ঢাকা: এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে প্রতিদিন। ঢাকা ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ চার মাস হলো ডেঙ্গুর মূল মৌসুম। চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর অক্টোবর মাসের শেষেও ডেঙ্গু জ্বরের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এবার দেরিতে এসেছে বর্ষা। থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়েছে। ফলে দীর্ঘায়ত হয়েছে ডেঙ্গু মৌসুম।
চলতি বছর ডেঙ্গু চারটি ধরনের মধ্যে তিনটি ধরণ (টাইপ-১, ৩, ৪) রোগের প্রকোপ বাড়িয়েছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ায় আক্রান্তদের শক সিন্ড্রোম, অর্থাৎ হঠাৎ শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হেমোরেজিক ফিবার বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে বাড়ছে মৃত্যু।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৭৩ জন নতুন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে সারা দেশে তিন হাজার ৫৮৪ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ২৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। এছাড়া চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১৪১ জন মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ডেঙ্গু বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে অনেক খারাপ। অক্টোবর মাসের শেষেও চলছে ডেঙ্গুর মৌসুম। সামনে হয়তো নভেম্বর, এমনকি ডিসেম্বরেও থাকবে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আমরা ঢুকে পরলাম। ডেঙ্গু এখন আর ঢাকা কেন্দ্রিক নেই, সারা দেশেই ডেঙ্গু বাড়ছে। ঢাকার বাইরেও ৩৫০টি পৌরসভা রয়েছে, এসব পৌরসভাতেও নগরায়নের বৈশিষ্ট্য আছে, যেখানে ডেঙ্গু প্রজননের সব উপকরণ বিদ্যমান রয়েছে। ৩৫০টি পৌরসভায় যদি অল্প অল্প করেও ডেঙ্গু হয়, তাহলে মোট সংখ্যা হবে বিশাল।
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী বা বড় শহর ছাড়া ছোট মফস্বল শহরগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত এবং এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের আদৌ সক্ষমতা নেই। সবখানে যদি একসঙ্গে ডেঙ্গুর বিস্ফোরণ ছড়ায় তাহলে তা জাতীয় জরুরি অবস্থার পর্যায়ে দাঁড়াবে। আমরা সেই শঙ্কার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলা মুশকিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর শুরু, ২২ বছরে আমরা শুধু ঢাকা শহরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আগামী আরও ৩০ বছর যদি আমরা এভাবে চলি তাহলে আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এ বিষয়টা প্রথমে আমাদের বোধোদয় হতে হবে, সেই বোধোদয় থেকে আমাদের উচিৎ ডেঙ্গু পরিস্থিতির একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ করা। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন জরুরি।
জাতীয় কর্মকৌশলের মূল ভিত্তি হবে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। যার মধ্যে থাকবে কীটতত্ত্ববিদ, কীটতাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি, মশক নিয়ন্ত্রণের নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ও কীটনাশক। সব মিলে বড় আকারের কর্মকৌশল যদি প্রণয়ন করা না যায়, তাহলে করোনায় আমরা যতটা সাফার করেছি, ডেঙ্গুতে তার থেকে বেশি সাফার করবো। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভর্তির সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে, মৃত্যুও বেশি হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, কক্সবাজারে এত ডেঙ্গু রোগী হলে, সেটা দেশের অন্য যেকোনো শহরেও নিশ্চয়ই হতে পারে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সর্ব্বোচ্চ হস্তক্ষেপ দরকার। ঢাকার মেয়ররা অনেক ক্ষমতাশালী, বাজেটও অনেক। সেখানে দেশের অন্যান্য ছোট ছোট পৌরসভাগুলোর বাজেটও অনেক কম। ছোট পৌরসভাগুলো রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখতেই হিমশিম খায়। এখনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড়, কার্যকরী এবং জোরদার পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
কার্যকরী ও জোরদার পদক্ষেপ কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কীটতত্ত্ববিদ থাকবে তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জন্য গবেষণার কাজ করবে, ডাক্তার চিকিৎসা দেবে, প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও জনগণকে সচেতনতার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করাতে হবে। একজনের বাসার মশা মারা হলো বা ডেঙ্গুর প্রজননের স্থান ধ্বংস করা হলো, কিন্তু তার পাশের বাসাতে করা হলো না, সেটা যেন না হয় সবাই যুক্ত হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০২২
আরকেআর/আরবি