ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

লবণাক্ততা

উপকূলের লবণাক্ততা মোকাবিলায় রিলে প্রযুক্তি

ড. এম জি নিয়োগী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
উপকূলের লবণাক্ততা মোকাবিলায় রিলে প্রযুক্তি গ্রাফিতি

বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগই উপকূল অঞ্চল। উপকূলের চার লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর (প্রায় ১১ লাখ একর) জমি বছরের শুষ্ক মৌসুমে অনাবাদি থাকছে।

শুধু বৃষ্টির মৌসুমে এসব অঞ্চলে আমন ধান হয়। ডিসেম্বর মাসে আমন ধান কেটে নেওয়ার পর শুষ্ক মৌসুমে বছরের প্রায় ছয়-সাত মাস জমি পতিত থাকে।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শুষ্ক মৌসুমে উপকূলে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা, সেচযোগ্য পানির অভাব এবং উপকূলের বেশ কিছু অঞ্চলে পানি নেমে যেতে না পারার কারণে জলাবদ্ধতার জন্যই এই বিশাল পরিমাণ জমি পতিত থাকছে।

উপকূলের লবণাক্ততা মোকাবেলায় রিলে প্রযুক্তিউপকূলের এই বিস্তীর্ণ লবণাক্ত পতিত জমিতে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী লাভজনক উপায়ে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চের (এসিআইএআর) সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে উপকূলের দুর্গম অঞ্চলে গবেষণা করে আসছি। এই গবেষণায় আমার নেতৃত্বে পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রগ্রাম সরাসরি সম্পৃক্ত। গবেষণায় সহযোগিতা করছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট।

যেহেতু উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সেচযোগ্য পানির অভাবের কারণে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না, সে কারণে এইসব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে গম উৎপাদনের জন্য গবেষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
কেন উপকূলে গম
গম প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা লবণাক্ততাসহিষ্ণু। তা ছাড়া উপকূলে প্রচুর অনাবাদি জমি। এ ছাড়া এই ফসল চাষাবাদে খুব কম পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়।

গম নিয়ে গবেষণার আরেকটি কারণ হলো—বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে দেশে গমের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু গম চাষের জমি বাড়ছে না। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা। দেশে উৎপন্ন হচ্ছে মাত্র ১১-১২ লাখ টন। বাকি ৬০-৬৫ লাখ টন গম বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে।

এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ শুধু গম আমদানিতেই চলে যাচ্ছে। সে জন্য গমের এই বিপুল পরিমাণ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে গম উৎপাদনের জন্য গবেষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
রিলে প্রযুক্তি কী
উপকূলের লবণাক্ততা মোকাবেলায় রিলে প্রযুক্তিরিলে প্রযুক্তি হচ্ছে জমিতে একটি ফসল আধাপাকা অবস্থায় থাকতেই ওই জমিতে আরেকটি ফসলের চাষ। বাংলাদেশে গম বোনার প্রকৃত সময় নভেম্বর মাস। কিন্তু ওই সময় জমিতে আমন ধান আধাপাকা অবস্থায় থাকে। তা ছাড়া গম ঠাণ্ডা আবহাওয়া পছন্দ করে। ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গম ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালো মানের গমের ছড়া বের হতে সহায়ক হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে শীতকালের সময় কমে গেছে। উপকূল অঞ্চলে শীতকাল আরো কম। সে জন্য মধ্য নভেম্বরে বাংলাদেশের উপকূলের জমিতে গমবীজ বুনলে জানুয়ারি মাসের অনুকূল ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভালো মানের গমের ছড়া বের হবে এবং গম ভালো ফলন দিতে পারবে। কিন্তু নভেম্বর মাসে উপকূলের জমিতে আমন ধান আধাপাকা অবস্থায় থাকে, যা কৃষকরা ডিসেম্বর মাসে কেটে থাকেন। তাই সঠিক সময়ে গমবীজ বোনার লক্ষ্যে জমিতে ধান ফসল আধাপাকা অবস্থায় থাকতেই মধ্য নভেম্বরে ধানের জমিতে গমবীজ ছিটানো হয়েছে। এটিই রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ প্রযুক্তি।

