ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ১২-১৪

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১০
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ১২-১৪

১২. সুন্দরের কাছে যাওয়া

মন্দিরের একেবারে কাছে চলে এসে মন্দির, তার বিশালতা, তার সৌন্দর্য, তার পরিপার্শ্বের নৈসর্গিক প্রভা আরো বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলে পপীপকে। তার পা থেমে যায় নিজের অজান্তেই।

এখন তাদের এবং মন্দিরের মাঝখানে খুব ছোট্ট আদুরে এক নদী। নদী পেরুনোর জন্য মূলিবাঁশের সংযোগ-পথ। কিন্তু এখান থেকে স্বচ্ছতোয়া নদী এবং মন্দিরের সৌন্দর্য পপীপকে এতটাই আবিষ্ট করে ফেলে যে সে বাঁশের সেতুতে পা রাখার চাইতে নদীর জলে পা ভিজিয়ে জল ছড়িয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য মনে মনে আকুল হয়ে ওঠে। মল্ল বাঁশের সেতুতে পা রাখলেও সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে মন্দির আর মন্দিরের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের খেলা। মল্ল যেন বুঝতে পারে তার মনের কথা। হেসে বলে- তলা দেখা গেলেও এই নদীর জল কিন্তু অনেক বেশি পপীপ! তুই তো ডুবে যাবিই, আমি পর্যন্ত থাও পাব না রে বাপ। সাঁতরাতে হবে।
সাঁতার তো কৈবর্তশিশুরা হামাগুড়ি দেবার বয়সেই শিখে নেয়।
কিন্তু মল্ল নিষেধ করে। এখন পরনের কাপড় ভেজানো চলবে না। সে আশ্বাস দেয়, এই নদীতে জলভেঙ্গে সাঁতরানোর সুযোগ অনেক পাবে পপীপ। পপীপ তখন মল্লর হাত ধরে পা বাড়িয়ে দেয় সেতুর প্রথম ধাপে।
মন্দিরের সামনে পৌঁছে প্রথম বাস্তবের মাটিতে হোঁচট খায় স্বপ্নাবিষ্ট পপীপ। মন্দিরের সিংহদুয়ারে পৌঁছে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢোকার জন্য দ্রুত পা চালায় সে। কিন্তু তার হাতে চাপ দিয়ে গতিরোধের সংকেত দেয় মল্ল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই মল্লর মুখে ফুটে ওঠে সেই তিক্ত হাসিটাই। মুখে বলে- মন্দিরে ঢোকার অধিকার মোদের নাই।
মুহূর্তের মধ্যে আবার সেই কৈবর্তকিশোর জেগে ওঠে পপীপের বুকে। মন্দিরের সমস্ত সৌন্দর্য নিমেষে  নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তার চোখ থেকে।
তার চোখে-মুখে হতাশা এবং ব্যথা ফুটে উঠতে দেখে নিজেই আবার সান্ত্বনা দেয় মল্লÑ তবে তুই আর আমি ঠিকই ঢুকতে পারব রে পপীপ।
পপীপের সমস্ত উৎসাহ তখন নিভে গেছে। কান্নার বাষ্প ততণে কণ্ঠকে বুঁজিয়ে ফেলেছে অনেকখানি। কোনোমতে বলতে পারেÑ আমি ঢুকতে চাই না।
না চাইলেও ঢুকতে হবে।
কেন?
তোর পুঁথি-পুস্তক তো এখানেই রে। এখানে থেকেই তো তোকে পড়তে হবে।
আমি এখানে থাকব কী করে?
একটু থমকায় মল্ল। বলেÑ ঠিক কীভাবে কাজটা সফল করা যাবে তা এখনো পর্যন্ত আমি জানি না। কিন্তু করতে হবে, এটাই হলো সার কথা। চল দেখা যাক, পথ একটা-না-একটা বেরিয়ে আসবেই।

মন্দিরের সিংহদুয়ারে জনা কুড়ি ভূমিপুত্রের জটলা। সেই জটলার মধ্যে পপীপকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে মল্ল। মন্দিরের দরোজায় সশস্ত্র প্রহরী। তাদের এড়িয়ে কেউ মন্দিরে ঢুকতে পারে না। ব্রাক্ষ্মণ-ত্রিয়-অভিজাতরা ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই এই মন্দিরে। তবে বিশাল মন্দিরের রণাবেণের কাজও তো অনেক। অনেক নারী-পুরুষকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সার্বণিকভাবে। কিন্তু তাদের পক্ষে তো আর নীচুশ্রেণীর কাজগুলি করা সম্ভব হয় না। সেবায়েতরা নিজেরা তো কোনো কায়িক শ্রমের মধ্যে যাবেই না। সেই কারণে আশপাশের গ্রাম থেকে বিষ্টি(বেগার শ্রম) দেবার জন্য ভূমিপুত্রদের ধরে আনা হয়। তারা নির্দিষ্ট সময়ে মন্দিরে ঢুকতে পারে। নির্দিষ্ট কাজগুলি সম্পন্ন হওয়ামাত্র তাদের আবার মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
কিছুণ পরেই তাদের মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মল্ল নিজের মুঠিতে শক্ত করে ধরে রেখেছে পপীপের একটা হাত। মন্দিরের সিংহদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই নিজেকে দেখতে পাওয়া যায় একটা বিশাল আঙ্গিনার মধ্যে। আঙ্গিনার একপাশে একটা উঁচু বেদী। মল্ল নিচুকণ্ঠে পপীপকে জানায়, এখানে ঐ বেদীতে দাঁড়িয়ে প্রধান পুরোহিত সপ্তাহান্তে একবার সাধারণ আর্যদের সমাবেশে বেদের বাণী শোনায়। আঙ্গিনা পেরিয়ে মন্দিরের মূল চত্বর। কিন্তু সেখানে ঢুকতে দেওয়া হলো না কর্মীদের। তাদেরকে মূল চত্বরের পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মন্দিরের উদ্যান অংশে। এখানে দুইটি অংশ। পুষ্পোদ্যান আর ফলদ উদ্যান। পুষ্পোদ্যানে কোনো অনার্যের প্রবেশাধিকার নেই। কারণ সেখান থেকে দেবতার পূজার জন্য পুষ্প চয়ন করা হয়। সেই উদ্যান যাতে কোনো অস্পৃশ্যের স্পর্শে কলুষিত না হতে পারে সেদিকে তীè দৃষ্টি রাখা হয়। কর্মীদের লাগানো হলো ফলদ উদ্যান আর অন্নজ্জ(সবজি) উদ্যানে আগাছা পরিষ্কারের কাজে। ফলদ উদ্যানে পনস(কাঁঠাল), কপিত্থ(কয়েত বেল), আতাফল, দাড়িম্ব(ডালিম), নারিকেল, কলা, তাল জাতীয় বৃই বেশি। সন্নিহিত অন্নজ্জ উদ্যানে পানিফল, কেশুর, পটল, ডাঁটা, অলাবু(লাউ), বাতিঙ্গন(বেগুন), করবেল(করলা), মূলক(মূলা) আর কুষ্মাণ্ডের(চালকুমড়া) সমারোহ। এখানে কাজ করতে করতে পাশাপাশি দাঁড়ানো আটটি ছোট ছোট কিন্তু অসাধারণ সৌকর্যমণ্ডিত ইষ্টকনির্মিত বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ মাঠের মধ্যে ছবির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে লোহিত ইষ্টকের বাড়িগুলি। কাজ করতে করতে মল্ল চাপাকণ্ঠে পপীপকে বলেÑ আমি একটা কাজে যাচ্ছি। তুই ভয় পাবি না। যেভাবে কাজ করছিস সেভাবেই কাজ করে যাবি। আমাকে খুঁজবি না। আর অন্য কারো সঙ্গে পারতপে কোনো কথা বলবি না।
একটু থেমে আবার বলেÑ ঐ যে ইষ্টকের বাড়িগুলি দেখছিস! সেখানে এই মন্দিরের দেবদাসীরা থাকে। আমি তাদের একজনের কাছেই যাচ্ছি।
দেবদাসী কী কাকা? জিজ্ঞেস করার পরে হঠাৎ নিজেই উত্তর পেয়ে গেছে মনে করে জ্বলজ্বলে চোখে তাকায় পপীপ। বলেÑ ঐ তারা, যাদের কাছে পুঁথি আছে তাই না? তারাই আমাকে পুঁথি পাঠ করাবে তাই না কাকা?
মল্লর মুখে অদ্ভুত এক নিঃশব্দ হাসি ফুটে ওঠে। সে পপীপের একথায় কোনো উত্তর করে না। শুধু বলে- আমি চললাম। তুই সাবধানে থাকিস!
