চাঁপাইনবাবগঞ্জ: আমের দাম না পেয়ে রাগে দুই বিঘা জমির গাছ কেটে ফেলেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কালুপুর গ্রামের ফল চাষি ইসমাইল হোসেন। তিন বছরে লোকসান গোনেন ৫০ হাজার টাকা।
গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করে ৮ লাখ টাকা লাভ করেছিলেন সত্রাজিতপুরের ফল চাষি জুয়েল রানা। খরচ এর বাইরে। এ বছর আবহাওয়া ভালো, তাই আশা করেছিলেন উৎপাদন বাড়লে লাভও বাড়বে। তবে যদি মূল্য পান গত বছরের ন্যায়। তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে আমের দাম না পেয়ে দুই লাখ টাকা লোকসান গুনেছিলেন। এবার আগের মূল্য পেলে অতীতের কষ্ট ভুলে যাবেন। এ বছর আবহাওয়া ভালো হলেও বিদেশ থেকে আমদানির কারণে দাম না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি তার মতো আরও অনেক ফল চাষির।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে আমের পর স্ট্রবেরি উৎপাদনেও শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জেলায় উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ। গত বছরের চেয়ে তিনগুণ জমিতে স্ট্রবেরি চাষ হয়েছে। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি ও উচ্চ মূল্য নিয়ে বিপাকে আছেন জেলার ফল চাষিরা। এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আমের মতো স্ট্রবেরি চাষেও আগ্রহ কমবে চাষিদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি বিভাগ জানায়, দেশের উৎপাদিত স্ট্রবেরির সিংহভাগই জোগান দেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ২০২২ সালে জেলার মাত্র দুইশ বিঘা জমিতে ৪০৫ মেট্রিক টন স্ট্রবেরি উৎপাদিত হয়েছিল। ফলে সারা দেশে এ ফলের চাহিদা মেটান গেছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় আবহাওয়া প্রতিকূল থাকা, ঘন ঘন বৃষ্টি ও সারাদিন কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ থাকায় স্ট্রবেরির ফুল-ফল পচে নষ্ট হয়েছে। এতে উৎপাদনও কম হয়েছিল।
এ বছর আবহাওয়া ভালো ও তীব্র শীতের তাপমাত্রা অনুকূলে থাকায় ফলন লক্ষ্যমাত্রা বাড়ার আশা আছে। হেক্টরপ্রতি ১৫ টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। চাষের জমির পরিমাণ বেড়ে ৭৫৮ বিঘায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু শিবগঞ্জেই স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে ৭৪০ বিঘা জমিতে।
ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে চাহিদা থাকায় রাজশাহী, নাটোরসহ আরও কয়েকটি জেলায় সামান্য পরিমাণ স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে। ফলে এ বছর বিদেশ থেকে স্ট্রবেরি আমদানির দরকার হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিলাবৃষ্টি, ঝড়সহ নানা রোগবালাইয়ের কারণে আমের চাষ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশিয় আম বিদেশের বাজারে টিকতে না পারায় রপ্তানিও দিন দিন কমছে। অপরদিকে, স্ট্রবেরি ফল চাষের সময় শীতের মাঝামাঝি হওয়ায় আবহাওয়াজনিত কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম। পরিচর্যা খরচ ও শ্রমিক প্রয়োজন হয়। চাষে ঝুঁকি কম ও লাভের পরিমাণ বেশি হওয়ায় দিন দিন স্ট্রবেরির চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।
স্ট্রবেরির গাছ ছোট হওয়ায় সাথী ফসল হিসেবে জমির চারপাশে সবজি, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করারও সুবিধা রয়েছে। ফলে সারা দেশেই জনপ্রিয় হচ্ছে ফলটির চাষ। কিন্তু, সারা দেশেই ক্যান্সার প্রতিরোধী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফলটির উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
এ বছর মিশর থেকে আমদানি হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে এক কেজি স্ট্রবেরি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। মৌসুম শেষ হতে হতে দাম কমে দেড়শ টাকায় নামবে। ২০২২ সালে সময় ভেদে কেজি প্রতি স্ট্রবেরি ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছে।
রাজিব নামে এক স্ট্রবেরি চাষি জানান, দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ফলটির স্বাদ খুবই ভালো। আমদানিকৃত ফলের স্বাদ তুলনামূলক কম। কিন্তু দাম কম। ফলে দেশে উৎপাদিত স্ট্রবেরির চাহিদা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মোকামগুলোয় কমে গেছে। এতে করে ফলের দাম অর্ধেক নেমে আসে। যে কারণে তাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, শুধু স্ট্রবেরিই নয়, যেকোনো আবাদকৃত কৃষিপণ্য দেশে উৎপাদিত হলে আগে দেশের কৃষকের কথা মাথায় রেখে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। পেঁয়াজ উৎপাদনের সময় আমদানি করলে যেমন দাম পাওয়া যায় না। ঠিক একইভাবে স্ট্রবেরির দামও পাবে না। এ জন্য কৃষকের ন্যায্যমূল্যে সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যথায় আম চাষিদের মতো লোকসানে পড়তে হবে। এতে করে এ ফলটি চাষের আগ্রহ হারাবে কৃষক।
খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন সূত্রের কাছ থেকে জানা গেছে, মিসর থেকে মোশারফ হোসেন ও সুমন নামে দুই আমদানিকারক স্ট্রবেরি এনেছেন। তারা এ ফলটি ঢাকার বাদামতলী এলাকার খুচরা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকেন। প্রতিদিনই এক টন করে ২০ টন স্ট্রবেরি আমদানি করছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করেন মোশারফ হোসেনের প্রতিনিধি জাবের হোসেন। তিনি বলেন, তারা গত দুই সপ্তাহ ধরে মিসরীয় স্ট্রবেরি আমদানি করছেন। এখন পর্যন্ত ১০ টন আমদানি করা হয়েছে। কোয়ালিটি অনুযায়ী ৩ কেজির এক প্যাকেট স্ট্রবেরি তারা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এ বছরই প্রথমবারের মতো ভালো জাতের স্ট্রবেরি আমদানি করছেন তারা। কিন্তু লাভ করছেন সীমিত।
দেশীয় স্ট্রবেরি চাষিদের ক্ষতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে জাবের বলেন, আমরা হয়ত আর এক সপ্তাহ আমদানি করব। এরপর দেশিয় ফলন সহজলভ্য হলে আমরা বিক্রি বন্ধ করে দেব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর স্ট্রবেরি উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। দেশের মানুষ খাদ্যাভাসে সচেতন হওয়ায় এর চাহিদাও বাড়ছে। মানুষের চাহিদা পূরণে দেশিয়ভাবে যেহেতু উচ্চমূল্যের ফলটির আবাদ হচ্ছে, তাই বিদেশ থেকে আমদানি না করাই উত্তম। কৃষকদের স্বার্থে আমদানি বন্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ করবেন বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
এসএম/এমজে