ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২

মোবাশ্বের আলীর বন্ধু দৌলত আমিন মাস দুয়েক আগেও কোস্ট গার্ডের শিক্ষা শাখায় কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।

বন্ধুর ঘোর বিপদে দৌলত আমিন চুপচাপ বসে থাকেননি। ফোনে বিস্তারিত শুনেই বিকেলে মোবাশ্বের আলীর বাসায় চলে এসেছেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর তার পুরনো কর্মস্থল সেন্টমার্টিনের ঘনিষ্ঠ একজন সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগও করলেন। সুনামির কবলে পড়ে বন্ধুর মেয়ে সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে, সেই বিষয়ে জানিয়ে তার সাহায্যও চাইলেন। বিস্তারিত শুনে সহকর্মী প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যবস্থা নেবেন। দৌলত আমিন আরও জানিয়েছেন, বন্ধু মোবাশ্বের আলী দুই-একদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

পুরনো কর্মস্থলের সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ শেষ করে দৌলত আমিন বন্ধু মোবাশ্বের আলীকে সমুদ্রবিদ্যা সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে দৌলত আমিন বললেন, ‘আমি তোর বাল্যবন্ধু। সুখ-দুঃখের সাথী ছিলাম একসময়। ’

মোবাশ্বের আলী বন্ধুর মুখের কথা থামিয়ে দিয়ে অভিমানের সুরে বললেন, ‘ছিলাম মানে? এখন নেই, এই তো বলতে চাস?’
‘রাগ করিস না, আমি সেই অর্থে বলিনি। বেশি কথা বলতে গিয়ে যা হয়; সেভাবেই বলে ফেলেছি আসলে। ’
‘ধুর, কথার কথা বললাম। মাথা-টাথা ঠিক নাই, এবার বল কী বলতে চাস। ’

দৌলত আমিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘মনে আছে ছোট বেলায় আমরা কত ডানপিটে ছিলাম; নানান রকম দুষ্টমি করে পাড়া-পড়শির মাথা নষ্ট করে দিতাম। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে সার্কাস, সিনেমা দেখতাম। পাঠাগারের বই পড়তে এনে আর কখনো ফেরত দিতাম না। এমন কোনো কাজ নেই, যা দুই বন্ধু করিনি। তারপর লেখাপড়া শেষ করে তুই জাপান চলে গেলি, আমি যোগ দিলাম কোস্ট গার্ডে। তারপরেও আমাদের যোগাযোগ রয়েছে দু’জনের দৃঢ় বন্দনের কারণে। মনে আছে সেসব কথা তোর?’
‘কেন মনে থাকবে না। এই তো সেদিনের কথা। তা এসব কথা আজ কেন?’

‘আজ নয়, আমার সব সময়ই মনে পড়ে পুরনো সব স্মৃতি। আহ্ সেই দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম। জানিস, তোর সঙ্গে আবার ঘুরে বেড়াতে মন চাচ্ছে আমার। ’

‘অবশ্যই ঘুরবি। আগে মেয়েটাকে উদ্ধার করি, তারপর না হয় দু’জন আবার ঘুরে বেড়াবো। ’ মোবাশ্বের আলী মনে মনে একটু বিরক্তই হলেন। ঘোর বিপদে দৌলত আমিন এসব কী বলছে। এই পরিস্থিতিতে এসব কথা কেউ বলতে পারে না কি!
দৌলত আমিন বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ থেকেই তোর সঙ্গে থাকবো। যে কয়দিন দেশে থাকিস, দুই বন্ধু মিলে ঘুরে বেড়াব। কেমন মজা হবে বল তো?’