তারপর পপীপের সম্মতির অপো না করেই ছুটে চলে যায় একদিকে। কিছুণ পরেই তাকে গাছগাছালির আড়ালে হারিয়ে যেতে দেখে পপীপ।
হঠাৎ করেই নিজেকে এত অসহায় আর একাকী মনে হতে থাকে পপীপের যে, যে মাটির ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে, সেই মাটিকেও মনে হলো তার মতোই ভয়ে মৃদু মৃদু কাঁপছে। যে আগাছাটিকে টান মেরে উঠিয়ে আনবে বলে মুঠোয় ধরেছিল, হঠাৎ মনে হলো সেটা একটা কেউটে সাপ। আঁতকে উঠে হাত থেকে আগাছাটিকে ছেড়ে দিল সে। থরথর করে কাঁপছে। প্রাণপণে মল্লর মুখ মনে করার চেষ্টা করছে সে। মল্লকাকা তার কাছে সাহস আর শৌর্যের প্রতীক। তার মুখ মনে পড়লে আপনা-আপনিই ভয় দূর হয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে শত চেষ্টাতেও কিছুতেই পপীপের মনের জমিতে ফুটে উঠছে না মল্লর সেই বরাভয়মাখা মুখের ছায়া। উল্টো তার মনের চোখে ভেসে উঠছে সেই দুই রাজপুরুষের ছবি যারা তাকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে নির্বাসন দিয়েছে এই অচেনা জগতে। এখানে মল্লর ছায়ায় থেকে থেকে এই কয়েক মাসেই এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে তার বিন্দুমাত্র অনুপস্থিতি তার মন থেকে ছিনিয়ে নেয় নিরাপত্তার ন্যূনতম অনুভূতিটুকুও। একবার পপীপের মনে হলো গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু ভীতি তার বুকে এমনভাবে জমাট বেঁধে ফুলে উঠেছে যে তার কণ্ঠ পর্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টাতেও কোনো শব্দই ফুটল না পপীপের মুখে। তখন হঠাৎ মনে হলো সে মারা যাচ্ছে। উজ্জ্বল হলুদাভ রোদ্দুরের আলোতে হাসতে থাকা প্রকৃতি তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে। সে নিজেকে এতণ কষ্ট করে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এখন আর সেই কষ্টটুকু করতেও তার ইচ্ছে করছে না। সে নিজের পা দুটোকে মুক্তি দিয়ে দিল দেহের ভার বহনের দায়িত্ব থেকে। তখন অনুভব করল ধীরে ধীরে ঘাসে ঢাকা মাটি তার চোখের কাছাকাছি চলে আসছে। তার এক ধরনের বিশ্রামসুখ অনুভূত হচ্ছে। বুঁজে আসছে চোখের পল্লবদুটিও। সে টের পাচ্ছে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে তার শরীরের কাঁপুনি। তার পরিবর্তে শরীরজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে এক ধরনের নিশ্চেষ্টতার সুখানুভূতি। পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যাওয়াও তাহলে বেশ সুখেরই ব্যাপার! সে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সমর্পণ করল সেই অনুভূতির কোলে। যেন সে ঝড়ের মুখে পড়া অরতি একটা করঞ্জতেলের প্রদীপ। ঝড়ের সাথে আর না যুঝে নিজেকে নিভে যেতে দিচ্ছে।
তার বাবা এক অন্ধকার সন্ধ্যায় রামশর্মার ঝুপড়িতে শুয়ে শুয়ে তাকে গল্প শোনাচ্ছিল। বাবা বলছিল যে নিয়তির সাথে কেউ যুঝতে পারে না রে বাপ! নিয়তি মানে সেই জিনিস, যা ঘটবেই। যাকে রোধ করা সম্ভব নয়। যেমন আকাশ থেকে যখন বিজলি নেমে আসে তাকে মেনে নিতে হয়। যখন ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় তাদের ঝুপড়িগুলোকে, তখন সেই ঝড়কে থামানোর সাধ্য তো কারো থাকে না। তাই তখন তাকে মেনে নিতে হয়। সেই রকমই, তারা এখন রামশর্মার ইক্ষুক্ষেতের ক্রীতদাস। এটি তাদের নিয়তি। এটিকে মেনে নিয়েছে বলেই বট্যপ এবং তার মতো অন্যরা এখনো বেঁচে থাকতে পারছে। মেনে না নিলে হয় মরতে হতো, নয়তো পাগল হয়ে যেতে হতো। মাঝে মাঝে মেনে নেওয়ার মধ্যেও এক রকমের সুখ সুখ ভাব থাকে রে বাপ। বট্যপের মনে আছে, সে একবার হাইলা কৈবর্তদের সাথে নৌকায় গিয়েছিল মাছ ধরতে। তখন নদী শ্রাবণ মাসের ভরা পোয়াতি। একপাড় থেকে আরেক পাড় দেখা যায় না। হঠাৎ উঠল ঝড়। আর নদী আরো উঠল ফুঁসে। একরত্তি নৌকা এক ঢেউয়ের বাড়ি খেয়েই চিৎপটাং। তাদেরকে ঝড়ে-মাতাল নদীর মধ্যে নিপে করে নৌকা নিমেষে চলে গেল কোন দিকে কে জানে। তখন বাঁচার জন্য অবিরাম সাঁতরাচ্ছে বট্যপ। কিন্তু কোনদিকে যাবে সে! অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না কোনদিকে নদীর পাড়। বোঝাই যাচ্ছে না কোনদিকে কূল আর কোনদিকে অকূল। তখন ভীতি-কান্তি মিলে বট্যপের স্রোতের সাথে, ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি নিঃশেষ। কিন্তু তখনো বাঁচার জন্য বুকের মধ্যে ভীষণ আকুতি। তাই তার কষ্টও বেশি। এই রকমভাবে যুদ্ধ করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিল বট্যপ। হাত-পায়ে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে হাত-পা দুটোকেই নাড়ানো বন্ধ করে দিল। চোখ খুলে এতণ অন্ধকারের মধ্যেও নদীর কূল খোঁজার চেষ্টা করছিল। এবার চোখদুটোকেও বুঁজে ফেলল। বিশ্রাম নিতে দিল দুই চোখের পাতাকে। শরীরের সব পেশিকে ঢিল করে দিয়ে মনে মনে বলল, ঝড়ের দেবতা, এখন তুমিই আমার নিয়তি। আমি মেনে নিলাম তোমার ইচ্ছাকে। আর মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তার সকল কষ্ট। বাতাসে ভেসে বেড়ানো কার্পাসের মতো হালকা হয়ে গেল তার শরীর। সে এমনকি ঘুমিয়েও পড়ল। পরে যখন ঘুম ভাঙল, দেখল সে মরে যায়নি। নদীর স্রোত আর ঝড়ের উথালপাতাল ঢেউ নিজেই তাকে বয়ে নিয়ে এসে ফেলে রেখেছে অচেনা এক গাঁয়ের মাটিতে।

পপীপের নিজেকে এখন মনে হচ্ছে সেই ঝড়ে উত্তাল নদীর স্রোতের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া বাবার মতো। তারও দুই চোখে নেমে আসছে শান্তির ঘুম। তারও মন জুড়ে এখন নিয়তিকে বিনাপ্রশ্নে  মেনে নেবার স্বস্তি। সে আলতোভাবে নড়ে-চড়ে এমনভাবে শুয়ে পড়ে, যেন উদ্যানের মাটি তার জন্য এখন নরম শয্যা হয়ে গেছে। সে পুরোপুরি উপুড় হয়ে গাল ঠেকিয়ে রাখে কোমল মাটির বুকের সাথে। আহ, নিজেকে পুরোপুরি ভাগ্য-ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দিলেও এতটা শান্তি পাওয়া যায়!

কিন্তু কে যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে তার নাম ধরে!
