নদ-নদী অববাহিকার বিভিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে বালুময় অধিকাংশ জমিই চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে চরের পর চর বিস্তীর্ণ এলাকা বালুর আস্তরণে ঢেকে যাওয়ায় চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ে প্রতিবছরই।
স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত প্রচলিত বীজের উপরই নির্ভর করে বালুকাময় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে গতানুগতিক বাদাম, কালাই, চিনা, স্বল্প সংখক জমিতে ধান চাষ করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করে টিকে থাকে নদ-নদী অববাহিকার মানুষগুলো।
অথচ উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৬টি নদ-নদী অববাহিকার ৪ শতাধিক দুর্গম চরে কৃষি বিপ্লব ঘটানোর মধ্য দিয়েই কুড়িগ্রামের আর্থ সামাজিক অবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।
কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব কোনের সীমান্তবর্তী এমনি একটি দুর্গম চরের নাম আইরমারীর চর। উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের আর্ন্তজাতিক সীমানা পিলার ১০৪৩ সংলগ্ন এই চরটির পাশ দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ভাঙ্গাচোড়া সড়কে ৪০ মিনিটের পথ। এরপর যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঘাটে পৌঁছে নৌকায় দেড় ঘণ্টা ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেয়ার পর দেখা মেলে সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম ও অবহেলিত আইরমারী চরটির। খুব প্রয়োজন না হলে সরকারি বা শহুরে মানুষ এখানে আসেন না।
সরেজমিনে নৌকা থেকে নেমে দেখা যায় চারিদিকে বালুকাময় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। চরের উত্তর কোনে উচু বাঁশের খুটিতে লাগানো একটি কাপড়ের পতাকা ভাগ করে দিয়েছে ভারত-বাংলাদেশের ভূখণ্ড। এর দেড়শ’ গজ দূরেই নৌকায় অবস্থান করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) টহল দল।
প্রত্যন্ত এই চরটিতে বসবাস ১১৭টি পরিবারের প্রায় সহস্রাধিক মানুষের। গত বন্যায় একটি অংশে ভাঙন ধরিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ দু’ভাগ করে দিয়েছে চরটিকে। চরের যেসব স্থানে পলি পড়েছে এমন সামান্য কিছু অংশে ধান, বাদাম ও বিভিন্ন কলাই (ডাল) আবাদ হলেও পতিতই পড়ে আছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল।
চরাঞ্চলের বালুকাময় জমিতে উন্নতমানের বীজ বা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজ সম্ভব তা জানা নেই এখানকার অধিবাসীদের। অনেকেই বাড়ি সংলগ্ন পলি পড়া জমিতে সবজি চাষ করার পাশাপাশি বালু মাটিতে উৎপাদনশীল বাদাম, খেসারি ডাল চাষাবাদের চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় কৃষক আয়নাল হক (৬০) বাংলানিউজকে জানালেন, ‘ঘরের পাশে কোনমতে জাংলি দিয়া লাউ, সিম আবাদ করছি। চরের মাটি তাই ফলন ভালো হয়না। শহর থেইক্যা অনেক দূরে থাইকবার জন্যে উন্নত বীজও জোগাইবার পারি না’।
আইরমারী চরের বাসিন্দা জানু সেখ (৫৫) বাংলানিউজকে বলেন, ‘বন্যার সময় তো তিন মাস কোন ফসলই হয় না। অন্য সময় বালু জমিতে রস না থাকায় বেবাক জমি পতিত পইড়া থাকে। তাই উন্নত বীজের পাশাপাশি কৃষিবিভাগের পরামর্শ সহ শ্যালোমেশিন দিয়া সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ভুট্টা, শাক-সবজি, বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলানো সম্ভব হইবো। ’
সাহেবের আলগা ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য আ. সবুর মোল্লা বাংলানিউজকে জানান, চরগুলোতে বন্যার পর বালু পড়ে চাষাবাদের অনুপোযোগী হওয়ায় পতিত পড়ে রয়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত বীজ ও পদ্ধতি ব্যবহার করে আবাদ হয় সামান্যই। দুর্গম এলাকা হওয়ায় উচ্চ পর্যায়ের কেউ আবার যায় না খুব দরকার না পড়লে।
সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মন্ডল বাংলানিউজকে জানান, কৃষি বিভাগসহ সরকারের উচ্চ মহলকে নতুন করে ভাবতে হবে অবহেলিত এই চরাঞ্চলের মানুষকে নিয়ে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বাংলানিউজকে জানান, বন্যা পরবর্তী কৃষি প্রনোদনার কাজ দ্রুত করার পাশাপাশি চরের কৃষির উন্নয়নে সকল কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন।
তিনি আরো বলেন, দুর্গম এলাকাগুলোর চরাঞ্চলের মানুষ যদি বাদাম, ডালসহ বিভিন্ন ফসলের উন্নত বীজ পেতো তাহলে তাদের জন্য আরো ভালো হতো। বিভিন্ন চরাঞ্চলে দেখা গেছে কৃষকরা প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে বাদাম চাষ করেছে। এটি যাতে উন্নত করা যায় এবং উন্নতজাতের বীজ তারা পেতে পারে সে চেষ্টা আমাদের রয়েছে। আমরা বিএডিসির সাথে কথা বলছি এবং কৃষকরাও ব্যক্তি পর্যায়ে বাজারে যাতে এ বীজটা পায় সে বিষয়ে কাজ চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৭
এফইএস/আরআই