ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

একান্ত সাক্ষাৎকারে ফরিদা আখতার

প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে ফরিদা আখতার

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন ফরিদা আখতার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নিরাপদ কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন।

দেশের সার্বিক খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের প্রতিবন্ধকতা, সম্ভাবনা এবং উত্তরণের নানা উপায় নিয়ে একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

সার্বিক কৃষি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দেশের একটি বড় অংশ কৃষি খাত, বিশেষ করে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বনজ সম্পদ খাতে নিয়োজিত রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) একটি বড় অংশ সরবরাহ করছে এই সার্বিক কৃষি খাত। এর মধ্যে নিরাপদ আমিষের সরবরাহ করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। আবার দেশের রপ্তানি আয়ের একটি অংশের সরবরাহ হচ্ছে এই খাতের মাধ্যমে।

ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবেনানাভাবে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত জড়িত। এই খাতের উৎপাদন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, মাটি ও পানি ছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই এ খাতে অগ্রগতি হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য ও আমিষের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত বড় অবদান রাখছে।  

দেশের কৃষি এবং প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য উৎপাদনের তথ্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
দেশের পুরো পরিসংখ্যান বিষয়ে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত সরকার দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। সেখানে এই বিবিএসও বাদ যায়নি। তথ্য নিয়ে আগের সরকার এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।

বিবিএস রাজনৈতিক কারণে তথ্য দিয়েছে। তাদের তথ্য অতিরঞ্জিত ছিল। ওইসব তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে নেওয়া প্রয়োজন। বিবিএসের তথ্য গরমিলের বিষয়টি শুধু কৃষি, মৎস্য ও প্রাণি খাতে রয়েছে তা নয়, এই প্রতিষ্ঠানের সব ক্ষেত্রেই তথ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য নির্ভরযোগ্য হয় কি না সেটি দেখা যেতে পারে।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তথ্য প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য আমরা চেষ্টা করছি মাঠ পর্যায়ের সঠিক তথ্য দিয়ে নীতি নির্ধারণ করতে। এখন সব তথ্যই যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হচ্ছে। ফলে আস্থাহীনতা যেমন কমে আসবে, তেমনি নীতি গ্রহণ আরো সহজ হবে।
 
সাধারণ মানুষের নিরাপদ খাবার খাওয়া কি অধরাই রয়ে যাবে?
দেশের সব ধরনের খাবারেই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। কয়েক দশক ধরে শুধু খাদ্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোয় নজর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মানসম্পন্ন উৎপাদনে ততটা নজর দেওয়া হয়নি। সব সময়ই পরিমাণগত উৎপাদনে জোর দিতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করেছি, কিংবা সেই খাবার আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না সেগুলো সঠিকভাবে দেখা হয়নি। আবার জীনগত পরিবর্তন করে খাবারের বিশুদ্ধতা ধ্বংস করা হচ্ছে। পরিবেশের ওপর অত্যাচার করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বিষাক্ত খাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে উৎপন্ন খাদ্য ও আমিষপণ্য, বিশেষ করে মাছ, পোলট্রি ও মাংস খাতে ফিড নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এর নিরাপদ উৎপাদন নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে কি না সেটি দেখা প্রয়োজন। এসব পণ্য মানুষের কাছে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে নদীকেন্দ্রিক জলাধার থাকলেও তা মাছ উৎপাদনে সফলভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, নদীদূষণের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। ফলে এখানে আন্ত মন্ত্রণালয়ের অনেক বিষয় রয়েছে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করব।  

আপনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে বিষমুক্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আন্দোলন করছেন, কিন্তু এখনো সেটি থামছে না। সরকারের দায়িত্বে এসে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছেন?
কীটনাশক ও বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করা হচ্ছে, পাশাপাশি ক্ষতিকর পোকা দমনে কীটনাশকের ব্যবহার করতে গিয়ে উপকারী পোকা ধ্বংস করা হচ্ছে। নদীনালা কিংবা প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবেজলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীটনাশকের মারাত্মক ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করছে, প্রাণঘাতী ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের মাধমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কৃষক। বালাইনাশক আইনের কার্যকর প্রয়োগ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এমন বালাইনাশক বিক্রি, মিথ্যা তথ্যে বালাইনাশকের প্রচার বন্ধ করা প্রয়োজন।  