সেই ডাক কানে এলেও ঠিকমতো যেন শুনতে চায় না পপীপ। সে বরং পাশ ফিরে শরীরকে আরো শিথিল করে আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে চায়।
কিন্তু নাছোড় সেই কণ্ঠ। আবারও ডাক ভেসে আসে পপীপের নামে।
এবার পপীপ বেশ বিরক্ত হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বরের প্রতি। সেই কণ্ঠকে এড়ানোর জন্য কানকেও যেন ঠেসে ধরতে চায় মাটির সাথে।
তবু ডাক আসছেই।
চরম বিরক্তি বোধ করে পপীপ। এমন সুখের মুহূর্তে কোনো আহ্বানে সাড়া দিতে মোটেই ইচ্ছা করছে না তার। কিন্তু দূরের সেই কণ্ঠও ভীষণ একগুঁয়ে। বিরতিহীন ডেকেই চলেছে তাকে। সেই আহ্বান প্রথমে মস্তিষ্কের এক কোণে একটু রিনিঝিনি তুলেছিল। কিন্তু এখন সেটি তীব্রতায় বেড়ে চলেছে। ঝনঝন করে বাজছে তার কানের তন্ত্রীতে। তখন আর সাড়া না দিয়ে উপায় থাকে না পপীপের। সে চোখ মেলতে বাধ্য হয়।
তার চোখের ওপরে ঝুঁকে রয়েছে মল্লর অবয়ব। সে ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করে। মল্ল তাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়। হেসে বলেÑ ঘুমিয়ে পড়েছিলি! অবশ্য আমারও একটু দেরি হয়ে গেছে বটি। চল!
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মনে মনে বলে পপীপÑ তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে যেও না কাকা! তুমি কাছে না থাকলে এত ভয় করে! সেই ভয়কে আমার মরণের মতন কষ্ট মনে হয়!
কিন্তু মুখে বলা হয় না।
সে যন্ত্রের মতো মল্লকে অনুসরণ করে।
মল্ল হাঁটছে সেই ইষ্টকনির্মিত সুরম্য বাড়িগুলির দিকে। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই পরিবর্তন করে দিক। সপাট পথ ছেড়ে ঘুরে ঘুরে চলে সে। কখনো ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে, কখনো খোলা জায়গায় গুড়ি মেরে। পপীপ বুঝতে পারেনি যে তারা এখন চলছে ঐ বাড়িগুলির পেছনের অংশের দিকে। শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ে মল্ল। বহু বছরের পুরনো একটা আম্রবৃরে প্রকাণ্ড কাণ্ডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে পপীপকে বোঝায় যে কোনো রকম শব্দই এখন করা চলবে না।
চারদিকে নৈঃশব্দ। সেই নৈঃশব্দের সঙ্গে নিজেরাও নিস্তব্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। মনে হয়, তারাও এখন প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছেÑ কে কতণ কোনো শব্দ না করে প্রহর কাটাতে পারে।  
কিছুণ পরে খুব মৃদু একটা শব্দ পাওয়া যায়। ঘাসের ওপর কাঠবিড়ালি কিংবা খরগোসের হেঁটে যাওয়ার মতো সতর্ক পায়ের শব্দ। সেই শব্দ তাদের কাছাকাছি এসে থামে। জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া-ছাড়ার শব্দ পাওয়া যায়। তারপর মৃদু কিন্তু ব্যাকুল একটি নারীকণ্ঠ ভেসে আসে- মল্ল! মল্ল কোথায় তুমি?
মল্ল আম্রকাণ্ডের আড়াল ছেড়ে নিজেকে উন্মুক্ত করামাত্র একটি যুবতী যেন উড়ে এসে আলিঙ্গন করে মল্লকে। বেতসলতার মতো কাঁপছে যুবতীশরীর। নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় ফুঁপিয়ে উঠছে থেকে থেকে। প্রচণ্ড জোরে আলিঙ্গন করে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে মল্লর গণ্ডদেশে, গালে, কপালে, বুকে। থেকে থেকে কথা বলছে- মল্ল তুমি এসেছ! পৃথিবীর পুরুষশ্রেষ্ঠ তুমি এসেছ! আমার মল্ল তুমি আমার কাছে এসেছ! ফিরে এসেছ তোমার প্রণয়িণীর কাছে! ফিরে এসেছ তোমার চরণদাসীর কাছে!
মল্ল কয়েকটি প্রতিচুম্বন করে। কিন্তু সে অনেক ধীর-স্থির। মনের মধ্যে আবেগ থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বোঝা যায়। সে যুবতীর কানের লতিতে চুমু খায়। তবে একই সাথে সে যুবতীর কানে কানে কিছু একটা বলারও চেষ্টা করে। কিন্তু যুবতী তার কথা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। সে মল্লকে আরো জোরে চেপে ধরে আরো বেশি করে চুম্বন শুরু করে। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে তার ফোঁপানির শব্দও। এবার মল্ল শক্ত হাতে চেপে ধরে যুবতীর দুই বাহুমূল। তারপর তার মুখের একেবারে কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে কয়েকটি বাক্য। যুবতী এবার ছিটকে সরে দাঁড়ায়। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আম্রকাণ্ডের একপাশে অপেমান পপীপের দিকে। যুবতীর গণ্ডদেশে এখন স্পষ্ট লজ্জার লাল আভা। মল্ল মৃদু হেসে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে কিছু বলে যুবতীকে। তারপর পপীপও যাতে শুনতে পায় এমন ভাবে কণ্ঠ উঁচিয়ে যুবতীকে বলে- আমাদের তোমার গৃহে ডাকবে না ঊর্ণাবতী?
হেসে ফেলে যুবতী। অনেক সহজ হয়ে এসেছে এখন। পপীপের দিকে হাত বাড়ায়Ñ এসো!
তার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করে পপীপ এবং মল্ল। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল পপীপ। এত সুন্দর কোনো ঘর হতে পারে! এত সুচারুভাবে সজ্জিত কোনো বাড়ি হতে পারে! দেয়ালে দেয়ালে মনোলোভা রঙের আবরণ। কুলুঙ্গির ওপরে তিনদিকেই জানালা কাটা। যাতে আলো ঢুকতে পারে সবদিক থেকে। আবার আলো প্রবেশের পথ বন্ধ করার জন্য, কিংবা প্রয়োজনমতো আলোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মোটা কাপড় ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে গবাগুলোর পাশে। সেগুলি টেনে দিলেই ক ঢেকে যাবে সুস্ন্গ্ধি আবছা অন্ধকারে। ঘরের এক কোণে বিশাল কারুকাজ করা পালঙ্ক। সেখানে মনে হয় পেতে রাখা হয়েছে পালকের শয্যা। তার পাশে সুদৃশ্য আলম্বন(আলনা)। ঘরের মানুষের কাপড়চোপড় সেখানে সুচারুরূপে সজ্জিত। আর যুবতীর দিকে তাকিয়ে পপীপ আবার অনুভব করল সৌন্দর্যের আভা কাকে বলে। দূর থেকে স্বর্ণমণ্ডিত মন্দিরচূড়া দেখে যেমনটা অভিভূত হয়েছিল পপীপ, যুবতীর সৌন্দর্যও অনেকটা তারই কাছাকাছি, তবে স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি এনে দিল তার মনে।
যুবতী তাদের বসতে দেয় কারুকাজ করা নরম আসনে। ইতোমধ্যে ঘরে ঢুকেছে আরো তিনজন যুবতী। তাদের দিকে তাকিয়ে ঊর্ণাবতী বলেÑ সম্মুখের দ্বার বন্ধ করে রাখ। কেউ যেন টের না পায় আমার গৃহে অন্য মানুষ এসেছে।
যুবতীর এক সহচরী হেসে বলে- অন্য মানুষ বলছ কেন? বলো মনের মানুষ এসেছে।
আরক্ত ঊর্ণাবতী বলেÑ আচ্ছা তাই হলো। বালকের সামনে যা তা বলিস না আর! যা দ্বার বন্ধ করে দে। আগামী কয়েকটি দিন সতর্ক থাকতে হবে।
সোনার মতো চকচকে মঙ্গলঘটে জল আসে। জলপাত্র হাতে নিয়ে ঊর্ণাবতী নৃত্যের ভঙ্গিমায় উবু হয়ে বসে মল্লর দিকেÑ তোমার পা বাড়িয়ে দাও!