‘বয়স হয়েছে, পাগলামি রাখ; এখন আর আগের মতো ঘোরাঘুরির বয়স নেই। তাছাড়া আমি যাচ্ছি সেন্টমার্টিনে মেয়ের সন্ধানে, আর তুই বলছিস ঘুরে বেড়াতে। এসব কথা এখন না বললেই ভালো হয় দৌলত। সময় সুযোগ হলে আবার দু’জন একত্রে আড্ডা দেবো। ’
‘শোন মোবাশ্বের, পেশার তাগিদে জীবনের বেশির ভাগ সময় পানিতে ভেসেছি, সেই অভ্যাসটা ছাড়তে পারছি না হুট করে। অবসরে এসে বন্দির মতো লাগছে। তাই বন্দি থেকে মুক্তি পেতে তোর সঙ্গে আমারও ইচ্ছে করছে সাগরে ভাসতে। আমি চাই অর্পিতা মা’মণির উদ্ধার কাজের অংশীদার হতে। ’

দৌলত আমিনের পেঁচানো কথার অর্থ এবার স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন মোবাশ্বের আলী। বন্ধুর কথা শুনে আবেগে চোখের জল ছেড়ে দিলেন তিনি। এই না হলো বন্ধু! দুর্দিনে যে কি না সঙ্গী হতে চাচ্ছে। অথচ ভুল বুঝেছে সে দৌলত আমিনকে।

চোখের জল মুছতে মুছতে মোবাশ্বের আলী বললেন, ‘তুই অসুস্থ, আমাদের সঙ্গে যেতে পারবি না দৌলত। অপারেশনের রোগী। কয়েক মাস আগে সার্জারি করিয়েছিস, এ অবস্থায় তোকে সঙ্গে নিলে আমার সমস্যা বাড়বে। এটা ঠিক, তুই সঙ্গে থাকলে অনেক ভালো হতো, সমুদ্রবিদ্যা জানা আছে তোর, অন্তত বোটের দায়িত্বটা নিতে পারতি। অসুস্থ হয়েও যে আন্তরিকতা দেখিয়েছিস, তার জন্যেও কৃতজ্ঞ। মেয়েটার জন্য দোয়া করিস, আর কিছুই করতে হবে না তোকে। ’

‘আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। আশা করি তোদের সঙ্গে যেতে পারবো। ডিপার্মেন্টে আমার সুনামও আছে, আমি সঙ্গে থাকলে তোদের জন্য অনেক ভালো হবে। আর অমত করিস না ভাই। ’

‘তোর কথায় যুক্তি আছে। তুই যা করবি, ঢাকা বসেই করতে পারবি। তোর পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে একটু যোগাযোগ রাখিস। আমাদের প্রতি খেয়াল রাখতে বলবি। তাহলে উদ্ধার কাজে সুবিধা হবে। ’

অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে দৌলত আমিনকে বিদায় দিলেন মোবাশ্বের আলী। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে রওনা দিতে হবে তাকে। তাহলে যথাসময়ের মধ্যে টেকনাফ পৌঁছাতে পারবেন। মাইক্রোবাস বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে চালক।

ইতোমধ্যে উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ওষুধসামগ্রী সংগ্রহ করেছেন মোবাশ্বের আলী। বিশেষ করে তিয়াস যা যা বলেছে সবকিছুই সংগ্রহ করেছেন। তবে বাড়তি একটা কাজ করেছেন তিনি। সেটা হচ্ছে তার নিজ গ্রামের পরিচিত একজনকে সঙ্গে নিয়েছেন। লোকটার নাম গহর আলী। থাকেন আগারগাঁওয়ে; মোবাশ্বের আলীর বাসার কাছেই তার বাসস্থান। একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন গহর আলী। কয়দিন আগে চাকরিটা হারিয়েছেন, এখন বেকার। সেই সুবাদে তাকে সঙ্গে নিয়েছেন টুকিটাকি কাজকর্মে সাহায্য করতে। যদিও বোটে আরও লোকজন থাকবে, তথাপিও নিজস্ব লোকজনেরও দরকার আছে। অপরিচিতদের সঙ্গে সমুদ্রে এতদিন কাটাতে হলে নিজেদের দলটাও ভারী করতে হবে।