ফলে সঠিক সময়ে অর্থাৎ মধ্য নভেম্বরে গমবীজ বোনার কারণে জানুয়ারি মাসে গমের জন্য অনুকূল আবহাওয়ায় প্রচুর ভালো মানের গমের ছড়া বের হয়েছে। এতে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। নভেম্বর মাসে জমিতে লবণাক্ততা কম থাকে বা অনেক সময় থাকেই না। সে জন্য জমিতে গমবীজ উপযুক্ত পরিবেশে ভালোভাবে গজাতে পারছে।  নভেম্বর মাসে বেশির ভাগ জমিতে আর্দ্রতা থাকে বিধায় গম জমি থেকে প্রয়োজনীয় রস পাচ্ছে। মূলত এই তিনটি কারণেই উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষে অসামান্য সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে।

রিলে প্রযুক্তিতে জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না বিধায় উৎপাদন খরচও অনেক কম, যা পরিবেশ সহায়ক। আবার রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষাবাদে পানির প্রয়োজন আরো কম। গমে মাত্র তিনবার হালকা সেচ দিলেই যথেষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো না কোনো সময় বৃষ্টি হচ্ছে, যা গমের জন্য ভালো। এ সময় হালকা বৃষ্টি হলে গমে সেচের প্রয়োজন আরো কমে যায়। রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষাবাদের জন্য অবশ্যই স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ জন্য ব্রি এবং বিনা উদ্ভাবিত স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের জাতগুলো কৃষকরা ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই কাটতে পারবেন। এর ফলে আমন ধানের জমিতে গমের চারা ছোট থাকতেই ধান কাটা হয়ে যাবে। ধান কাটার পর জমিতে রিলে গমের চারাগুলো আলো-বাতাস পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতের সময়কাল কমে যাওয়ায় এবং বাংলাদেশের উপকূলে গম বোনার উপযুক্ত সময় মধ্য নভেম্বর। মধ্য নভেম্বরে গমবীজ বুনলে জানুয়ারির উপযুক্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় গমে ভালো ছড়া হবে এবং ভালো ফলন নিশ্চিত হবে।

শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের জমিতে লবণাক্ততা মার্চ মাসে অনেকটাই বেড়ে যায়। সে কারণে রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষে স্বল্পমেয়াদি গমের জাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ জন্য বারি গম ৩০ স্বল্পমেয়াদি জাতকে উপকূলে চাষাবাদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদি লবণাক্ততাসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল গমের জাত পাওয়া গেলে উপকূলে রিলে প্রযুক্তিতে গমের ফলন আরো বেশি হবে। স্বল্পমেয়াদি গমের বীজ মধ্য নভেম্বরে রিলে পদ্ধতিতে বুনলে ফেব্রুিয়ারি শেষে এই ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। অর্থাৎ মার্চের অতিরিক্ত লবণাক্ততার আগেই ফসল কাটা সম্ভব হচ্ছে। জমিতে লবণাক্ততা বাড়ার আগেই ফসল ঘরে আসবে। এতে গমের ওপর লবণাক্ততার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা একেবারেই থাকছে না।
 
উপকূলে রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষাবাদে সেচের পানি প্রাপ্তির উপায়
রিলে প্রযুক্তিতে গমে মাত্র তিনবার হালকা সেচ দিলেই যথেষ্ট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, উপকূল অঞ্চলে তিন লাখ ৪৭ হাজার ৬৭১টি পুকুর বা জলাধার আছে, যার আয়তন ৩৭ হাজার ৫৩০ হেক্টর। এই পুকুরগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করলে তিন লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষ সম্ভব। শুধু তিন লাখ ৪৭ হাজার ৬৭১টি পুকুর বা জলাধার সংস্কার করেই উপকূলের চার লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর পতিত জমির মধ্যে তিন লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ হেক্টর পতিত জমিতে কৃষক রিলে প্রযুক্তিতে গম আবাদ করে একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন এবং সেই পুকুরগুলোতে ছয় মাস মাছ চাষ করতে পারবেন। অর্থাৎ উপকূলের ৮৫ শতাংশ পতিত জমিতে শুষ্ক মৌসুমে পুকুর বা জলাধার সংস্কার করেই একটি অতিরিক্ত ফসল ফলানো সম্ভব। ওই পুকুরের পানি যাতে চুইয়ে নিচে চলে না যায়, সে জন্য পুকুরের তলদেশে একটি মোটা পলিথিন বিছিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করবেন। তাহলে ওই বৃষ্টির পানিতে ছয় মাস মাছ চাষ সম্ভব এবং ওই পানি দিয়ে বাকি ৯০ শতাংশ জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম উৎপাদন সম্ভব।