সার্বিক কৃষিতে নারী বড় অবদান রাখছে। কিভাবে দেখছেন কৃষিতে নারীর এই রূপান্তরকে?
আমাদের দেশের কৃষি মূলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল। একটি হলো সব ধরনের কৃষক ও খামারি হলো প্রান্তিক কিংবা ছোট। অন্যটি হলো কৃষির আনেকটাই নারীর ওপর নির্ভরশীল। কৃষিতে বিশেষ করে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে নারীদের এগিয়ে আনার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। বিশেষ করে নারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। নারীরা কৃষিতে আরো এগিয়ে এলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন আরো সহজ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কৃষিতে কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কৃষিতে নারীর অবদান বাড়ানো গেলে গ্রামীণ পরিবারগুলো দ্রুত সামর্থ্যবান হতে পারে।  

ডিম নিয়ে বাজারে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। কিভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
বন্যার প্রভাবে ডিমের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। একই সঙ্গে কৃষি ফসলও নষ্ট হওয়ার কারণে বাজারে সবজির সরবরাহ কম ছিল। ফলে ডিমের চাহিদাও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল। তাই ডিমের দাম নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই সুযোগে মুনাফা লাভের জন্য ডিমের সরবরাহে হস্তক্ষেপ করে। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার যথেষ্ট অভিযান চালিয়েছে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং পোলট্রিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২০২৪ সালে মুরগি (সোনালি ও ব্রয়লার) ও ডিমের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে। এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা সংক্রান্ত প্রণীত কৌশলপত্র অনুযায়ী উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রয়মূল্য ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (বিএবি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে তদারকি করা হচ্ছে। অন্যদকে টিসিবি এবং ট্রাকে করে ন্যায্য মূল্যে ডিম বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিমের দাম আরো কমতে পারে, যদি উৎপাদন খরচ বিশেষ করে ফিড, এক দিনের বাচ্চা ও বিদ্যুতের দাম কমানো যায়। কৃষি বিপণনের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে সীমিতভাবে ঢাকা শহরে ১১০ টাকা ডজন হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। ডিম আমদানি কোনো সমাধান নয়। দেশেই উৎপাদন বাড়িয়ে আমাদের চাহিদা মেটাতে হবে। আমদানিনির্ভর হলে দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। তখন বাইরের দেশ আমাদের ওপর খবরদারি করার সুযোগ পাবে। তাই সেই সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। খামারি ও ভোক্তা উভয়কেই আমরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করে নীতি গ্রহণ করছি।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বন্যা হয়েছে। খামারিরা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। খামারিদের কিভাবে পুনর্বাসন করা হচ্ছে?
আগস্ট মাসের বন্যায় কৃষির পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য খাতে মোট ক্ষতি এক হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। প্রাণী খাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৪২৮ কোটি টাকা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর্থিক, উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ছোট-বড় মৎস্য খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য কৃষিঋণ বিতরণকারী ব্যাংক ও এনজিওদের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিদ্যমান ঋণের কিস্তি এক বছরের জন্য স্থগিত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

খামারিদের স্বার্থ সুরক্ষায় আপনি কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
দেশের খামারিদের স্বার্থ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষক ও খামারিদের আলাদা করে দেখলে হবে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের বিদ্যুৎ বিলে কৃষির মতো ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। ডিম আমদানির যে ঘোষণা এসেছে, তা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কিছু উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আমদানি করা হলে দেশের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। জেলেদের মান উন্নয়নে অভিযান চলাকালে ভাড়া সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আগামীতে ২৫ কেজি মাসিক ভিজিএফের পরিবর্তে ৫০ কেজি এবং ২৫ কেজির পরিবর্তে ৪০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব জেলে যাতে সরকারের সুবিধা পেতে পারে তার জন্য জেলেদের তালিকা হালনাগাদ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ খামারিদের সঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের হাঁস-মুরগি পালন ও লভ্যাংশের প্রতিযোগিতার পার্থক্য কিভাবে কমিয়ে আনা যায় তার একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে। পোলট্রি খাতে এক দিনের বাচ্চার যে দাম, সেটি কয়েকটি কম্পানির হাতে সীমাবদ্ধ। বড় কম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় ছোট ও ক্ষুদ্র খামারিদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে না। তৃণমূল পর্যায়ে খামারিদের সম্পৃক্ত করে ফিডের মূল্য, এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

