২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এক নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটিই স্মরণীয় ঘটনার দিন।
অন্যটির নায়ক দেশের ছাত্র-জনতা। পরিচিতি লাভ করে ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে। ওয়ান-ইলেভেনের নায়ক মইন উ আহমেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী। বিএনপি ও মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছাড়া সবাই তখন তাদের স্বাগত জানিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ও তখনকার সুশীল সমাজ গর্ব করে বলত, ওয়ান-ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল। জুলাই বিপ্লবে ঘটল এর উল্টো। এ ঘটনার নায়ক ছাত্র-জনতা। আওয়ামী লীগ ও মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছাড়া দেশবাসী এ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে।
আর এ বিপ্লবকে সমর্থন করেছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তবে দুটি ঘটনার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন- দেশটা হবে জনগণের এবং দুর্নীতিমুক্ত। প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন। মানুষের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার থাকবে সুরক্ষিত। শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের যা পরিণতি হয়েছিল এবং বিগত ১৮ বছর দেশবাসীর কপালে যা জুটল, তা যেন চুন খেয়ে মুখ পুড়ে দই দেখে ভয় পাওয়ার মতো অবস্থা।
অনেকেই ওয়ান-ইলেভেন সরকারের পোস্টমর্টেম করেছেন অনেকভাবে। সাধারণত তিন সময়ে এবং তিনভাবে এটি করা হয়েছে। ঘটনা ঘটার আগে কেউ কেউ এমন একটি সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। সে কারণে পরবর্তীতে দাবি করা হয়েছিল, ওই সরকার ছিল তাদের সরকার। ওই সরকারের শাসন চলাকালে অনেকেই সফলতার কথা আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন। তাদের অদক্ষতা, অসততা ও জাতির সঙ্গে প্রতারণার কথা কেউ সাহস করে বলেননি। তবে বিদায়ের পর আবার কেউ কেউ ব্যর্থতার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজ ছিল ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করার মতো ঘটনায় ওই সরকারের প্রতি তখন সাধারণ মানুষের ভীতি তৈরি হয়। এ সরকারের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব-এমন একটি ইমেজও তৈরি হয়েছিল। সেই সঙ্গে মাইনাস টু ফর্মুলার উদ্ভাবকরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলেন। তবে দেশের প্রয়োজনীয় সংস্কার, রাজনীতির অরাজনৈতিক কার্যক্রম ও দুর্নীতি বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সব সুযোগ এবং জনসমর্থন ওই সরকার পেয়েছিল। সুবর্ণ সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়েও কাজের চেয়ে অকাজে জড়িয়ে পড়ায় মানুষ দিনদিন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে মাত্র আট মাসের মাথায় ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছাত্রদের খেলা কেন্দ্র করে ছাত্র ও সেনাসদস্যদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেনাসদস্যরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম সেনাসদস্যদের দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার হন। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ২১, ২২ ও ২৩ আগস্ট সারা দেশে সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ইস্যুতে জনরোষ বাড়তে থাকে। যা হোক, পরের ঘটনা কমবেশি সবারই জানা। একটি ইতিবাচক পরিবর্তন অর্থাৎ সংস্কার করার যে সুযোগ ওই সরকার ও সেনাবাহিনী পেয়েছিল, বেলা শেষে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়। প্রকাশিত হতে থাকে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অংশীজনদের অদক্ষতা, অসততা ও জাতির সঙ্গে প্রতারণার ভয়াবহ সব কাহিনি। তারা এত বেশি অপকর্ম করেছিল যে, ওয়ান-ইলেভেনের সুবিধাভোগী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও কোনো কুশীলব দেশে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারেননি। বাধ্য হয়ে মইন উদ্দিন, ফখরুদ্দীনসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই দেশ ছাড়েন। আর যারা দেশের মধ্যে ছিলেন তাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে নিজেদের রীতিমতো গুটিয়ে রেখেছেন। চলে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। ‘ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব’ কথাটি এখন দেশবাসীর কাছে গালি হিসেবে বিবেচিত। আর যারা মাইনাস টু ফর্মুলার উদ্ভাবক ছিলেন, তারা এখনো গণধিকৃত হয়ে আছেন।
