ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৫ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

শিল্পবাণিজ্য ধ্বংস হচ্ছে কার স্বার্থে

মন্‌জুরুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২৫
শিল্পবাণিজ্য ধ্বংস হচ্ছে কার স্বার্থে মন্‌জুরুল ইসলাম

ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এখন সবকিছু নতুন করে শুরু করছি। রাষ্ট্র সংস্কার করছি।

সবকিছুর লক্ষ্য, সবার অধিকার নিশ্চিত করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এ কঠিন কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এখন পর্যন্ত দেশবাসীর পূর্ণ আস্থা আছে। কারণ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এ সরকারের সফলতা অর্জন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। সরকার ইতোমধ্যে অনেক সমস্যার সমাধান দিতে সচেষ্ট হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দুটি সমস্যা সরকারকে বিব্রত করছে। একটি হলো আইনশৃঙ্খলা এবং অন্যটি অর্থনৈতিক স্থবিরতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিভিন্ন বাহিনী আছে। তারা কাজ করছে। অর্থনীতি গতিশীল করতে কার্যত তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি বেসরকারি বিনিয়োগকারী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাচ্ছেন না। গত সাত মাসে বেসরকারি পর্যায়ে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। স্বভাবতই বেসরকারি পর্যায়ে কোনো কর্মসংস্থানও হয়নি। একের এর এক কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোনো শিল্প উদ্যোগ নেই। ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে তাদের সমস্যার কথা বলছেন। সরকারের কাছে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনছেন না। সমস্যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অথচ অর্থ উপদেষ্টা নিজেই বলছেন, দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারে। মুক্ত বাংলাদেশে এখন আমাদের শিল্প যদি ধ্বংস হয়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা যদি টিকে থাকতে না পারেন, তাহলে লাভবান হবে প্রতিবেশী ভারত। এ অবস্থায় প্রশ্ন হলো-কার স্বার্থে দেশের শিল্পবাণিজ্য ধ্বংস হচ্ছে? কার স্বার্থে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রতিপক্ষ বানানো হচ্ছে?

স্বাধীনতার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার পর্যন্ত অর্থনীতি বোদ্ধা ব্যক্তি এ সরকারে বেশি। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস অর্থনীতির একজন পণ্ডিত এবং গোটা পৃথিবীতে সামাজিক ব্যবসা প্রবর্তন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থনীতির দিকপাল। তাদের অর্থনীতিতে জ্ঞান দেবে, এমন ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে বলে মনে করি না। তাদের বহু ছাত্র সারা পৃথিবীতে অর্থনীতির দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তার পরও দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কেন দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে? কেন তারা যথাযথ সহায়তা, নিরাপত্তা, প্রণোদনা ইত্যাদি পাচ্ছেন না? ব্যবসায়ী শ্রেণিকে বাদ দিয়ে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হবে না, এটা তো সবাই জানে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল, তাতে সরকার ও তার দোসরদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জমাখরচ না দিয়ে কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব হয়েছে কি না, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। নানা চাপে পড়ে ব্যবসায়ীদের অনেক কিছুই করতে হয়েছে, সেটা তো এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তারা সবাই অনুধাবন করছেন। তার পরও ব্যবসায়ীরা রীতিমতো কোণঠাসা অবস্থায় আছেন। বিগত সময়ে সরকারের পক্ষে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর নানাভাবে অনৈতিক চাপ তৈরি করা হয়েছিল। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চাপে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও প্রতিশ্রুতি প্রদানে বাধ্য করা হতো। চাপে ফেলে আদায় করা হতো সমর্থন ও আনুগত্য। সেই সিন্ডিকেটের পালের গোদা সালমান এফ রহমান জেলখানায় থাকলেও ফ্যাসিস্ট সরকারের উল্লেখযোগ্য দোসর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল), অর্থ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিবগণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদার, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর মতো মহারথীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। বিগত সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব ব্যবসায়ী বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের অনেকের মধ্যে একজন ছিলেন মন্ত্রী সাইফুজ্জামান। লন্ডনে তার ৩৬০টি বাড়ির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট করেছেন এস আলম। যারা দেশ লুট করে বিদেশে পালিয়েছেন, তারা এখন মহানন্দে ও নিরাপদে আছেন। আর যারা দেশের মধ্যে শিল্পকারখানা তৈরি করেছেন, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অনেক শিল্পপতির শ্রমে-ঘামে গড়া শিল্পকারখানা এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন কোনো বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। ফলে আগ্রহও হারাচ্ছেন। শুধু রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নির্ভর করে জাতীয় অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না। সে কারণে সব ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে সঙ্গে নিয়ে পথচলা উচিত।