সব কিছু গোছগাছ করে সন্ধ্যার মধ্যেই তারা টেকনাফের উদ্দেশে রওনা করলেন। চলতি পথে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হওয়ায় তারা সকাল নয়টার মধ্যে টেকনাফ জেটি ঘাট পৌঁছালেন। সেখান থেকে যথারীতি জাহাজে চড়ে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছালেন সেন্টমার্টিনে।

জাহাজ থেকে নেমে মোবাশ্বের আলী সোজা হোটেলে চলে এলেন। ঢাকা থেকে হবু শ্বশুর এত দ্রুত চলে আসায় তিয়াস খুব খুশি হয়েছে। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে মোবাশ্বের আলীকে দেখে। তিনি এতসব আয়োজন করে দ্রুত ফিরে আসবেন, এটা সে কল্পনাও করেনি। ভেবেছে কথা রক্ষার স্বার্থে হয়তোবা টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু এতসব আয়োজন করে তিনি ফিরে আসবেন, যা ভাবতেও পারেনি তিয়াস। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জিনিসপত্র এবং বাড়তি লোকজন আনায় তিয়াস খুব খুশি হয়েছে। তিয়াস ভাবছে, অর্পিতার বাবা যদি তার মেয়েকে উদ্ধার করতে এগিয়ে না আসতেন তাহলে এতসব আয়োজন করা ওর পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। উদ্ধার কাজে প্রচুর টাকা-পয়সার প্রয়োজন, যা ওর কাছে নেই। এখন আর কিছু না হোক, প্রিয় মানুষটাকে খুঁজতে বেরুনো যাবে। উদ্ধার করতে না পারলেও মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে।

তিয়াসের বিশ্বাস, উদ্ধার কাজ বৃথা যাবে না। নির্জন দ্বীপগুলোতে খুঁজলে অর্পিতাকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশাল আয়তনের সাগরে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে না পারলেও দ্বীপগুলোতে খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোবাশ্বের আলী। অন্যদিকে সাগরে ভেসে থাকলে কারো না কারো নজরে পড়বেই, সেই ভরসাও আছে। কারণ বঙ্গোপসাগরের এই জলপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জলপথ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রত্যহ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘটে এই জলপথের মাধ্যমে। সুতরাং চলার পথে নাবিকদের নজরে পড়লে তারা অর্পিতাকে উদ্ধার করবেন অবশ্যই।

মোবাশ্বের আলী হোটেলে এসেই তিয়াসের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তিয়াস এদিকে কতটা গুছিয়েছ; সব ঠিকঠাক আছে তো?’
‘সব ঠিক আছে আঙ্কেল। উদ্ধার কাজের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সব কিছুই সেরে ফেলেছি। বোট ভাড়া, পেশাদার উদ্ধারকর্মী, পানি, খাদ্যসামগ্রী সব কিছুরই ব্যবস্থাই করেছি। বোটের লোকজন রাতে হোটেলে আসবেন ভাড়ার টাকা নিতে। অর্ধেক টাকা অগ্রিম নেবেন তারা। বাকি টাকা সেন্টমার্টিন ফেরত এলে দিতে হবে। তাদের সঙ্গে আমার এমনটাই কথা হয়েছে। ’
‘কত দিনের জন্য ভাড়া করেছ?’
‘সপ্তাহ খানেকের জন্য। প্রয়োজনে উদ্ধার কাজ আরও কয়েকদিন বাড়তে পারে, সেকথাও বলেছি। ’
‘কত টাকায় ভাড়া করেছ?’
‘ভাড়ার টাকা এখনো ফাইনাল করেনি। আপনার সঙ্গে কথা বলে ফাইনাল করবো। ’
‘বোট কেমন মজবুত?’
‘বেশ মজবুত। বোট নিয়ে একদম সমস্যা হবে না। রাবারের তৈরি, রেসকিউ’র বোট। সাত-আট জন ভালোভাবে থাকতে পারবে। এছাড়াও বোটে রাডার, কম্পাস, রেডিও সিগন্যাল, সোলার প্যানেল, হ্যান্ড মাইক, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদির সুবিধাও আছে। আর বোটটা দিনরাত সমানভাবে সার্ভিস দিতে পারবে। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, এই বোটগুলো উত্তাল ঢেউয়ে কাত হয়ে পড়লেও নিজ থেকে ব্যালেন্স ঠিক করতে পারে। আসলে রেসকিউ’র বোটগুলো মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট সামর্থ্য রাখে। ’
‘সাবাস বেটা। খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছ?’