দীর্ঘ ১৮ বছর পর আরও একটি সুযোগ আমরা পেলাম। ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আমরা আমজনতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতা-কর্মী ছাড়া প্রায় সবাই ছাত্র-জনতাকে শাবাশ দিয়েছে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। মিষ্টি বিতরণ করেছে। সুযোগ থাকার পরও বন্দুক হাতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি। বরং বিপ্লবী ছাত্র-জনতা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফুল দিয়ে বরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। প্রথমে তিনি এ গুরুদায়িত্ব নিতে রাজি হননি। দায়িত্ব গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্ববাসী ও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমি তখন প্যারিসে ছিলাম। আরেকটি সুযোগ কি হাতছাড়া হচ্ছে!অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে কাজ করছিলাম। ঠিক সে সময়ই প্রথম ফোন আসে। আমি তখন হাসপাতালে ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তি ছিলাম। ফোনে বলা হয়, শেখ হাসিনা চলে গেছেন, এখন আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য সরকার গঠন করুন। আমি বললাম, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না এবং এতে জড়াতে চাই না। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বারবার অনুরোধ জানায়। তারা বলে, দেশের সংকট মুহূর্তে আপনিই উপযুক্ত ব্যক্তি। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বাংলাদেশে অনেক ভালো নেতা আছেন, তোমরা কাউকে খুঁজে নাও। কিন্তু তারা বলল, না, আমরা কাউকে পাচ্ছি না। আপনাকেই আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের আত্মত্যাগের কথা ভেবে রাজি হই। ’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট সহজসরল শিশুর মতো তিনি একাধিকবার দেশে-বিদেশে বলেছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে বিশ্ববরেণ্য এ মানুষটি হয়তো আজ জেলখানায় থাকতেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অকুণ্ঠ আস্থায় মহান আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন। এ মহান ব্যক্তিত্ব দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশবাসীর প্রত্যাশা হয়েছিল আকাশচুম্বী। জনসাধারণের মধ্যে ‘এবার দেশের কিছু একটা হবে’ এমন ইতিবাচক আশাবাদ কাজ করছিল। ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণ করতে তিনি তাঁর পারিষদ গঠন করলেন। কিন্তু পারিষদবর্গ দেখে সচেতন দেশবাসী প্রথমেই একটু হোঁচট খেল। থ্রি-জিরো তত্ত্ব দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেখানে পৃথিবীকে নতুন আলোয় আলোকিত করছেন, সেখানে এ পারিষদ দিয়ে তিনি কি নিজের দেশটা বদলাতে পারবেন-এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। প্রশ্নটা প্রথমে দেশের মুষ্টিমেয় কিছু বোদ্ধাজনের মধ্যে জন্ম নিলেও গত ছয় মাসে বিস্তৃত হয়ে এখন অনেকের মধ্যেই কাজ করছে। চিন্তা-চেতনায়, দক্ষতায়, জ্ঞান-গরিমায়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুখ্যাতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে উচ্চতায় রয়েছেন, তাঁর পারিষদের সদস্যরা সে তুলনায় কতটা খর্বাকৃতির, গত ছয় মাসে তাঁদের কার্যকলাপে নিজেরাই প্রমাণ করেছেন। আমরা যদি তর্কের খাতিয়ে ধরে নিই, দেশটা সংস্কার করে গড়ে তোলার জন্য এর চেয়ে যোগ্য মানুষ পাওয়া যায়নি, তাহলে সেটা ১৭ কোটি মানুষের দুর্ভাগ্য। তবে এও ঠিক, পারিষদের সদস্যরা তাঁদের নিজস্ব কাজের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে অবশ্যই সফল ছিলেন।
জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্রদের বিশেষ করে সমন্বয়কদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা ছিল ঈর্ষণীয়। দেশের বহু মানুষ সমন্বয়কদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। বহু মানুষ তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকের প্রোফাইল বানিয়েছেন। অনেক পিতা-মাতা তাঁদের ছোট ছোট সন্তানকে সমন্বয়কদের ছবি দেখিয়ে বলেছেন, বড় হয়ে এমন বিপ্লবী ও সাহসী হবে। জুলাই বিপ্লবের পর দেশের অনেক স্থানে মারামারি, বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যে কোনো একজন সমন্বয়ক সেখানে ছুটে গেলেই থেমে যেত মারামারি বা বিশৃঙ্খলা। কিন্তু ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আমরা দেখলাম, জুলাই বিপ্লবে আহতরা মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে মধ্যরাতেই সেখানে ছুটে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি আহতদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা না দেওয়াকে সরকারের ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেন। তবে ঘটনাস্থলের যে বিষয়টি গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে তা হলো, কয়েক মাস আগেও হাসনাত আবদুল্লাহকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হতো এখন সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বিপ্লবের সঙ্গীরাই তাঁকে চ্যালেঞ্জ করছেন।
বিপ্লবীরা এখন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজে ব্যস্ত। হয়তো আগামী সপ্তাহেই তাঁদের দলের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। তারপর হবে নির্বাচনের রোডম্যাপ। সবাই মিলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা ফেরাতে বিপ্লবীরা রাজনীতিতে আসছেন। তাঁদের এ উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। শুধু ভেবে দেখার বিষয় হলো, সরকার ও বিপ্লবীদের ইমেজ ছয় মাসের মধ্যে যেভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে, নির্বাচন পর্যন্ত সে গতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে। সরকারের ব্যর্থতার কথা বিপ্লবীরাই এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যর্থতা যদি দিনদিন আরও প্রকট হয় এবং নির্বাচনে বিপ্লবীরা যদি আশাহত হন, তাহলে দেশ গঠনের আরও একটি সুযোগ হাতছাড়া হবে কি না ভাববার বিষয়। কারণ সম্মান ও সমৃদ্ধি অর্জন করার চেয়ে ধরে রাখা অনেক কঠিন।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৫