকি বলা যাবে না। যারা ভাগ্যবান হিসেবে বুস্টার ডোজ টিকা নিতে পেরেছেন তারা আক্রান্ত হলেও মৃত্যু ঝুঁকি অনেক কম।
মাস্ক না পড়া, জনসমাগম, স্বাস্থ্যবিধি না মানা এসব বিষয় রয়েছে। তবে, এ জন্য সরাসরি জনগণকে দোষারোপ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপেক্ষিতে আমরা মাস্ক পড়তে অভ্যস্ত না। ফলে সংক্রমণ হলে সেটা ছাড়াবেই। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের থেকে আবার নতুন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, ফলে সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের এখন একটাই স্বস্তি, বর্তমানে দেশের করোনায় মৃত্যু অনেক কম। আমরা সেটাই কামনা করি।
এ বিষয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জিনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর জাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, এখন মানুষের মধ্য থেকে করোনার ভীতি চলে গেছে। তাই মাস্ক পড়ার বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। স্বাস্থ্যবিধিও প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রচণ্ডভাবে অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। এসব কারণে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের মনে রাখা দরকার করোনার যে ধরনই হোক না কেন, মাস্ক প্রায় ৯০ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। মাস্ক শুধু করোনা ভাইরাস নয়, অন্যান্য রোগ জীবাণু থেকেও সুরক্ষা দেয়, তাই আমাদের মাস্ক পড়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২
আরকেআর/এমএমজেড