কুষ্টিয়া: ক্যাপসিকাম একটি বিদেশি সবজি। চায়নিজ খাবারের পাশাপাশি বাংলা খাবারেও এই সবজি ভোজনরসিকদের পছন্দের তালিকা শীর্ষে রয়েছে।
বলছি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের নিয়ামতবাড়ি গ্রামের কৃষকদের কথা। ক্যাপসিকাম চাষ করতে জমি প্রস্তুতে তারা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইতিমধ্যে জমি প্রস্তুত করে প্রায় ৬ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকামের চারা রোপণ করেছেন। আরও ৪ বিঘা জমিতে চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের ২৯ জন কৃষক মিলে কাজ করছেন জমিতে। কেউ জমি প্রস্তুতের কাজ করছেন, কেউবা সার মিশিয়ে দিচ্ছেন, কেউ ছিটাচ্ছেন জৈবসার। কেউ নালা তৈরি করছেন, কেউ বেড তৈরি করছেন আবার কেউবা বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে কেউ ধরেছে মনের সুখে গান। মিলে মিশে যেন সবাই একাকার হয়ে মাঠে কাজ করছেন।
দেখলে মনে হবে যে শ্রমিকেরা মাঠে কাজ করছেন কিন্তু না তারা কেউ এই জমির শ্রমিক নয়। কেউ টাকার বিনিময়ে কাজ করছেন না এখানে। সবাই এখানে ক্যাপসিকাম চাষে স্বপ্ন বুনছেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে ক্যাপসিকাম চাষ করা লাভজনক হলেও গরীব কৃষকদের জন্য এটি চাষ মোটেও সহজ নয়। ব্যয়বহুল এ চাষকে সহজ করতে তারা একটি সমিতির মাধ্যমে ক্যাপসিকাম চাষ করেছেন। আর উচ্চমূল্য এ ক্যাপসিকাম চাষে তাদের সহযোগিতা করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প।
কৃষকদের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পাশাপাশি, প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এই কৃষি প্রকল্পটি। যার ফলে বেশ আগ্রহ নিয়ে খুশি মনে মিলে মিশে কাজ করছেন কৃষকরা।
কৃষক তরিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ক্যাপসিকাম চাষ কীভাবে করতে হয় সেটি আমরা জানি না। তবে শুনেছি এর জন্য অনেক টাকা খরচ হয়। তাই আমরা সমিতির মাধ্যমে এবারই প্রথম ক্যাপসিকাম চাষ করছি। আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ক্যাপসিকাম চাষের ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। এবং কৃষি অফিসের লোকজন এসে আমাদের কীভাবে কি করতে হবে সেটি দেখিয়ে দিচ্ছেন।
আতিয়ার রহমান নামের আরেকজন কৃষক জানান, গত বছর কিছু জমিতে ক্যাপসিকামের আবাদ করেছিলাম। পরিমাণে অল্প হওয়ার কারণে জেলার বাইরে বিক্রি করার সমস্যা হয়েছিল। তাই এবার একসঙ্গে মিলে আমরা বড় পরিসরে ক্যাপসিকামের আবাদ করেছি। যাতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভালো দামে বিক্রি করতে পারি।
কৃষক লিখন বাংলানিউজকে জানান, একার পক্ষে ক্যাপসিকাম চাষ করা অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমরা এলাকার কৃষকদের নিয়ে একটা সমিতির মাধ্যম দিয়ে এখানে ক্যাপসিকাম চাষ করেছি। মাটি প্রস্তুত থেকে শুরু করে সার দেওয়া, বেড তৈরি, মালচিং দেওয়া, চারা রোপণ ও পরিচর্যা করার ক্ষেত্রে সবাই মিলে কাজ করি। এতে আমাদের সময় অপচয় কম হয় এবং শ্রমিক খরচ লাগে না। এখানে প্রায় ২৯ জন কাজ করে। এরা কেউই শ্রমিক না সবাই ক্যাপসিকামের অংশীদার। এর ফলে সবাই এ ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে জানতে পারছেন। যাতে পরবর্তীতে তারা নিজেরাই এ চাষ করতে পারে।
তিনি আরও জানান, ক্যাপসিকাম একটি উচ্চমূল্য সবজি। এর বাজার দর বেশ ভালো থাকে। তবে অল্প চাষ হলে বিক্রিতে সমস্যা হয়। এজন্য আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে চাষ করছি।
ওই এলাকার কৃষকরা নিজেদের অর্থায়নে কিছু কিছু করে সঞ্চয় জমিয়ে ‘জঙ্গলী আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতি’ নামের একটি সমিতির মাধ্যমে ক্যাপসিকাম চাষ করা হচ্ছে।
সমিতির সভাপতি ইলিয়াস খাঁন বাংলানিউজকে জানান, আমরা ২৯ জন কৃষক মিলে এই সমিতিতে সঞ্চয় করি। সেই টাকা দিয়ে আমরা জমি বর্গা নিয়ে এবার এ ক্যাপসিকামের চাষ শুরু করেছি। উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে আমরা যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ক্যাপসিকাম চাষের ওপর তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। একই সঙ্গে প্রকল্প থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। যার মাধ্যমে এ কাজে আমরা বেশি আগ্রহী হয়েছি। যদি এবার ক্যাপসিকাম ভালো হয় তাহলে আরও বিস্তীর্ণ এলাকায় আমরা ক্যাপসিকামের আবাদ করবো।
স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, ক্যাপসিকাম যেহেতু এই এলাকার জন্য নতুন একটি ফসল। এবং কৃষকরা এটির চাষ সম্পর্কে ততটা অভিজ্ঞ না। আমরা সার্বক্ষণিক তাদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি ভালোভাবে চাষের জন্য। এছাড়া তাদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণও দিচ্ছি এই ক্যাপসিকাম চাষে।
কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, ক্যাপসিকাম খুবই পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর সবজি। সবজি হিসেবে এবং সালাদ হিসেবেও এটি খাওয়া যায়। এর বাজার মূল্য অন্য সবজির তুলনায় অনেক বেশি। কৃষকরা এটি চাষ করে বেশ লাভবান হতে পারে। গত বছর কুমারখালীতে ক্যাপসিকাম চাষ করে সবুজ নামের এক যুবক বেশ লাভবান হওয়ায় এলাকার অনেক কৃষক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে এ ক্যাপসিকাম চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, কৃষকরা যাতে নিরাপদ উপায়ে ক্যাপসিকাম চাষ করতে পারেন এজন্য প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে ক্যাপসিকাম চাষের জন্য প্রদর্শনী বাস্তবায়ন ও মাঠ দিবস করছি। এছাড়া কৃষকরা যাতে সঠিক মূল্য পায় এজন্য সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে কৃষকরা লাভজনক কৃষির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন ক্যাপসিকাম চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তাই কৃষকরা মাঠে জমি তৈরি ও চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কুষ্টিয়া জেলার জন্য ক্যাপসিকাম চাষ একটি সম্ভাবনাময় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০২৪
এসএম