এ ছাড়া আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের লবণাক্ত জমির ঠিক নিচেই যে পানির স্তর আছে, তা লবণাক্ত এবং কোনোভাবেই সেচযোগ্য নয়। কিন্তু এইসব জমির ১১০০ থেকে ১২০০ ফুট গভীরের পানি লবণাক্ততামুক্ত এবং সেচযোগ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পানির লবণাক্ততা ০.৫ ডিএস/মিটারের কম, যা শুধু ফসল চাষাবাদেই নয়, খাওয়ারও যোগ্য। সাবমার্সিবল পাম্পের সাহায্যে ১১০০ ফুট বা তারও নিচের পানি উত্তোলন করা সম্ভব। সম্পূর্ণ পাম্পটি কিনতে এবং বসাতে এক লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এ ধরনের একটি পাম্প দিয়ে ৫০ বিঘা জমিতে অনায়াসে রিলে প্রযুক্তিতে গমের চাষাবাদ করা যাবে। এর থেকে নিরাপদ খাওয়ার পানিও পাওয়া যাবে। রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষের ফলে কৃষক একদিকে যেমন আমন ধানের পরে একটি অতিরিক্ত ফসল ঘরে তুলতে পারছেন, অন্যদিকে রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষের কারণে ওই জমির লবণাক্ততাও কমে যাচ্ছে—যা উপকূলের লবণাক্ত জমিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে!

আমন ধান কাটার পর জমিতে চাষাবাদ না হওয়ার কারণে অর্থাৎ জমি পতিত থাকার কারণে শুষ্ক মৌসুমে জমি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলের মাটিস্থ লবণ ইভাপোট্রান্সপিরেশনের মাধ্যমে (capillary movement of salt) জমির ওপরের দিকে চলে আসে এবং মাটিকে অনেক বেশি লবণাক্ত করে দেয়। কিন্তু রিলে গম প্রযুক্তিতে জমিতে আমন ধান থাকতে থাকতেই রিলে গম চাষের ফলে জমি শুকিয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকে না বিধায় মাটিস্থ লবণও জমির ওপরের দিকে আসার সুযোগ পায় না। ফলে জমিকে বেশি লবণাক্ত করতে পারে না।

রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষের ফলে জমির লবণাক্ততা ক্রমহ্রাসমান হওয়ার কারণে উপকূলের কৃষক গমের পরে আরো একটি ফসল বোরো ধানও করতে পারবে। আমন ধানের পরে রিলে গম চাষের ফলে জমির লবণাক্ততা কমে যাওয়ার কারণে কৃষক গম কাটার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি বোরো ধানও করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বোরো ধানের জমিতে সেচযোগ্য পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আমরা আশা করছি, উপকূলের কৃষক রিলে প্রযুক্তিতে গম চাষের ফলে ক্রমহ্রাসমান লবণাক্ততার কারণে এই বোরো ধান থেকেও ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন। অর্থাৎ রিলে পদ্ধতিতে গম উৎপাদনের ফলে উপকূলের জমিতে লবণাক্ততা কমে যাওয়ার কারণে উপকূলের কৃষক তিনটি ফসল, অর্থাৎ আমন ধান-রিলে গম-বোরো ধান করতে পারবেন এবং ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন। বিগত সব সরকারের আমলেই উপকূলের মানুষ সীমাহীন বৈষম্যের শিকার। উপকূলের কৃষক আশা করে, বর্তমান বৈষম্যবিরোধী অন্তর্বর্তী সরকার এই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি জাতীয় কার্যক্রমে গ্রহণ করে উপকূলের কৃষকদের একফসলি জমিকে দুইফসলি জমিতে রূপান্তর করতে সহায়তা করবে এবং সেই সঙ্গে উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক অবদান রাখবে।

লেখক: ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (এসিআইএআর), ইউনির্ভাসিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।