‘চাল-ডাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই করেছি। বোটের লোকজন জানিয়েছেন, সমুদ্রে মাছের অভাব হবে না। জেলেদের থেকে না কি খাওয়ার মাছ কিনতে পাওয়া যাবে। অনেক সময় জেলেরা দুই-চারটা মাছ এমনিই খেতে দেয়। খাবার-দাবার-পানি নিয়ে আপনার কোনো টেনশন করতে হবে না আঙ্কেল। ’
‘বোটের লোকসংখ্যা কতজন?’
‘তিনজন। আমরাসহ মোট ছয় জন। বোটে থাকছেন একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী, একজন চালক, একজন টেকনেশিয়ান। খাদ্যসামগ্রী যা নিয়েছি, তাতে দুই সপ্তাহ চলে যাবে নিশ্চিত। আরেকটা কাজও করেছি, বড় একটা সাইনবোর্ড করিয়েছি, ‘রেসকিউ ওয়ার্কাস ফর সুনামি’ লিখে। কাজটা কেমন হলো আঙ্কেল?’

‘এককথায় চমৎকার হয়েছে। সুন্দরভাবে গুছিয়েছ সবকিছু। বিশেষ করে সাইনবোর্ডটা অনেক কাজ দেবে। ’
‘আপনার বন্ধুর ফোন নম্বরটা এনেছেন?’
‘এনেছি। কিন্তু এখানে তো ফোন সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না, নেটওয়ার্ক নেই। অবশ্য সারা দেশেই একই অবস্থা। এখনো তো সারা দেশে নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ঘটেনি। গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছাড়া সবখানে টাওয়ারও নেই। শুনেছি টেকনাফেও তেমন একটা নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। সেই হিসেবে তো সেন্টমার্টিনে নেটওয়ার্ক আশা করাই যায় না। তারপরও নম্বরটা সঙ্গে আছে, এটাও কম ভরসা নয়। জানো তিয়াস, দৌলত আমিন উদ্ধার কাজে আসতে চেয়েছিল। সে কি পিড়াপিড়ি আমাকে রাজি করাতে। ’
‘আনেননি কেন! উনি সঙ্গে থাকলে তো আমাদের ভীষণ উপকার হতো। কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে অতিরিক্ত সহায়তা পেতাম। তাছাড়া তিনি সমুদ্রবিদ্যায় পারদর্শী, সঙ্গে থাকলে যেকোন প্রতিকূলতা মোকাবিলার পরামর্শ পেতাম। ’
‘ইচ্ছে করে কি আর ওকে রেখে এসেছি? ও অসুস্থ। ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়েছে মাস কয়েক আগে। এখন ওকে সঙ্গে আনার মানে হচ্ছে ওর বিপদ ডেকে আনা। মাঝপথে দৌলতের কিছু একটা হয়ে গেলে উদ্ধার কাজ অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে হবে। ’
‘তাহলে অবশ্য না এনেই বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। ’