থাকুক না! আমি নিজেই পা ধুয়ে নিতে পারব।   মল্ল বলে একটু সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে।
না থাকবে না! যুবতী বলে জেদীকণ্ঠে।
যেন নিতান্ত বাধ্য হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে দুই পা বাড়িয়ে দেয় মল্ল।
পপীপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। পরম যত্নে জল ঢেলে মল্লর পা ধুয়ে দিল ঊর্ণাবতী। তারপর প্রথমে পরনের বহুমূল্য শাড়ির আঁচল দিয়ে, পরে নিজের মাথার মেঘরাশির মতো চুল দিয়ে মুছে দিল মল্লর পা।
মল্ল একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকাচ্ছে পপীপের দিকে। কিন্তু পপীপের চোখে মুগ্ধতা। ঊর্ণাবতী যা করছে, এটা কি ভালোবাসার চিহ্ন, নাকি আনুগত্যের চিহ্ন, নাকি এটাই আর্যদের নিয়ম? যেটাই হোক না কেন, এর ভেতরে যে সুচারু এবং সোচ্চার আত্মনিবেদন রয়েছে, পপীপকে মুগ্ধ করেছে সেটাই। পপীপ এটাও দেখতে পায় যে ঊর্ণাবতীর বিশাল দুই আয়ত চোখের পাতা ভেজা ভেজা। এ কী অন্তরের আনন্দের চোখের বাষ্প হয়ে বেরিয়ে আসা! মল্লকাকা বলেছিল সে দেবদাসীদের কাছে যাচ্ছে। ঊর্ণাবতীও কি দেবদাসী? দেবদাসীরা এত সুন্দরভাবে মানুষের সেবা করে! তাহলে তো তারা ভালো মানুষ। তাহলে কৈবর্ত ছাড়াও ভালো মানুষ আছে!
মল্লর পদসেবা শেষ করে একজন সহচরীকে ডাকে ঊর্ণাবতী- যুথিকা তুই এই বালককে অতিথি কে নিয়ে যা। ওর শরীর প্রালনের জন্য যা যা লাগে দিবি। তারপর জলখাবার দিস।
পপীপের দিকে ফিরে ঊর্ণাবতী স্নেহমাখা সুরে বলে- যাও বাবা তুমি তোমার এই মাসির সাথে যাও!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন মল্লও। পপীপের সামনে এমন পরিস্থিতিতে ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠছিল সে। তাড়াতাড়ি সায় দেয় ঊর্ণাবতীর কথায়- যা পপীপ। কোনো ভয় নেই। আমি এই ঘরেই আছি। তুই মাসির সাথে যা। খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম কর। তারপর তোর পাঠ শুরু কীভাবে কী করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করা যাবে।
পপীপকে সঙ্গে নিয়ে যুথিকা বেরিয়ে যেতেই আরেক সহচরী সীমন্তিনীকে আদেশ করে ঊর্ণাবতী- সম্মুখের দ্বারে লোহিত উড়নি টাঙিয়ে দে।
দেবদাসীর দ্বারশীর্ষে লোহিত উড়নির অর্থ হচ্ছে দেবদাসীর চান্দ্রমাসিক ঋতু শুরু হয়েছে। এই পাঁচ বা ছয়দিন সে অস্পৃশ্যা। যে কয়দিন লাল কাপড় দেখা যাবে সেই কয়েকদিন কোনো মহাজন ব্যক্তি আসবে না দেবদাসীর সেবা নিতে। দেবদাসী নিজেও যেতে পারবে না মন্দির প্রাঙ্গণে। ঋতুকালে দ্বারশীর্ষে লোহিত বস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা এখানকার বিধান। এতদিন এই বিধানকে অপমানজনক এবং তীব্র আপত্তিকর বলে মনে করে এসেছে ঊর্ণাবতী। কিন্তু আজ মনে হয় এই বিধান তার জন্য পরম উপকারী। এই বিধানের কারণেই মল্লকে সে নিবিড় করে পাবে কয়েকটি দিনের জন্য।
ঊর্ণাবতীর লাল উড়নি সেঁটে দেবার কথা শুনে আঁতকে ওঠার ভান করে মল্ল। তার মানে তো পাঁচ-সাতটি দিবস-রাত্রির ব্যাপার। অতগুলি দিন আমি কীভাবে এখানে থাকব ঊর্ণাবতী? আমার যে অনেক কাজ! আমাকে অবিলম্বে বরেন্দিতে ফিরতে হবে। সেখানকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। দিব্যোক সংবাদ পাঠিয়েছে গোপন বার্তাবাহকের মাধ্যমে। দিব্যোক চায় আমি এখন সেখানে থাকি। তার পাশে থাকি।
যত কাজই থাকুক, তোমাকে অন্তত আগামী পাঁচটা দিন থাকতেই হবে! পাঁচটা দিন পরেই নাহয় তুমি বরেন্দিতে গেলে। বলতে বলতেই চোখ সজল হয়ে উঠল ঊর্ণাবতীরÑ জন্মপাতকিনী আমি! সারা বছর ধরে কলুষিতা হই। তুমি মাঝে মাঝে এসে আমাকে শুদ্ধি না দিয়ে গেলে আমি বাঁচব কী নিয়ে!
কে বলেছে তুমি কলুষিতা? ত্রিস্রোতা নদীর জলে কত পাষণ্ডই তো জলক্রিড়ায় নামে, স্নান করতে নামে, নদীতে মাছ ধরতে নামে। তাই বলে কি ত্রিস্রোতা কোনোদিন অপবিত্রা হয়? তাই বলে ত্রিস্রোতার আধ্যাত্মিক পবিত্রতা কি ক্ষুন্ন হয়েছে? অযুত-নিযুত মানুষের কাছে ত্রিস্রোতা তো এখনো গঙ্গার মতোই দেবী রূপে পূজিতা। অযুত মানুষ তো গঙ্গার মতো করে ত্রিস্রোতারও স্তব করে অহোরাত্র। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে যে জীবন তোমাকে বয়ে চলতে হচ্ছে, সে জীবনের কোনো দোষ তো তোমার নামে লিপিবদ্ধ হতে পারে না।
কিন্তু তবু আমি কিছুতেই সইতে পারছি না এই দেবদাসীর জীবন। লোকে জানে যে, আমরা দেবদাসীরা পূজার সময় আর দেবতার আরতির সময় নৃত্য করি। লোকে জানে যে আমরা দেব-দেবীর সেবায় নিয়োজিতা। অথচ বাস্তবে আমরা দিবারাত্রি ভোগ্যা হই পুরোহিত, সেবায়েত আর অভিজাতদের। আমার বাবা-মাকে বোঝানো হয়েছে আমি দেবতার দাসী। দেবতার প্রতি নিবেদিতা। কন্যাকে দেবদাসী বানানোর বিনিময়ে তারা পেয়েছে পরকালে অয় স্বর্গবাসের নিশ্চয়তা। আর আমি জ্বলে মরছি এই নরককুণ্ডে। তুমি আমাকে মুক্তি দাও মল্ল! আমাকে নিয়ে চলো এই নরক থেকে!
নিয়ে যাব ঊর্ণাবতী! অবশ্যই নিয়ে যাব। যেদিন আমাদের বরেন্দিকে আমরা মুক্ত করতে পারব, যেদিন আমাদের বরেন্দি আবার আমাদের নিজেদের হবে, সেদিন সেই মুক্ত বরেন্দিতে তুমিও পাবে একটা সত্যিকারের মুক্ত জীবন। সেদিন আমি তোমাকে নিয়ে যাব এখান থেকে। নিয়ে যাব আমার মুক্ত বরেন্দিতে।
নির্দ্বিধায় মল্লর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে ঊর্ণাবতী। এই সময় বোধকরি তার মনে পড়ে পপীপের কথা। মল্লর কাছে জানতে চায়Ñ তোমার সঙ্গের বালকটি কে?
ওর নাম পপীপ। ও তোমার কাছে লেখাপড়া শিখবে।
আমার কাছে কেন? তুমি নিজেই তো ওকে লেখাপড়া শেখাতে পারো!
তোমাকে তো বললামই যে আমাকে অবিলম্বে বরেন্দিতে যেতে হবে।
মৃদু হাসে ঊর্ণাবতীÑ আমি কী আর তোমার মতো করে ওকে শেখাতে পারব!
পারতেই হবে ঊর্ণাবতী!


মল্লর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে এতণের তরল পরিবেশ হঠাৎ ভারি হয়ে যায়। আর মল্লর কণ্ঠস্বর শুনেই ঊর্ণাবতী বুঝে যায়, পপীপকে লেখাপড়া শেখানোর কাজটি তার কাছে কতটা গুরুত্ববহ। সে সঙ্গে সঙ্গে মল্লর আরো কাছে সেঁটে আসে। কোমল হাতের আশ্বস্তকারী চাপ দেয় মল্লর বাহুতে। মুখে বলেÑ তুমি কিছু ভেব না! আমি যতটা পারি লেখাপড়া শেখাব পপীপকে। আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারো!
