সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলে নানা মহল থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব ও বিশ্লেষণ দেওয়া হচ্ছে। সরকারও একাধিকবার কমিটি গঠন করেছে এবং ভেঙেছে।
স্বাস্থ্য সংস্কারের পথে যদি এক পাও এগোতে পারি, তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার শুরু হবে কোথা থেকে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের শহীদদের প্রতি কিছুটা সম্মান জানানো হবে।
প্রশ্নটা হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করব? স্বাস্থ্য খাতে অনেক দিন ধরে জমে থাকা সমস্যার পাহাড় দূর করা শুরু হতে পারে তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিটি মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে যা করতে হবে তা করার মতো রাজনৈতিক দৃঢ়তা থাকতে হবে সরকারের। তাহলে যত বাধা, সমস্যাই আসুক না কেন তা উতরানো সহজ হবে।
তবে হ্যাঁ, এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য থাকতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবার সংজ্ঞাটাও সব পক্ষকে পরিষ্কার করে বলতে হবে এবং একমত হতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কি শুধুই চিকিৎসা ওষুধ? স্বাস্থ্যসেবা বলতে মানুষকে সুস্থ রাখার আয়োজনকেই বোঝাতে হবে। রোগ যেন না হয় সেই কাজ করাটা স্বাস্থ্যসেবার আসল কথা।
আর যদি রোগ হয়েই যায়, খুবই দ্রুত চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে যেতে হবে। যত দেরি ততই সমস্যা বাড়তে থাকবে। এ জন্যই হাতের কাছে থাকতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবাও থাকবে।
মানুষকে সুস্থ রাখার আয়োজন আর রোগীর চিকিৎসার আয়োজন এককথা নয়। রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে হাসপাতালভিত্তিক, যেখানে একজন অসুস্থ মানুষকে একক ধরে সব ব্যবস্থা করতে হয়।
আর মানুষকে সুস্থ রাখতে, মানুষকে রোগ থেকে দূরে রাখতে যে ব্যবস্থা নিতে হয়, সেটা সমাজকে একক ধরে করতে হয়। একটা জনগোষ্ঠীর মাঝে যদি নিরাপদ ও সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়, সেটা করতে হয় একটা নির্দিষ্ট জনপদকে একক ধরেই। বাচ্চাদের সুস্থ রাখতে যদি খেলার মাঠের আয়োজন করতে হয়, সেটা করতে হবে পাড়া-মহল্লাকে একক ধরেই। ডেঙ্গু থেকে নিরাপদ থাকতে যদি বাড়ির ভেতরে ও বাইরে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়, সেটা সামষ্টিকভাবে পাড়া-মহল্লাকে একক ধরেই করতে হবে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার শুরু হবে কোথা থেকে একটি জনভিত্তিক শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সারা বিশ্বে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূলস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে এটি অপর্যাপ্ত ও অবহেলিত। এ জন্য তৃতীয় স্তরের ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক রোগীর ভিড় লেগে থাকে। যদি স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক স্তরে এই রোগীরা সেবা নেওয়ার সুযোগ পেত, তাহলে অনেককেই হয়তো মাধ্যমিক বা তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে যেতে হতো না।
প্রতিটি ইউনিয়নে (নগরে প্রতি ওয়ার্ডে) অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রকে সমন্বিত করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এখানে শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক সুবিধাও থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) বাস্তবায়িত করার। এটা তখনই সম্ভব হবে, যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের আদলে সমগ্র দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রয়োজনীয় জনবল/সামগ্রী থাকে। গ্রামাঞ্চলে অনেক গ্রামেই কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র রয়েছে। মহানগর অঞ্চলে এ রকম কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। মাঝে মাঝে এনজিওর মাধ্যমে সীমিত আকারে নগর/মহানগরে ওয়ার্ড পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্য-পুষ্টি সেবা দেওয়া হয়। শহর-নগরেও অতি দ্রুত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো গড়ে তোলা দরকার।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী প্রভৃতি জনবল নিযুক্ত করে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। এসব কেন্দ্র শুধু রোগ নির্ণয় ও রোগীর চিকিৎসাই করবে না, এখানে রোগ প্রতিরোধমূলক সেবা, স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক সেবা কার্যক্রমও থাকবে। জটিল রোগীদের এখান থেকেই মাধ্যমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র/হাসপাতাল বা প্রয়োজনবোধে তৃতীয় পর্যায়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে/হাসপাতালে রেফার (সুপারিশ) করা হবে।
মহানগর/নগরে তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য আউটডোর (বহির্বিভাগ) ব্যবস্থা আছে বড় বড় মেডিক্যাল কলেজেই। মাধ্যমিক পর্যায়ের সেবাও দেওয়া হয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। যেকোনো রোগীর সেখানে না গিয়ে তো উপায় থাকে না। যদিও এসব মহানগর/নগরে হাতে গোনা কিছু আউটডোর ডিসপেন্সারি (ঔষধালয়) রয়েছে, সেগুলো খুবই দুর্বল এবং মানুষের কাছে অজানা। ফলে এগুলো প্রায় অব্যবহৃতই থাকে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একসঙ্গে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রীভূত থাকার কারণে সব সময় প্রচণ্ড ভিড় লেগে থাকে। ফলে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবনতি ঘটে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্ররূপে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শহর ও গ্রামে উপজেলা হাসপাতালের মতো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকেন্দ্রকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থসেবার সন্ধিস্থল হিসেবে বিকশিত করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী ও সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে (উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) আরো শক্তিশালী করতে হবে। অর্থের সংস্থান, জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা প্রভৃতি বিষয়ে বিদ্যমান সীমানার পরিসর আরো বাড়াতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অর্থ ব্যবস্থাপনা, আইটি ব্যবস্থাপনা, তথ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসককেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মর্যাদা দেওয়ার জন্য স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মাধ্যমিক ও তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতালের মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসকরাও কাজ করবেন। এখানে কর্মরত নার্স, মিডওয়াইফ (ধাত্রী), মেডিক্যাল প্রযুক্তিবিদ, মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যও উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য জনবলের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রোগীর স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যতথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবহারোপযোগী করতে হবে। ই-স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যকর হলে তৃণমূলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতা অনেক গুণ বাড়বে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান সঙ্গে সঙ্গেই ঘটবে।
এ জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকে শুধুই খরচ হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। এটাকে স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুধু স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনেই অবদান রাখে না, দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগের চিকিৎসায় যে বিশাল খরচের বোঝা সৃষ্টি হয় তা থেকে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে রেহাই দেয়। এটা বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যে টাকা খরচ করলে তা জাতীয় আয় বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটের অন্তত ৭০ শতাংশ প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় বরাদ্দ করা দরকার। সেটা পর্যায়ক্রমে আগামী বাজেট থেকেই শুরু হোক আর আগামী বাজেটের আগে সরকারের থোক বরাদ্দ থেকে কাজটা শুরু হোক।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যেকোনো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত। এটি সুলভ, টেকসই ও সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সবার জন্য সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
এসএএইচ