স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৬০ শতাংশ, যা বর্তমানে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কৃষিতে উৎপাদন নির্ভর করে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, রৌদ্রময় দিনের দৈর্ঘ্য—জলবায়ুবিষয়ক এমন সব কারণের ওপর।
বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন, কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এবং বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্ব ও বাংলাদেশের জন্য বিশাল হুমকি। ধারণা করা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের যতটুকু এলাকা তলিয়ে যাবে, তার মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ হবে ৩০ শতাংশ।
দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি মানুষ রয়েছে। প্রতিবছর ২২-২৫ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে; অন্যদিকে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরিসহ নানা কারণে চাষের জমি কমছে।
এ দুই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। এসব বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা ও শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সে জন্য মাটি সজীব রাখতে হবে, মাটির গুণাগুণ বজায় রাখতে হবে।
মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আর্দ্রতা হ্রাসের ফলে মাটির অণুজীবগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্র ব্যাহত করে ফসলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি কমিয়ে ফেলে।
মাটির জৈব পদার্থ দ্রুত ভেঙে যাওয়ার কারণে মাটির কাঠামো, পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কমছে। উচ্চ তাপমাত্রায় গাছের প্রস্বেদনক্ষমতা কমে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের এক দুষ্টক্ষত অসময়ে অনেক বেশি বৃষ্টি। অসময়ের অযাচিত দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা ধান ও অন্যান্য ফসল ফলনে কৃষককে নিরাশ করে। ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তিত ধরন মাটিক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মাটিতে অম্লতা বৃদ্ধি ফসলের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির পুষ্টি উপাদান, বিশেষত ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান কমে যায় এবং চাষের ব্যয় বৃদ্ধি করে।
কৃষিতে জলবায়ুর বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন অভিযোজন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ু চাপ সহনশীল প্রযুক্তি, বীজ, সার, সেচ, কৃষিবিষয়ক তথ্য এবং তাদের সম্প্রসারণ গবেষণা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ইতিবাচক অভিযোজক হিসেবে কাজ করে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে বাড়ছে যে উষ্ণতা, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বৃদ্ধি কমাতে সেই জ্বালানির ব্যবহার নির্ভরতা কমানো ছাড়া উপায় নেই। কৃষিকে টেকসই অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে সহনশীল জাত উন্নত করা জরুরি। একাধিক শস্য চাষের মাধ্যমে সমতা আনা; যেমন—ধান, গমের পাশাপাশি শাকসবজি, ডাল চাষ কৃষককে নিরাপত্তা দেবে। সরকারি ভর্তুকি বৃদ্ধির মাধ্যমে আধুনিক কৃষি উপকরণ কৃষকের নাগালে আনার ব্যবস্থা, কৃষি-প্রযুক্তি তাদের জন্য সহজলভ্য করা।
জলবায়ুর পরিবর্তন কৃষিক্ষেত্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে যুবসমাজের অংশগ্রহণ জরুরি। আমরা তরুণরা কৃষিজমি রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে কৃষক ও জনসাধারণকে শিক্ষিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, কমিউনিটি ওয়ার্কশপ, সেমিনারের পরিকল্পনা করে টেকসই কৃষির প্রচার করতে পারি।
মাটির উর্বরতা বাড়ানো, মাটির সুরক্ষা, মাটি ও জৈব পদার্থ সংরক্ষণে জৈব সার ও অন্যান্য জৈব উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে উপকার পাওয়া সম্ভব। তরুণরা জলবায়ু সহনশীল কৃষি অধ্যয়নে অবদান রাখতে পারে। নতুন পদ্ধতি এবং ফসলের প্রকারগুলো খুঁজতে, শ্রেণিকরণ করতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করা সম্ভব। উচ্চ তাপমাত্রার খরা, লবণাক্ততা, রাতের তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন জাত উদ্ভাবনের প্রয়োজন। আমরা নীতি সমর্থন, টেকসই কৃষি আইন এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষকদের জন্য কাজ করব। কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে এবং তাদের সম্প্রদায়ের কাছে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে তরুণদের জন্য শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।
সুস্থ মাটির একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে মাটির জীববৈচিত্র্য। এই জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে পারলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, আর মাটি সুস্থ থাকলেই কেবল নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। দেশে মাটির গুণাগুণ ধরে রাখতে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটকে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমি, পাহাড়ি এলাকার সমস্যাক্লিষ্ট জমিকে চাষের আওতায় আনতে হবে। ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে শস্য চাষের পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে হবে।
লেখক: চতুর্থ বর্ষ, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