আবার কোমল হয়ে আসে মল্লর চোখের দৃষ্টিÑ তোমার ওপর আস্থা রাখি বলেই তো তোমার কাছে এসেছি। পপীপ লিখতে-পড়তে শিখেছে বেশ তাড়াতাড়ি। কিন্তু যেটুকু শিখেছে, সব মাটিতে আঁক কষে শেখানো। সে কোনোদিন পুঁথির অবয়ব দেখেনি। তোমার কাছে রাখা পুঁথিগুলোর পাঠ তো তুমি ওকে শেখাবেই, সেই সঙ্গে শেখাবে বেদ-রামায়ণ-মহাভারত। মনু-সংহিতা তো অবশ্যই পাঠ করাতে হবে। শেখাতে হবে গণিত। অশ্বঘোষের নাট্যকলার পাঠও দিতে হবে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ঊর্ণাবতী। কারণ পপীপ হবে ভবিষ্যতে কৈবর্তজাতির মুখপত্র। পারবে না কাজটা করতে? এক বছর লাগুক, দুই বছর লাগুক, পাঁচ বছর লাগুক- কাজটি করতেই হবে ঊর্ণাবতী!
তুমি আদেশ করেছ, আর ঊর্ণাবতী সেটা পালন করবে না- তাই কোনোদিন হতে পারে। অবশ্যই তোমার আদেশ প্রতিপালিত হবে যথাযোগ্য মর্যাদায়। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
কী?
পপীপ কোথায় থাকে? সে কীভাবে প্রতিদিন পড়তে আসবে আমার কাছে?
মল্লর চোখে-মুখেও এবার অস্বস্তির ছায়াপাত ঘটে। বলে- পপীপ যেখানে থাকে, সেই জায়গা  এখান থেকে অনেক দূরে।
কোথায়?
সে থাকে রামশর্মার ইক্ষুক্ষেত। তার বাবা এবং সে রামশর্মার ক্রীতদাস।
মল্লর চোখে-মুখে ঘোর দুশ্চিন্তার ছায়া। এই সমস্যাটা যে কীভাবে সমাধান করবে, তা এখনো ভেবে উঠতে পারেনি সে। একবার ভেবেছে পপীপকে এখানেই লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু তা যে কতদিন রাখা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ রামশর্মার সাম্রাজ্যে একসময় পপীপের খোঁজ পড়বেই। তখন রামশর্মা ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দেবে যে তার এক বালক ক্রীতদাস পালিয়েছে আখতে থেকে। ঢ্যাঁড়া শুনে শুনে বালকের অবয়বের বর্ণনা মুখস্ত হয়ে যাবে লোকের। তখন যে কেউ একবার দেখেই চিনে ফেলবে পপীপকে। তখন পপীপকে রামশর্মার লোক ধরে নিয়ে তো যাবেই, সেইসঙ্গে চরম বিপদে পড়ে যাবে ঊর্ণাবতীও।
আরেকটি উপায় ভেবেছিল মল্ল। বরেন্দিতে দিব্যোকের কাছে লোক পাঠিয়ে বা এখানকার কোনো ধনশালী বন্ধুর কাছ থেকে অর্থ সর্ংগ্রহ করে পপীপকে রামশর্মার ক্রীতদাসত্ব থেকে ছাড়িয়ে নেবে। অর্থ সংগ্রহ করা মল্লর জন্য খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু কঠিন হয়ে যাবে রামশর্মাকে সম্মত করানো। সে যদি তার ক্রীতদাসকে অন্যের কাছে বিক্রি করতে না চায়, তাহলে তো কামরূপের রাজারও সাধ্য নেই পপীপকে মুক্তি দেওয়ার।
এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেকদিন ধরে ভেবেছে মল্ল। কিন্তু কোন পথে যে এগুবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনো গ্রহণ করতে পারেনি।
এই মুহূর্তে ঊর্ণাবতী বিষয়টিকে ফের উত্থাপন করায় সে আবার সেই চিন্তাতেই ডুবে যায়। তাকে কিছুণ চিন্তা করার সুযোগ দেয় ঊর্ণাবতী। তারপর দুই মৃণাল বাহুতে পেঁচিয়ে ধরে মল্লর কণ্ঠ। এই হঠাৎ বেষ্টনীর চাপে একটু চমতে ওঠে অন্যমনস্ক মল্ল। তারপর সম্বিত পুরোপুরি ফিরে পেয়ে হেসে ফেলে।    
হাসছে ঊর্ণাবতীওÑ এটি  অবশ্যই একটা বড় সমস্যা। কিন্তু তাই বলে এখানে বসে শুধু সেই সমস্যার কথা ভেবে ভেবেই প্রহর কাটিয়ে দেবে, তা তো হতে পারে না প্রিয়তম। আমাকেও একটু ভাবতে দাও। আশা করি আমি কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারব।
প্রশ্নবোধক ভুঁরু তুলে তার দিকে তাকায় মল্ল। একটু ম্লান হেসে ঊর্ণাবতী বলেÑ তোমার নাহয় আমাকে কোনো আকাক্সিতা রমণী বলে মনেই হয় না। কিন্তু জেনো, এই কামরূপ রাজ্যে সকলেই আমাকে তাদের সবচেয়ে আকাক্সিতা রমণী মনে করে। রামশর্মাও তাদেরই একজন।
হেসে ওঠে মল্ল- কী বললে? রামশর্মাও! এই বুড়ো বয়সেও!
ঊর্ণাবতীর ঠোঁটে এখন তিক্ত হাসি। বলে- একবার কেউ মা বলে ডাকলে সদ্য তরুণীও সেই মায়ের যথাযোগ্য আচরণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো কামমত্ত যুবক তো দূরের কথা, প্রৌঢ় বা বৃদ্ধকেও শতবার বাবা বলে ডাকলেও সে তখন তার কামতৃষ্ণা না মিটিয়ে ছাড়ে না।
একটু লজ্জিত হয় মল্ল। ধীরকণ্ঠে বলে- সত্যিই আমরা পুরুষরা খুবই খারাপ।
তার মুখে হাতচাপা দেয় ঊর্ণাবতীÑ না! কোনো সত্যিকারের পুরুষ কখনোই খারাপ হতে পারে না। যেমন তুমি। কিন্তু সত্যিকারের পুরুষ আর কয়টা আছে! চারপাশে যারা ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়, সেগুলি সবই তো কাপুরুষ।
মল্ল আগের প্রসঙ্গ থেকে সরতে চায় না। বলেÑ পুরুষ-কাপুরুষের আলোচনা এখন থাকুক ঊর্ণাবতী। তুমি বলো, পপীপের শিক্ষা সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়?
ঊর্ণাবতী বলে- সেটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। পথ আমি একটা ঠিকই খুঁজে বের করব।
সত্যি! ঝলমলে হয়ে ওঠে মল্লর মুখÑ এবার নিশ্চিন্ত হলাম। তুমি দায়িত্ব নিলে সমস্যার সমাধান হবেই হবে।
এবার পূর্ণদৃষ্টিতে ঊর্ণাবতীর মুখের দিকে তাকায় মল্ল। বলেÑ তোমার ঠোঁটে খুবই রহস্যময় এবং  দুষ্টুমিপূর্ণ হাসি দেখতে পাচ্ছি ঊর্ণাবতী!
অস্বীকার করে না ঊর্ণাবতী। শুধু জানতে চায়Ñ কেমন সেই হাসি শুনি!
কেমন হাসি! উত্তর দেবার আগে গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তার ভঙ্গি করে মল্ল। তারপর বলেÑ
প্রাতঃ কালাঞ্জনপরিচিতং ব্যী জামাতুরোষ্ঠং
কন্যায়াশ্চ স্তনমুকুলয়োরঙ্গুলীভস্মমুদ্রাঃ।
প্রেমোলাসাজ্জয়তি মধুরং সম্মিতাভির্বধূর্ভি
গৌরীমাতুঃ কিমপি কিমপি ব্যাহৃতং কর্ণমূলে। ।
শ্লোক শুনে হাসে ঊর্ণাবতী। বলে- এবার অর্থ শোনাও!
মল্ল বলেÑ অর্থ তো তুমি নিজেই জানো।
তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
মল্ল রসিয়ে রসিয়ে বলে- অর্থ হচ্ছে-“সকালে জামাইয়ের ঠোঁটে কালো কাজলের দাগ আর কন্যার দুই স্তনে ভস্মমাখা আঙুলের ছাপ দেখে আনন্দে উৎফুল হয়ে বউয়েরা হাসিমুখে গৌরির মায়ের কানে চুপি চুপি যা বলল, তা জয়যুক্ত হোক!”
খিলখিল করে হেসে ওঠে ঊর্ণাবতী- তার অর্থ তুমি বলতে চাও যে আমি এখন বাৎসায়ন-চর্চার কথা ভাবছি?