দেশি মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
জলবায়ুর পরিবর্তন, অতি আহরণ, ইত্যাদি কারণে দেশি মাছ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আবার চাষের মাছ উৎপাদনে আমরা ভালো করছি। আমরা শীর্ষে কিংবা অমুক চাষের মাছ ভালো করছে—এসব তথ্যে আমি মুগ্ধ না। আমাদের দেশি মাছ, হাওর-বাঁওড় ও মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো মুক্ত করব। এসব জলাশয়ে দেশি তিন শতাধিক মাছ ছিল। সেগুলো ফিরিয়ে আনতে চাই। তবে দেশি মাছ সুরক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে ৪০ প্রজাতির দেশি মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। দেশি মাছের অন্যতম প্রধান উৎস হাওরের মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য সিলেটের সাতটি জেলার হাওর অঞ্চলে কাজ করা হচ্ছে। হাওর অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ, বিশেষত দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ, টেকসই আহরণ ও জৈবিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হাওর ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান করা হচ্ছে। প্রচলিত রাজস্ব আহরণভিত্তিক হাওর ব্যবস্থাপনা থেকে বের হয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক জৈব ব্যবস্থাপনা ও কো-ম্যানেজমেন্টকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নদী ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে কৃষি ব্যাংকের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

নদীর মাছ আহরণ শূন্যের কোঠায়, প্রাকৃতিক উৎসগুলোর কিভাবে উন্নতি করবেন?
দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর দেশের জনগণের প্রাণিজ আমিষ বিশেষ করে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কাজেই এ মন্ত্রণালয়কে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, এর উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক আছে কি না। এ জন্য নদী, হাওর ও সাগরকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশদূষণ রোধে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নদীর একটি বড় সংগ্রহ ইলিশ মাছ। সাগর ও নদী মিলে বিশ্বের ৭০-৮০ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশে উৎপন্ন হচ্ছে। ইলিশ নিয়ে গর্বের পাশাপাশি আমাদের এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ অবস্থায় ইলিশের প্রজননস্থল ও অভয়াশ্রমগুলোর নিরাপত্তা ও সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও জাটকা ইলিশের সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

দেশে জিএমও নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক রয়েছে। কৃষকের স্বার্থ কি রক্ষা পাবে না?
বাংলাদেশে বিকৃত বীজ বা জিএমও প্রচলনের নানা পন্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএমও নিয়ে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় বর্তমানে ‘জিন এডিটিং’ নামের একটি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম বিতর্কিত বিকৃত বীজের খাদ্য ফসল বিটি বেগুন কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পায় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। কৃষকের হাতে চারা তুলে দেওয়া হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার কারণে ভারত ও ফিলিপিন্সে এই বেগুন কোনো অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশেও বিজ্ঞানী, পরিবেশকর্মী ও কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা তুলে ধরে প্রতিবাদ করা হয়েছিল, এমনকি কোর্টেও মামলা হয়েছিল। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ এই ফসল পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে শুধু বিতর্কিতই নয়, কৃষক পর্যায়ে চাষে সফলতা দেখাতেও চরম ব্যর্থ হয়েছে।

সম্প্রতি ফিলিপিন্স জিএমও চাল নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় কী হওয়া প্রয়োজন?
বিকৃত বেগুনবীজ বা বিটি বেগুন ছাড় দেওয়ার পর একের পর এক জিএমও ফসল দিয়ে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর কৃষিব্যবস্থাকে সর্বনাশের দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যকেও চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের কথা বলে বিটি বেগুন প্রবর্তনের সময় যেসব দাবি করা হয়েছিল তা সত্য প্রমাণিত হয়নি। তদুপরি কৃষকরা এই ফসল চাষ করে লাভবান হননি।

এখন দেশে গোল্ডেন রাইস নামের বিকৃত বীজ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঝুঁকি আছে বলেই অন্যান্য ধান উৎপাদনকারী দেশ, যেমন—ফিলিপিন্স ও ভারত কোনো অনুমোদন দেয়নি। এরই মধ্যে ফিলিপিন্সের আদালত জিএমও ফসল বাতিল করেছে। এ ছাড়া গোল্ডেন রাইস সম্পর্কে কানাডার সংগঠন কানাডিয়ান বায়োটেকনোলজি অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (সিবিএএন) একটি তথ্যচিত্র বের করেছে। তাতে বলা হয়েছে, গোল্ডেন রাইস কৃষক পর্যায়ে চাষের যোগ্য নয় এবং মানুষের খাওয়ারও উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। এতে যে বিটা ক্যারোটিন পাওয়ার কথা, তা অন্যান্য খাদ্য থেকে পাওয়া বিটা ক্যারোটিনের সমপর্যায়ের নয়। এ ছাড়া রান্নার পর এই বিটা ক্যারোটিন আরো কমে যায়।

