ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

হালচাষে সনাতন পদ্ধতি ধরে রেখেছেন কৃষক আব্দুর রশিদ

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০২০
হালচাষে সনাতন পদ্ধতি ধরে রেখেছেন কৃষক আব্দুর রশিদ হালচাষে ব্যস্ত কৃষক। ছবি: কাওছার উল্লাহ আরিফ

বগুড়া: গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জমি প্রস্তুতির হালচাষ পদ্ধতি আজকের দিনে প্রায় বিলুপ্ত। অথচ এককালে চাষাবাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ছিল গরু-লাঙ্গল-জোয়ালের সমন্বয়ে তৈরি হালচাষ পদ্ধতি।

কিন্তু আধুনিকতায় ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য।  সোমবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর গ্রামে বিলুপ্তপ্রায় এই হালচাষ পদ্ধতি দেখতে পাওয়া যায়।

জেলার শাজাহানপুর উপজেলার চুপিনগর পূর্বপাড়া গ্রামের মৃত মোয়াজ্জেম আলীর ছেলে মো. আব্দুর রশিদ (৫৭)। পেশায় একজন জাত কৃষক। চার মেয়ে ও এক ছেলের বাবা তিনি। পাঁচ ছেলে-মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। বাপ-দাদার সময়কাল থেকেই গরু দিয়ে হালচাষ করে আসছেন তিনি। হালের একজোড়া বলদ গরু, কাঁধে কাঠের তৈরি জোয়াল, সেটির সঙ্গে বাঁধা লাঙ্গল। গরুর মুখে লাগানো বাঁশ দিয়ে তৈরি টোনা। কৃষকের হাতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি লাঠি। যা গরু তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। জোয়ালের সঙ্গে লাঙ্গল আর গরুর মুখে টোনা লাগাতে ব্যবহার করা হয় শক্ত দড়ি।  যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এগিয়ে চলছে দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। আর পরিবেশবান্ধব গ্রাম বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী হালচাষ পদ্ধতি যেন জাদুঘরে স্থান করে নেওয়ার প্রহর গুনছে। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় এখনো গ্রামে বিলুপ্তপ্রায় এই হালচাষ পদ্ধতির দেখতে পাওয়া যায়।

কৃষক আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারেননি খুব বেশি। সম্পদ হিসাবে রয়েছে পাঁচ বিঘা ফসলি জমি বসত-ভিটা। কৃষি কাজ করে বেশ ভালোভাবেই সংসার চলে আব্দুর রশিদের। নিজের জমিসহ তিনি অন্যের জমিতেও তার গরু দিয়ে হালচাষ করেন। এতে প্রতি বিঘাতে হালচাষ বাবদ পেয়ে থাকেন এক হাজার ৯০ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি শতকে পেয়ে থাকেন ৩৩ টাকা।

তিনি জানান, ধান, শীতকালীনসহ বাকি মৌসুমে সবজিচাষ করেন তিনি। তার বাবা দাদা কৃষি পেশায় নিয়োজিত গরুর লাঙ্গল দিয়েই হালচাষ করেছেন। এজন্য তিনি নিজেও পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছেন। তিনি আরও জানান, তিনি দেখেছেন তার বাবা-দাদা জমি প্রস্তুতের জন্য কাক-ডাকা ভোরে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে গরু বা মহিষ নিয়ে ছুটতেন নিজ জমিতে। আবার শ্রমের বিনিময়ে অন্যের জমিতে হালচাষ করে দিতেন। সবমিলিয়ে হালচাষে বংশের এ সনাতন পদ্ধতি ধরে রেখেছেন আব্দুর রশিদ। গরু দিয়ে হালচাষেই তিনি বেশি সন্তুষ্ট।

এদিকে হালের দুইটি বলদকে বেশ যত্ন করেন আব্দুর রশিদ। হালচাষ শেষে নিয়মিত গোসল, খাবার খাওয়ানোসহ মাঝেমধ্যে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন তিনি। গো-খাদ্যের মূল্য দিন দিন বাড়ায় অনেকটাই বিপাকে পড়তে হয় তাকে। তবুও কোনো অবস্থাতেই এ পশু দুটোর যত্ন বা খাবারের কষ্ট দেন না তিনি। প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মিতভাবে অন্যের ফসলি জমির আইলে জন্মানো সবুজ ঘাস কেটে খাওয়ান তিনি।

জাব্বার মোল্লা, তোজাম উদ্দিন, মোশারফ মিয়াসহ একাধিক কৃষক বাংলানিউজকে জানান, আধুনিক যন্ত্রপাতির চেয়ে লাঙ্গনে জমি চাষ তুলনামূলক ভালো হয়। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে। ফসল চাষাবাদে তুলনামূলক কম সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। তাই এখনো হালচাষে বিশ্বাসী অনেক কৃষক। তারা বলেন, জমি চাষের জন্য আগের দিনে কৃষকের অন্যতম প্রধান উপকরণই ছিল হালচাষ পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করে কৃষকরা তাদের জমিতে হালচাষ, মই দেওয়াসহ পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত করতেন ফসল লাগানোর জন্য।

প্রবীণ কৃষকরা মন্তব্য করেন, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দেশের সবখানে এখন আর আগের সেই দিন নেই। যে দিনগুলোতে কৃষক তাদের জমিতে গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষ করতো। খুব তাড়াতাড়ি জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে চাষাবাদের এমন দৃশ্যের দেখা পাওয়া হয়তো দুষ্কর হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০২০
কেইউএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।