না না ঠিক তা বলতে চাইনি।
না বলতে চাইলেও সেটাই সত্য। আমি এখন অন্য কোনো শাস্ত্রের কথা ভাবতেই পারছি না।
হয়! মল্ল কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলেÑ এরকম কখনো কখনো হয়। হতেই পারে!
হতে পারে নয় মহাশয়! হচ্ছে।
তা হোক।
এবার মল্লর আরো কাছে ঘেঁষে আসে ঊর্ণাবতীÑ তোমার এত বড় কাজ করে দেবার অঙ্গীকার করলাম আমি। বিনিময়ে তুমি আমাকে কোনো পুরস্কার দেবে না?
অবশ্যই দেব! বলো কী চাও তুমি?
কথা বলতে বলতেই প্রায় মল্লর গায়ের ওপর উঠে এসেছে ঊর্ণাবতী। মল্লও তাকে বুকে চেপে ধরেছে। অস্ফুট স্বরে ঊর্ণাবতী বলেÑ আগামী পাঁচটি দিন তুমি আমাকে তোমার ব থেকে বিশ্লিষ্ট করতে পারবে না!
আমি সম্মত।
তাহলে চলো!
পালঙ্কের দিকে মল্লকে আকর্ষণ করে ঊর্ণাবতী।
মল্ল দুইবাহুতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় ঊর্ণাবতীর তণু। তাকে পালঙ্কে স্থাপন করে নিজে হাঁটু গেড়ে বসে মেঝেতে। তারপর জোড়করে স্তব করে তার রূপের- হে হেমবর্ণে! তুমি পদ্মমাল্যধারিণী পদ্মিনীর ন্যায় বিরাজ করিতেছ। তোমার দন্তসকল সমচিক্কন, পাণ্ডুবর্ণ ও সূèাগ্র, নেত্র নির্মল, তারকা কৃষ্ণ ও অপাঙ্গ আরক্ত, তোমার নিতম্ব মাংসল ও বিশাল, উরু করিশুণ্ডাকার এবং স্তনদ্বয়Ñ উচ্চ, সংশিষ্ট, বর্তুল, কমনীয় ও তালপ্রমাণ, উহার মুখ উন্নত ও স্থূল, উহা উৎকৃষ্ট রত্নে অলংকৃত, এবং যেন আলিঙ্গনার্থ উদ্যত রহিয়াছে। তোমার কেশ কৃষ্ণ ও কটিদেশ সূè। তোমার কণ্ঠের মাল্য, তোমার অঙ্গের গন্ধ...
আর কথা বাড়াতে দেয় না ঊর্ণাবতী। কামজ্বরপূর্ণ কণ্ঠে আহ্বান জানায়Ñ দেবী তোমার স্তুতিতে তুষ্ট হয়েছেন। এবার এসো সাধক! তোমার প্রাপ্য বর গ্রহণ করো!

১৩. দর্পণে ঊর্ণাবতী

প্রতিবিম্ব তাকে বলে- দ্যাখো তুমি কী সর্বনাশা সুন্দর! ঊর্ণাবতী তুমি কেন এতটা সুন্দরী? হরিণীর মাংসই যে শত্রু তুমি কেন শুনেও শোনোনি!
এই যে খুলে নিলাম কেয়ূর তোমার। তবু তুমি সমান সুন্দর!
এই যে খুলে নিলাম কণ্ঠিকা তোমার। তবু তুমি সমান সুন্দর!
এই যে খুলে নিলাম দেবচ্ছন্দি হার তোমার। তবু তুমি সমান সুন্দর!
এই যে খুলে নিলাম কানের কুণ্ডল। তবু তুমি সমান সুন্দর।
এলোমেলো করে দিলাম হংসপদিকা সিথিপাটি। তবু তুমি সমান সুন্দর!
বিলুপ্ত করে দিলাম কপালের টিপ। তবু তুমি সমান সুন্দর।
জলঘষে মুছে দিলাম চোখের কাজল। তবু তুমি সমান সুন্দর।
ঊর্ণাবতী ঊর্ণাবতী এই সৌন্দর্য নিয়ে তুমি কোথায় আশ্রয় পাবে! তোমার পিতাও তোমাকে পারেনি দিতে আশ্রয়। হায় ঊর্ণাবতী তোমার সৌন্দর্যই তোমাকে এনেছে এখানে।
তুমি কেন হতে গেলে তিলোত্তমা সখি?
তিলোত্তমা! তিলোত্তমা!
দেবগণ এবং মহর্ষিগণের প্রার্থনায় ব্রক্ষ্মা বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিলেনÑ তুমি এমন এক প্রমদা সৃষ্টি করো, যার সৌন্দর্য দেখে সকলেই তাকে কামনা করতে বাধ্য হবে।
বিশ্বকর্মা ত্রিলোকের স্থাবরজঙ্গম থেকে সর্বপ্রকার মনোহর উপাদান আহরণ করে এক অতুলনীয়া রূপবতী নারী সৃষ্টি করলেন। জগতের সকল উত্তম বস্তু তিল তিল পরিমাণে মিলিত করে সৃষ্ট। তাই ব্রক্ষ্মা  এই প্রমদার নাম দিলেন তিলোত্তমা।
তিলোত্তমা পৃথিবীতে যাওয়ার আগে দেবগণকে প্রদণি করল। ঘুরতে ঘুরতে তিলোত্তমা যেদিকে যায়, দেবতারা সব ভুলে সেদিকেই ঘুরে তাকান।
তিলোত্তমা যেদিকে যায়, সেদিকে দেখার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ব্রক্ষ্মার একটি করে মুখ নির্গত হয়। এইরূপে ব্রক্ষ্মা হয়ে গেলেন চতুর্মুখ।
ইন্দ্র এক মূহূর্তের জন্যও তিলোত্তমা থেকে নয়ন ফেরাতে পারলেন না। তাই তার হয়ে গেল সহস্র নয়ন।
শিব তিলোত্তমাকে দেখামাত্র সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেলেন। তাই তার নাম হলো স্থানু।
সেই তিলোত্তমা তুমি কেন নেমে এলে প্রাগ্জ্যোতিষ-কামরূপে?
মনে আছে, কিশোরী বয়স থেকে তুমি যেখানেই যেতে, সেখানেই শত-সহস্র চুর ভিড়? মনে পড়ে তোমাকে একটি বার শুধু দেখবে বলে তোমাদের অট্টালিকার সামনে যুবাদের মেলা।
নিজের শরীরের মাংসই হরিণীর মৃত্যু ডেকে আনে। আর তোমার রূপই ঊর্ণাবতী ডেকে এনেছে তোমার সর্বনাশ।
তোমার তো স্বয়ংবরা হওয়ার কথা ছিল। তোমার তো কথা ছিল কোনো যুবাসুন্দরের ঘরণী হওয়ার।
কিন্তু লজনের কামনার তুমি একজনের কণ্ঠলগ্না হয়ে যাবে, এতে ঘোর অসম্মতি তাদের, যারা সকলেই তোমাকে চায়। নগরীর দিকে দিকে শুধু তোমাকে নিয়েই গুঞ্জন। রাজ্যের কোণে কোণে শুধু তোমাকে পাওয়ার জন্য আলোড়ন।
অবশেষে সবার কামনা তোমাকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিতে সম্মত হলো। বলা হলো দেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী কখনো একজনের ভোগ্যা হতে পারে না। তাই তাকে হতে হবে দেবদাসী। পিতা তোমার জানতেন, দেবদাসীর প্রকৃত কাজ কী। তিনি ক্রোধান্বিত হন, সানুনয়ে নিজকন্যার এই সর্বনাশা নিয়তি রোধের জন্য রাজদ্বারে যান। কিন্তু লোলুপের দল তো তোমার পিতার চাইতে অনেক শক্তিমান। তাই তোমাকে শেষাবধি হতে হলো দেবদাসী।
তুমি মন্দিরের দেবদাসী। সেখানে তো দেবতারা থাকেন না। দেবতারা আসেন। শক্তি মদমত্ত দেবতারা। স্বয়ং মহারাজ আসেন, আসে তার কুমার যুবরাজও। শ্রেষ্ঠী-সার্থবাহ আসে, আসে তার যুবক পুত্রও। ব্রাক্ষ্মণ কুলীন আসে, আসে তার পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রের দলও।
তুমি পালাতে চাইলে এই নরক ছেড়ে।
কিন্তু কে তোমাকে আশ্রয় দেবে! তুমি যার আশ্রয়ে যাও, সে-ই নিজে ভক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমার ওপর।
মনে আছে অবশেষে এল সেই দিন?