তিয়াসের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে মোবাশ্বের আলী একটু বিশ্রাম নিয়েছেন। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বিশ্রাম সেরে বিকেলে তিয়াসকে নিয়ে কোস্ট গার্ডের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। দৌলত আমিনের পরিচয় দিয়ে তারা দু’জন পরিচিত হলেন। কোস্ট গার্ডের লোকজন মোবাশ্বের আলীর পরিচয় পেয়ে খাতির যত্নও করলেন। তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা। সাইনবোর্ডের কথা জানতে পেরে তিয়াসের বুদ্ধির প্রশংসাও করলেন। বাংলাদেশের পতাকা আর সাইনবোর্ডটা বোটের সঙ্গে সেঁটে দিতে পরামর্শ দিলেন। তাতে দেশের অন্যান্য কোস্ট গার্ডের নজরে পড়লে উদ্ধার কাজে সহায়তা করবেন। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেসকিউ দল উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে সুনামির পর থেকেই। তাদের নজরে পড়লে তারাও সাহায্য করবেন। কোস্ট গার্ড আরও জানিয়েছে, ছেঁড়া দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের আর কোনো ভূখণ্ড নেই। দেশের জলসীমার বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বারবার।

কথা প্রসঙ্গে কোস্ট গার্ডের একজন জানিয়েছেন, ছেঁড়া দ্বীপ পেরুলে প্রায় নয়শ কিলোমিটার দক্ষিণে উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপটি আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। ওই দ্বীপের কাছাকাছি আন্দামানবাসীরাও যেতে পারেন না। ভারতীয় কোস্ট গার্ড দ্বীপটার কাছাকাছি যেতে কাউকে অনুমতিও দেয় না। তাই এই বিষয়ে সাবধান থাকতে বলেছেন। এভাবে তাদের সঙ্গে আরও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে দু’জন সন্ধ্যা নাগাদ হোটেলে ফিরে এলেন।

বোটের লোকজন রাতে হোটেলে এসেছেন মোবাশ্বের আলীর সঙ্গে দেখা করতে। মোবাশ্বের আলী সবার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামীকাল ভোরের দিকে তারা বোট ছাড়বেন। এই ফাঁকে কার কোন দায়িত্ব তিয়াস সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তারপর আরও প্রয়োজনীয় পরামর্শ করে সবাই হোটেল থেকে বিদায় নিলেন। কথা রইল সবাই সকাল ছয়টার মধ্যে সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে এসে পৌঁছবেন। মোবাশ্বের আলীর ইচ্ছে সাতটার মধ্যেই বোট ছাড়ার।

রাত অনেক হয়েছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিয়াসের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। শীতের মধ্যেও ঘামছে। বুঝতে পারছে না, খুশিতেই না কি উৎকণ্ঠায় এমনটা হচ্ছে। গত কয়েক রাতেও সে ঘুমাতে পারেনি। যখনই ভাবে অর্পিতা বেঁচে আছে, অথচ অন্ধকার রাতেও সাগরে ভাসছে কিংবা নির্জন কোন দ্বীপে আছড়ে পড়েছে, তখনই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তিয়াসের। অর্পিতা চির বিদায় নিলেও এতটা কষ্ট পেত না, এখন যেভাবে তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছে। শুধু তিয়াসই নয়, পুরো পরিবারটাকে সুনামি রাত-দিন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই তো বাবা মোবাশ্বের আলী রীতিমতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন মেয়েকে উদ্ধার করতে। তিনি উদ্ধার কাজের জন্য যে বিশাল আয়োজন করেছেন, তা সত্যিই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তিয়াস আরও ভাবছে, এত আয়োজনের পরেও যদি প্রিয় মানুষটাকে উদ্ধার করতে না পারে, তাহলে বেঁচে থাকাই হবে ওর জন্য যন্ত্রণাদায়ক। বিষয়টা অর্পিতার মৃত্যুজনিত কারণে নয়; বিষয়টা হচ্ছে দু’জন একত্রে ভেসে গেছে, অথচ সে ফিরে এসেছে, আর সঙ্গী ওর সামনে দিয়ে সাগরে ভাসতে ভাসতে দূর অজানায় হারিয়ে গেছে। সেই যন্ত্রণাদায়ক ঘটনাটা ভাবতেও শিউরে উঠছে তিয়াস। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪
এমজেএফ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।