ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৩ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

‘ঝরাফুল’-এর জন্য কাঁদছে দেশ

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৫
‘ঝরাফুল’-এর জন্য কাঁদছে দেশ প্রতীকী ছবি

ঢাকা: এতটুকুন বয়স তার। মোটে আট বছর।

বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কটা দিন কাটানোর জন্য বেড়াতে পাঠিয়েছিলেন মা-বাবা। কে জানতো সেই বাড়িতে পাশবিক লালসা নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে কেউ। গত ৫ মার্চ রাতে মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকায় সেই বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। তার ওপর এতই নির্যাতন চালানো হয় যে, শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। পরে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সপ্তাহখানেক মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও হেরে গেল শিশুটি। যেন না ফুটতেই ঝরে গেল মা-বাবার সাজানো বাগানের ফুল। তাকে হারানোর শোকে শোকার্ত সব-শ্রেণি পেশার মানুষ। মাগুরায় শ্রীপুর উপজেলায় শিশুটির গ্রাম থেকে শুরু করে গোটা বাংলাদেশ যেন শিশুটির জন্য কাঁদছে।

শিশুটির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, দুপুর ১টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে শিশুটি। এদিন সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে তার। দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি।  

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-এক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিয়ে শোক প্রকাশ করেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। পাশাপাশি মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে প্রতিবাদী স্ট্যাটাস দেন অনেকে।

শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। শোক জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা প্রত্যেকে শোকার্ত। শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার আগামীর সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শোকবার্তায় বলেন, ‘মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল, আর নিজে কতটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে, ভাষায় সেই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ’

বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে লেখেন, ‘শিশু (...) ইতিহাসের করুণ সাক্ষী হয়ে দেশকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ’

নিজেদের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তারা বলেন, ‘আমাদের বোন আর নেই। পুরো বাংলাদেশ বোনটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত। ’

সাদিকুর রহমান খান নামে একজন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “জান্নাতে কোনো ধর্ষক নাই। জান্নাতে (...) ঘুমে কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে না। শুনেছি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সে শহীদের মর্যাদা পায়। সেই হিসেবে আমাদের বোন (...) শহীদ। আর কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, শহীদকে তোমরা মৃত বলো না। (...) মরে যায়নি। দুনিয়ার জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর জান্নাতে চলে গেছে। মহান আল্লাহ তাআলা তাকে ভালো রাখুক।  আর যারা এই দুনিয়াটা ওর জন্য জাহান্নাম বানাইয়া দিছিলো, তাদের দুনিয়া আর আখিরাত দুইটাই যেন জাহান্নাম হয়ে যায়।  ‘আমরা তো আল্লাহরই আর নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাব। ’ (২:১৫৬)”

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরীফুল হাসান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘মাগুরার সেই শিশুটি মারা গেছে। নরকসম যন্ত্রণা পাওয়া মেয়েটাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন। মেয়েটা না হয় মরে বাঁচলো কিন্তু এই রাষ্ট্রে রোজ যে অসংখ্য মেয়ে হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তারা কবে নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে? কবে এই দেশ সমাজ তাদের জন্য নিরাপদ হবে?’

সাংবাদিক জেসমিন পাপড়ি শিশুটির মরদেহ হেলিকপ্টারযোগে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তের একটি ছবি পোস্ট করে তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেখেন, কত ছোট্ট একটা লাশ! অথচ পুরো বাংলাদেশের বুক আজ ভারি হয়ে আছে! আট বছরের মেয়েটার জীবন থামিয়ে দিলো ধর্ষক!’

স্বজনদের বয়ানে পাশবিকতা এবং মামলা
শিশুটির বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার জারিয়া গ্রামে। আর তার বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি মাগুরা সদর নিজনান্দুয়ালি গ্রামে।  

স্বজনদের ভাষ্য, ১ মার্চ বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যায় শিশুটি। ৫ দিনগত রাত ২টার দিকে শিশুটি তার ভগ্নিপতি সজিব হোসেন (১৯) ও তার বাবা হিটু শেখের (৪৭) হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। বড় বোন টের পেয়ে এগিয়ে গেলে তাকে আলাদা রুমে আটকে রাখা হয়। সকালে বড় বোনের শাশুড়ি শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা বিষয়টি ফোনকল করে জানায় শিশুটির পরিবারে।  

এদিকে খবর পেয়ে পুলিশও ঘটনাস্থলে যায় এবং সজিব ও হিটুকে আটক করে। অন্যদিকে শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে আনা হয় ঢাকায়।

শিশুটির চাচি জানান, বেশ কয়েকদিন আগে শিশুটির বড় বোন বাবার বাড়িতে এসে তার শ্বশুরের দুশ্চরিত্র নিয়ে অভিযোগ করেন এবং শ্বশুরবাড়িতে নিজে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে বলে জানান।

চাচি বলেন, ‘আমরা তখন মেয়েটির কথায় বিশ্বাস করতে পারিনি। একজন শ্বশুর মানে আব্বা। সে কী করে নিজের মেয়ের সঙ্গে (বৌমা) এভাবে খারাপ কাজ করতে পারে! সে কারণে আমরা তাকে বুঝাই সে যেন শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই রাজি না হওয়াতে আমরা ওর ছোটবোনকে ওর সাথে পাঠাই। কিন্তু কীভাবে বুঝবো যাকে গার্ড (নিরাপত্তা) দেওয়ার জন্যি পাঠাইলাম সেই ওই পশুর কুনজরে পড়ে যাবে। আমরা এর বিচার চাই। উপযুক্ত বিচার চাই। ’

শিশুটিকে ধর্ষণের ঘটনায় গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের নামে মামলা করেন তার মা। এতে আসামি করা হয় সজিব শেখ, হিটু শেখ, সজিব শেখের ছোট ভাই রাতুল শেখ (১৭) ও সজিবের মা জাহেদা বেগমকে (৪০)। এরা চারজনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।

অনেকে বিচারের মাধ্যমে দোষীদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করেন। কেউ কেউ বলেন, দীর্ঘ দেড় যুগ দেশে যেভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু ছিল, ধর্ষকরা সে কারণে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিতে পারছে বারবার।

জানাজা ও দাফন
এদিকে শিশুটির মরদেহ ঢাকা থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় নেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে পৌঁছায়। পরে শহরের নোমানী ময়দানে শিশুটির জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। তার মরদেহ গ্রামে নিয়ে দাফন করা হবে।

এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে রাজধানী থেকে শিশুটির মাসহ পরিবারের সঙ্গে মাগুরায় গেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অনেকে।

(নোট: কোটেশনে ব্র্যাকেট (...) চিহ্নিত স্থানে শিশুটির নাম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে) 

বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৫
এজেডএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।