সেদিন তুমি ছিলে উপবনের কাছে এক কোষ্ঠকে এক ঋষির আশ্রমে। কিন্তু সন্ধ্যা তার অবগুণ্ঠনে পৃথিবীকে আচ্ছাদন করার আগেই ঋষি এসে চাইল তোমার সঙ্গম। সঙ্গে তার চারজন যুবক শিষ্য। তুমি অবিশ্বাসে বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলে ঋষির দিকে। এরাই তবে ধর্মের সাধক! এরাই তবে জীতেন্দ্রিয় ত্রিলোকে! তুমি ছুটতে শুরু করেছিলে। পেছনে ছুটছিল পাঁচজন ধর্ষক। তারা তোমার শাটকের প্রান্ত ধরে টেনে টেনে খুলে নিয়েছিল তোমার শরীর থেকে। তখন তুমি অবারিত দেহ। তাই তোমাকে দেখে তাদের শিশ্নইন্দ্রিয় শতগুণে বেশি প্রজ্জ্বলিত। সেই সময় যেন আকাশ থেকে নেমে এল সত্যিকারের দেবতা। ধাওয়ারত ধর্ষকদের বলল তোমার পশ্চাদবধাবন না করতে। বলল তোমার লজ্জাবস্ত্র ফিরিয়ে দিতে। ধর্ষকামী ঋষি কানেই তুলল না তার কথা। তখন আহ্বান এল, এসো তবে যুদ্ধ করো! দেবতার হাতে পাঁচ পশুর নিধন দেখলে তুমি ঝোপের একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে। তুমি অবাক হয়ে দেখলে, দেবতা তোমার এসেছে নিষাদের বেশে।
শত্র“হনন শেষে বস্ত্রখণ্ড তুলে এনে কালো কষ্টিপাথরের দেবতা বললেনÑ ভদ্রে! আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রয়েছি। আপনি আপনার লজ্জা নিবারণ করে সামনে আসুন। তারপর আপনি যেখানে বলবেন, আমি সসম্মানে সেখানেই পৌঁছে দেব আপনাকে!
তুমি সামনে এলে। দুচোখ ভরে দেখলে দেবতাকে। যাদের আবাল্য ঘৃণা করতে শিখেছ তোমরা, সেই অনার্য কেউ এত সুন্দরও হতে পারে! তোমার চোখ সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তার চোখের দিকে। তার চোখ মাটিতে নিবদ্ধ। সে আবার বলেÑ আপনি কোথায় যাবেন?
তুমি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললে তোমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো আশ্রয়স্থল নেই।
সে তোমার জন্য খুঁজে আনল বুনোফল। কলার মোচায় তুলে আনল ঝরনার জল। তারপর সেই মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই শুনল তোমার দুর্ভাগ্যের কথা। তুমি সব বললে। কথা বললে আর কাঁদলে। কাঁদলে আর কথা বললে। জানালে, তুমি একমাত্র তাকেই ত্রাণকারী বলে মেনে নিয়েছ। এখন তোমার জীবন তার হাতে।
কেন এমন বলছেন ভদ্রে? সে অবাক হয়ে জানতে চাইল।
তুমি বলতে পারলে না সেই সত্য কথাটি। সেই কথাÑ এই প্রথম তোমার নারীদৃষ্টি একজন সত্যিকারের পুরুষকে দেখতে পেয়েছে। শুধু সকাতরে বললেÑ আমাকে উদ্ধার করো!
কালো দেবতা বললÑ আমি অন্য একটি কাজ নিয়ে বহুদূর বরেন্দি থেকে এসেছি। সেই দায়িত্ব থেকে সরে গেলে স্বজাতির কাছে সত্যভ্রষ্ট হবো। আমি কথা দিচ্ছি, আমার কার্য সম্পন্ন হলে, মুক্ত হলে আমার স্বজাতি, আমি অবশ্যই আপনাকে এনে দেব সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ। ততদিন আপনি ধৈর্যধারণ করুন।
    তোমার হৃদয় তখন জেনে গেছে, তুমি পেয়ে গেছ তোমার কাক্সিত পুরুষকে। তাকে তুমি হারাতে চাও না আর। কিন্তু সে যদি তোমাকে ঘৃণা করে! দেবদাসীরূপে বহুভোগ্যা তুমি।
ঘৃণা! সে অবাক হয়ে যায়। অসহায়কে কে ঘৃণা করতে পারে? ঘৃণ্য তো অন্যেরা, যারা এইভাবে অসহায়কে ব্যবহার করে। বরেন্দির প্রকৃত সন্তানরা কখনো কোনো মানুষকে ঘৃণা করে না ভদ্রে!
তাহলে তুমি আমাকে নাও! গ্রহণ করো আমাকে!
সে কিছুণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে। তারপর বলেÑ আমি তো বলেছি, দায়িত্ববদ্ধ আমি! সে দায়িত্ব সম্পন্ন করার আগে আমি আর অন্য কোনো দায়িত্ব নিতে পারি না।
দায়িত্ব নয়। ভালোবাসা নাও!
সে নিশ্চুপ থাকে।
তুমি তখন পাগলিনী প্রায়। এত বছরের পরে সত্যিকারের দয়িতের দেখা পেয়ে ছাড়তে চাও না তাকে। তাই তোমার আড়ষ্ট জিহ্বা এতখানি প্রগল্ভা হয়ে ওঠেÑ যদি তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ না করো, তাহলে বুঝব, আমার দেবদাসী পরিচয় তুমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারোনি! বহুভোগ্যা নারী বলেই শুধু আমাকে তুমি ঘৃণা করো। অথচ তুমি জানো, আমি অসহায়া। আমি স্বেচ্ছায় এপথে আসিনি। এক মুহূর্তও বাঁচতে চাই না এই পরিচয়ে।
মল্ল তখন হাত বাড়িয়ে দিল তোমার দিকেÑ আমি তোমার ভালোবাসা গ্রহণ করলাম। স্বদেশের সাথে সাথে মুক্ত করব তোমাকেও। তারপর তোমাকে ফিরিয়ে দেব তোমার সম্মানের স্থান! কথা দিলাম। আর জেনো ভূমিপুত্র কোনোদিন ফিরিয়ে নেয় না প্রদত্ত প্রতিশ্র“তি।       
    

১৪. গাভীন মেঘ ও লোলুপ জ্যোৎস্নার নিচে

গাঁওবুড়োদের মনে ভয় ছিল, দিনব্যাপী ভারি মেঘের বর্ষণ বোধহয় জ্যোৎস্নাকে ঢেকে ফেলবে। কিন্তু সন্ধ্যের আগেই কমতে কমতে একেবারে থেমেই গেল বৃষ্টি। আকাশে তখনো মেঘ ভাসছে। পোয়াতি রমণীর মতো জলভরা মেঘ। অথচ লগ্ন আসতে না আসতেই জ্যোৎস্না উঁকি দিল ঠিকই। উৎকণ্ঠিত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল গাঁওবুড়োরা। তাদের ঘোলা চোখগুলো জ্যোৎস্নার আলো খুঁজেছে লগ্ন শুরুর অনেক আগ থেকেই। শেষ পর্যন্ত তারা এল। লগ্ন এবং জ্যোৎস্নাÑ দুই-ই। প্রথমে মলিন মনে হচ্ছিল জ্যোৎস্নাকে। দুর্বলও। যেন তার এই আগমন একেবারেই অনিচ্ছুক আগমন। পানা পুকুরের বেশ তলায় পড়ে থাকা কৈবর্ত-কিশোরীর পিতলের নাকফুল যেমন আবছা দেখা যায়, সেই রকম আবছা ছিল জ্যোৎস্না। খুব ধীরে ধীরে আলগোছে আসছে। এমন সাবধানে হেঁটে আসছে যেন মেঘের সাথে ধাক্কা না লাগে। যেন জ্যোৎস্নার আলো মেঘের পেটকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলে কিংবা বাছুরের মতো গোমাতার পেটে ঢুঁস দিলেই বৃষ্টি গড়াতে শুরু করবে অঝোর ধারায়।
ধামসা বেজে উঠল ঢাক্ ঢাক্ ঢাক্ শব্দে।
শুরু হলো ত্রেপূজা।
