ঢাকা: স্ট্রোকের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একটি সেমিনার থেকে জানানো হয়েছে।
রোববার (১৬ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ব্লক অডিটোরিয়ামে স্ট্রোকের কারণ, চিকিৎসাসেবা নিয়ে মাসিক সেন্ট্রাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সবুজ, অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম।
সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল সাব কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী এবং সঞ্চালনা করেন সহকারী অধ্যাপক ডা. সম্প্রীতি ইসলাম।
সেমিনারে অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্ট্রোকের রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। স্ট্রোকের রোগীকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিলে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তবে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাককে এক ভেবে কালক্ষেপণ করায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ ঘণ্টাই জরুরিবিভাগে স্ট্রোকের রোগীদের জরুরি সেবা দেওয়া হচ্ছে। সব মেডিকেল কলেজে ২৪ ঘণ্টাই স্ট্রোকের রোগীদের সেবা দেওয়া যায় এমন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
সেমিনার থেকে বলা হয়, স্ট্রোকের রোগীদের সব আধুনিক চিকিৎসা বিএসএমএমইউ হাসপাতালে করা হচ্ছে। তাই স্ট্রোকের লক্ষ্য দেখা মাত্রই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে বিএসএমএমইউ জরুরি স্ট্রোক সেন্টারে নিয়ে আসতে হবে। ‘টাইম ইজ ব্রেইন’ স্ট্রোকের পর প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি সময় মস্তিস্কে রক্তপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্যারালাইসিস, বিকলাঙ্গতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি বেড়ে যায়। স্ট্রোকের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। স্ট্রোকের লক্ষণ টের পাওয়ার পর রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্ট্রোক রেডি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। লক্ষণ দেখা মাত্রই অতি দ্রুত (সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে) রোগীকে এর জরুরিবিভাগে নিয়ে যেতে হবে ।
মস্তিস্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করার জন্য অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনীয় উপাদান হলো রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সরববাহ হয়। যদি কোন কারণে মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন তাকে স্ট্রোক বলে। মস্তিস্কের যে অংশে রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয় সেখানে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে স্ট্রোকের লক্ষণগুলো দেখা যায়। একইভাবে স্ট্রোকের ফলে মস্তিস্কের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে মস্তিস্কের কোষগুলো মারা যায়। স্ট্রোক মস্তিস্কের খুবই ভয়ঙ্কর অসুখ। হার্ট অ্যাটাকের মতোই স্ট্রোকের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। এ কারণেই স্ট্রোককে ব্রেইন অ্যাটাক বলে। স্ট্রোকে রোগীর প্রতি মিনিটে ১৯ লাখ কোষ মারা যায় এবং তা অনিরাময়যোগ্য।
স্ট্রোক মূলত দুই প্রকার ইসকেমিক স্ট্রোক (রক্ত জমাট বাধা), স্ট্রোকের মধ্যে বেশির ভাগ ট্রাক-ই রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে। মস্তিকেত কোনো রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল গিয়ে ইসকেমিক স্ট্রোক হয়ে থাকে। হার্ট অ্যাটাক যেমন হৃদপিণ্ডের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে, ইসকেমিক স্ট্রোক মস্তিস্কে না রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে। মূলত দুইভাবে ইসকেমিক স্ট্রোক হতে পারে। হৃদপিণ্ড থেকে জমাটবদ্ধ রক্ত ছুটে গিয়ে মস্তিস্কের রক্তনালি বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও মস্তিস্কের রক্তনালিতে চর্বি জমে হয়ে রক্তনালি সরু হয়ে গিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যটি হেমোরহেজিক স্ট্রোক মস্তিস্কের রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত মস্তিস্কে ছড়িয়ে পড়লে তাকে হেমোরহেজিক স্ট্রোক বলে।
যেসব কারণে হেমোরহেজিক স্ট্রোক হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ ও মস্তিস্কের রক্তনালির দেওয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া। সাময়িকভাবে মস্তিস্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হলে তাকে ট্রানসিডেন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক বলা হয়। এই ধরনের স্ট্রোক সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে ট্রানসিডেন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক হওয়ার পর স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সেমিনারে আরও বলা হয়, প্রথমেই মনে রাখতে হবে, একজন রোগী স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্ট্রোকের লক্ষণ এবং সেগুলো শরীরের কোন আংশে আক্রান্ত করবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে তার ওপরে। তবে স্ট্রোকের যেকোনো একটি লক্ষণ কারো দেখা দিলে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। স্ট্রোকের লক্ষণ সহজে বোঝার জন্য মুখ একদিকে বাঁকা, হাত বা পায়ের দুর্বলতা, কথার অস্পষ্টতা ও এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।
স্ট্রোকের কিছু ঝুঁকির কারণ আছে পরিবর্তন করা যাবে না, যেমন: বয়স, পারিবারিক এবং মেডিকেল ইতিবৃত্ত। কিন্তু শতকরা ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই স্ট্রোকের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪ গুণ বেড়ে যায়।
নিয়মিত শরীরচর্চা, অল্প লবণযুক্ত খাবার এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিয়মিত সেবনের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
কোলেস্টেরলের মাত্রা অধিক বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে চর্বিযুক্ত খাবার অনেকাংশে দায়ী। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কোলেস্টেরলের ওষুধ নিয়মিত সেবনের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো সম্ভব।
ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অন্যান্য রোগসহ স্ট্রোকের ঝুঁকি ১ দশমিক ৫ বাড়িয়ে দেয়। সুস্থ জীবনধারা, ডায়াবেটিসের ওষুধের নিয়মমাফিক সেবন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ গুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ধূমপান ছাড়া গেলে ৫ বছরের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি অধূমপায়ীর সমান হবে। স্থূলতা স্ট্রোকের পাশাপাশি অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০২২
আরকেআর/এএটি