...এখন রমজান মাস। রমজান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো, রা-মিম-দোয়াদ। আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম, কঠোর সূর্যতাপ, দহন, জ্বলন, তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া। রমজানে যেহেতু নেক আমলের কারণে বিগত সময়ের সব গুনাহ বা পাপ বিমোচিত কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়, সেজন্যই এ মাসের নাম রমজান। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমজান। এ মাস তাই সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই চায় কীভাবে এ মাস থেকে বেশি বেশি উপকৃত হওয়া যায়। সবাই আন্তরিকভাবে কামনা করে নিজেকে সব রকম পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে পবিত্র একটি জীবন শুরু করতে। রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘রোজা একান্তই আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেব। ’

এমন একটি বরকতময় মাস, অথচ চারদিকে তাকালে আত্মশুদ্ধির কোনো আলামত লক্ষ করা যায় না। গোটা পৃথিবীতে বিধর্মীরাও রোজা এবং রোজদারকে সম্মান করে। খাদ্যপণ্য থেকে বিভিন্ন নিত্যপণ্যে বিশেষ ছাড় দেয়। অথচ আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টো। এ দেশে রোজা হলো একটি ব্যবসার মৌসুম। যে যেভাবে পারে রোজা নিয়ে ব্যবসা করে। ৫ টাকার লেবু হয়ে যায় ২০ টাকা। ৫০ টাকার শসা হয়ে যায় ১০০ টাকা। বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় অনেক অত্যাবশ্যক পণ্য! ইফতারের খাবারে দেওয়া হয় ভেজাল। মোট কথা এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম রোজায় বাড়ানো হয় না। অভিজাত শপিং মল, ছোট মার্কেট, ফুটপাতের ব্যবসায়ী সবার একই কথা-রোজা সেজন্য দাম বেশি। যাদের টাকা আছে, তাদের জন্য পণ্যের দাম কমবেশিতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য রোজায় নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য রীতিমতো আজাবের মতো। রোজা শুরুর কমপক্ষে এক মাস আগে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার যদি বৈঠক করত এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হতো, সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে এর সুফল পাওয়া যেত। কারণ দেশের সব ব্যবসায়ী এ সরকারের সাফল্য কামনা করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের জন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবীরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নতুন প্রজাতন্ত্র গড়ার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন এবং নতুন সংবিধান প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আকাক্সক্ষা পূরণে কাজ করবে জাতীয় নাগরিক পার্টি।

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র অধরা থেকে গেছে। এনসিপি এ মূলমন্ত্র বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। ডান-বামের বাইনারির মধ্যে না গিয়ে, মধ্যপন্থি দল হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে তাদের দল।

নতুন দলের নেতৃবৃন্দ যে অঙ্গীকারই ব্যক্ত করুন না কেন, তাদের ওপর দেশবাসীর যে আস্থা এখন পর্যন্ত আছে, এর ওজন অনেক বেশি। নতুন দেশ গড়ার জন্য তারুণ্যকে দেশবাসী বিশেষ আস্থায় গ্রহণ করেছে। বিপ্লবীরা কী করতে পারেন তা ৫ আগস্ট দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। গোটা দেশ বিপ্লবীরা এক মোহনায় মিলিত করিয়েছিলেন। বিদায় করেছিলেন ফ্যাসিস্ট সরকারকে। জাতীয় নাগরিক পার্টির ২১৭ সদস্যের সবাই ছিলেন বিপ্লবের প্রথম সারির যোদ্ধা। আরও হাজার হাজার যোদ্ধা ছিলেন তাদের সহযোগী। অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবীদের রক্ত-ঘামের ফসল। এ সরকার সফল হলে বিপ্লবীদের মুখ উজ্জ্বল হবে। আর ব্যর্থ হলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন বিপ্লবীরা। হাজারো শহীদ আর হাজার হাজার আহতের স্বপ্ন পূরণ হবে না। এখন বিপ্লবীদের দলের অন্যতম কাজ হলো সরকারের সফলতার জন্য কাজ করা। নানা মুখে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারের ভিতরে আরেকটি সরকার কাজ করছে বলে ফিসফিস হচ্ছে। ড. ইউনূসের সরকারকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখাই হলো ভিতরের সরকারের অপচেষ্টা। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দূরত্ব তৈরির মূল কারিগর সেই ভিতরের সরকার। জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব দূর করে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, তাহলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেটে যাবে ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক। গতিশীল হবে ব্যবসাবাণিজ্য। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথটি মসৃণ হবে। যেটা এখন অত্যন্ত জরুরি।  

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০২৫
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।