গাঁওদেব-গাঁওদেবীকে সিঁদুর মাখানো হয়েছে। তাদের গায়ে ঢেলে দেওয়া হয়েছে ছাগদুগ্ধের অর্ঘ্যধারা। ধান-দূর্বা নিবেদন করা হয়েছে মন্ত্রপাঠ করে। কৈবর্তগ্রামের সবগুলি মাঠ-তে এখন জলভেজা সবুজ অঘন নরম ঘাসে ছাওয়া। সব ব্যবস্থা দেখে সন্তোষের হাসি গাঁওবুড়োদের মুখে।
শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। যাতে মাদল-ধামসার শব্দে তাদের ঘুম না ভাঙে, সেইজন্য ঘুম গাঢ় করার জন্য ঝিনুকে করে তাদের মুখে তুলে দেওয়া হয়েছে ধেনোমদ। কিশোর-কিশোরীদের বলে দেওয়া হয়েছে আজকের উৎসব তাদের জন্য নয়। অতএব তারা যেন আজ সন্ধ্যা থেকেই ঘরে থাকে। বাইরে বেরুনো তো চলবেই না, বাইরের দিকে উঁকিও দেওয়া যাবে না।
এবার বুড়ো-বুড়িরা গাঁওদেব-গঁওদেবীকে প্রণাম জানিয়ে, মাঠ-তে-প্রকৃতিকে প্রণাম জানিয়ে  নিজ নিজ ঝুপড়িতে গিয়ে ঢোকে। জ্যোৎস্নার অধিকার ছেড়ে দিল শুধুমাত্র যুবক-যুবতীদের জন্যই।
ধামসা-মাদল এবার বেজে ওঠে দ্বিগুণ শব্দ নিয়ে। এমন ঝংকারে শরীর দুলে উঠতে বাধ্য। মাঠের মধ্যে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক-যুবতীদের দেহ দুলতে শুরু করে মাদলের তালে তালে। ক্রমেই দ্রুততর হচ্ছে মাদলের ছন্দ। সেই অনুপাতে দ্রুততর হয়ে উঠছে যুবক-যুবতীদের অঙ্গ সঞ্চালনও। জ্যোৎস্না বেড়ে উঠছে। মাদলের শব্দে যেন চাঁদও আড়মোড়া ভেঙে পুরো মনোযোগের সাথে আলো ফেলে সেই আলোতে নৃত্যরত কৈবর্ত যুবত-যুবতীদের দেখছে। সে-ও যেন যোগ দিতে চায় এই উৎসবে।
মাঝরাতে লগ্ন। একেবারে নিখুঁত সময়ে চাঁদের গায়ে লেপ্টে এল ছোট্ট এবং পাতলা এক টুকরো মেঘ। চাঁদের আলো এর ফলে আরো মসৃণ, আরো মোহনীয় মায়াময়। এই মেঘই যেন সংকেতদাতা। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে ভেঙে গেল দলীয় নৃত্যের সমাবেশ। নাচতে নাচতেই প্রতিটি জুটি সমাবেশ থেকে পৃথক হয়ে চলে এল নিজ নিজ নির্ধারিত েেতর মধ্যবিন্দুতে। এবার হবে ত্রেপূজার চূড়ান্ত পর্ব। প্রতিটি যুবক-যুবতী এখন পরস্পরের মধ্যে প্রবেশের আকাক্সায় উন্মুখ। নাচতে নাচতেই নিখুঁত সঙ্গমাসনে শুয়ে পড়েছে যুবতীরা। শুয়ে শুয়েও শরীর দোলাচ্ছে। আজকের এই মিলন তো শুধুমাত্র দৈহিক মিলন নয়। এই মিলন হচ্ছে শস্যত্রেকে উদ্বুদ্ধ করার মিলন। যাতে শস্যত্রেও ঠিক সময়ে গর্ভিনী হয়। প্রসব করে পর্যাপ্ত শস্য-সন্তান। যাতে কৈবর্তরা থাকতে পারে মোটাভাতে-মোটাকাপড়ে বেঁচে-বর্তে। তারা ওলান ঠাকুরকে স্মরণ করে চূড়ান্ত মিলনে রত হতে যায়।

দ্র্গ্ িদ্রিগ্ দ্রিগ্!
শব্দটি বজ্রাহত করে দেয় পুরো কৈবর্ত উৎসবকে।
এখন কেন এই শব্দ বাজবে গ্রামপ্রান্তে? রাজপুরুষরা এই মধ্যরাতেও কেন এই পবিত্র পূজার লগ্নেও উপদ্রব করবে কৈবর্তদের?
শব্দের পাশাপাশি আলোও দেখা যায় এবার। মশাল জ্বলছে অনেক মানুষের হাতে। তারা এগিয়ে আসছে গ্রামের দিকে।
বিস্ময়ে-ত্রাসে নিথর পড়ে থাকে নারী-পুরুষের দল।
মশালের আলো কাছে এগিয়ে এলে ওরা উঠে দাঁড়ায়। নিজেদের অজান্তেই যেন সমবেত হয় গ্রামের মধ্যসীমার মাঠটিতে, যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ত্রেপূজা উৎসবের।
মশালের আলো আরো এগিয়ে আসে। কাদামাখা কালো নগ্ন শরীরগুলোতে সেই তীব্র আলো ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফেরত আসে। শুধু চকচকে সাদা চোখগুলো দেখা যায়। সেগুলো ক্রমেই রক্তাভ হয়ে উঠছে। কৈবর্ত যুবক-যুবতীরা নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকে। নিথর নিষ্কম্প।
দেখা যায় শুধু রাজপুরুষরাই নয়, তাদের সঙ্গে আছে বড়সড় একটি দল। তাদের মধ্যে ধৌতিক-উড়নি-পৈতাধারী পুরোহিত, যুদ্ধংদেহী আর্য যুবকের দল, এবং তাদের দণিদেশীয় ভাড়াটে ঠ্যাঙ্গারের দল।
ঘোষক রাজপুরুষ বরাবরের মতো ঘৃণাপূর্ণ উঁচুকণ্ঠে কথা বলতে শুরু করেÑ ওরে অসুরের দল! তোদের কি ঘোষণা শোনানো হয়নি যে এই দেদ্দাপুরে প্রতিষ্ঠিত হবে ভগবান বিষ্ণুর পুণ্যমন্দির?
জানানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কী? মন্দিরের মতো মন্দির হবে। সেখানে আর্যরা তাদের মতো করে তাদের দেবতার পূজা করবে। আর কৈবর্তরা নিজেদের ব্রত-পার্বন-পূজা নিয়ে থাকবে। মন্দির তৈরি হওয়ার সাথে কৈবর্তদের ত্রেপূজায় বিঘœ সৃষ্টির সম্পর্ক কী?
রাজপুরুষের কণ্ঠ আরো অধিক ক্রোধে গমগম করে ওঠেÑ মন্দিরের জন্য এই গ্রামকে দেবোত্তর সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই এই গ্রামও এখন দেবতার গ্রাম। ভগবান বিষ্ণুর গ্রাম। সেই পবিত্র গ্রামে যোনীপূজার নামে কোনো ব্যাভিচার চলতে পারে না। এখানে চলবে শুধু আর্য দেবতার পূজা-অর্চনা। তোমরা এই দেবগ্রামকে ত্রেপূজার নামে অপবিত্র করেছ। তাই প্রায়শ্চিত্ত বিধি অনুযায়ী বিষ্ণুমন্দিরের সেবায়েত শ্রীবৎসপালস্বামী তোমাদের প্রত্যেক সম পুরুষকে এক দ্রম্ম করে প্রায়শ্চিত্ত-পণ নির্ধারণ করেছেন। আগামীকল্যর মধ্যে যে এই পণ পরিশোধ করতে পারবে না, তাকে তার চাষত্রে হতে উচ্ছেদ করা হবে।
বজ্রাহত নারী-পুরুষ। নারীরা কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে।
এখানেই শেষ নয়।
রাজপুরুষ আবার বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেÑ যেখানে বিষ্ণু মন্দির থাকবে, সেই দেবগ্রামে কোনো অশাস্ত্রীয় পূজা চলতে পারবে না। কোনো মূর্তি বা পাথর পূজিত হতে পারবে না। তাই তোমাদের গ্রামের এই বেলেপাথরদুটিকে নদীতে নিপে করার জন্য আমরা নিয়ে যাচ্ছি।
গাঁওদেব-গাঁওদেবী থাকবে না! ওলান ঠাকুরের নাম থাকবে না! ওলান ঠাকুরের চিহ্ন থাকবে না!
দিব্যোক! দিব্যোক! তুমি আমাদের আর কত সহ্য করতে বলবে?
ওলান ঠাকুর! তুমি আর কতদিন এইভাবে সয়ে যাবে?
বরেন্দি মা আর কতদিন সইবে অপমান?
কৈবর্ত জাতি কি নিজেদের রক্তরঙা মাঠিতে নিজেদের পূজা-পার্বনও করতে পারবে না?
দিব্যোক! দিব্যোক!

বাংলাদেশ সময় ১৪৪০, ডিসেম্বর ১৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।