বাংলাদেশে বিকৃত বীজের অনুমোদন পেতে হলে বায়োসেফটি প্রটোকলের ভিত্তিতে পেতে হবে। যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এ ছাড়া জিএমও কিংবা জিন এডিটিংয়ের প্রকৃত সুফল দেখানো সম্ভব হয়নি, ফলে বাংলাদেশে এটির অনুমোদন দেওয়াটা যৌক্তিক হবে না। আমরা এ বিষয়ে সার্বিকভাবে সচেতনতা তৈরি করছি। কৃষি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। তবে শস্য খাতের বাইরে আমাদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও কোনো ধরনের জিএমও, এমনকি জিন এডিটিং চাই না। বাংলাদেশে এ বিষয়ে কিছুটা অহেতুক বিনিয়োগ করা হয়েছে, বিশেষ করে বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট করা হয়েছে, যেটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।

দেশে মৎস্য ও পশুখাদ্যের মান নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। আইনগতভাবে এটি মোকাবেলা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
দেশের সব ধরনের পশু ও পশুখাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমাদের দেশের সব ধরনের খাদ্য নিরাপদ করা এই সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ জন্য আমরা যেমন নিরাপদ মাছ. মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনে জোর দিচ্ছি, তেমনি এসব পণ্য উৎপাদন করতে গেলে পশু ও মৎস্যখাদ্য নিরাপদ হওয়াও প্রয়োজন। এ জন্য মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ (২০১০ সালের ২ নম্বর আইন)-এর ধারা ২২-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মৎস্যখাদ্য বিধিমালা, ২০২৪ জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। বিধিমালায় লাইসেন্সের জন্য আবেদনের পদ্ধতি, ক্যাটাগরিভিত্তিক লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তাবলি, লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি ও আপিল ফি, মৎস্যখাদ্যে ব্যবহৃত উপকরণসমূহ, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের আদর্শ মাত্রা/পুষ্টিমান নির্ণয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি ও বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। এই বিধিমালা কার্যকর করার মাধ্যমে আমরা মৎস্য খাতে একটি টেকসই উন্নয়নের পথ তৈরি করতে চাই, যা মৎস্য খাতকে আরো সমৃদ্ধ করবে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিধিমালার আলোকে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। এই বিধিমালায় মৎস্যখাদ্য কিংবা মৎস্যখাদ্যের উপকরণ তৈরিতে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশককে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কোনো মৎস্যখাদ্য বা মৎস্যখাদ্যের উপকরণে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করলেই কারখানা বা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা যাবে।

জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে আমরা কি সঠিক পথে আছি?
সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। তার নানামুখী প্রভাব রয়েছে। এর জন্য আমাদের উপযুক্ত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। কিন্তু এখন যেসব ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার বলা হচ্ছে, সেগুলো মূলত ক্লাইমেট ধ্বংসকারী অ্যাগ্রিকালচার। কারণ এখানে যান্ত্রিকীকরণের কথা বলে আরো বেশি রাসায়নিক দ্রব্য ও কীটনাশক ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যখন কার্বন নিঃসরণের কথা বলা হয়, তখন গাড়ি বা শিল্পায়নের অন্যান্য বিষয় চলে আসে। ইউরোপ-আমেরিকায় মাংস উৎপাদনের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে; এমনকি ব্রাজিলে আমাজন জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে । তাই পরিবেশ সুরক্ষায় আরো সচেতন হতে হবে। হাওরে হিজলগাছ, সুন্দরবনে কেওরড়া, বাইন, কড়ইগাছ, আবার বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য তালগাছ লাগাতে হবে। খরাপ্রবণ এলাকা, হাওর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কোন ধরনের গাছ লাগাতে হবে, তার জন্য শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় বাধা শিল্প-কারখনার দূষণ। নদী ও সমুদ্রে দূষণ হচ্ছে। মাছের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকস পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে আরো কঠোর হতে হবে।  

পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে নানা ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সেগুলো কিভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব?
জলবায়ু বা পরিবেশ নিয়ে কথা বললে শুধু পরিবেশবিদ বা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে কেন জানি না ধরা হয়। ভবিষ্যতে জলবায়ু সম্মেলনে শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো আরো মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিনিধি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সিলেটে বন্যার কারণে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুপাখি এবং অন্যান্য প্রাণীও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। ফলে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিগত সরকারের সময় অনেক জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। পরিবেশগত ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ তৈরি করছে গোল্ডেন রাইস ও জিংকসমৃদ্ধ চাল। জিংকের ঘাটতি আছে কি না তা না দেখে এই চাল খাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? আমি গোল্ডেন রাইসের বিরোধিতা করছি। আমাদের জিংকের ঘাটতি পূরণে অনেক খাবার আছে। সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে। শস্য ও পুষ্টিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে কীটনাশক দিয়ে ক্ষতি করছি। দেশি মাছকে গুরুত্ব না না দিয়ে চাষের মাছেকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গরুকে ঘাস খাওয়ানোর কথা, অথচ গরুকে অন্য কিছু খাওয়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।