ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

স্মৃতিতে মোজাফফর স্যার

সুব্রত কুমার দাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০
স্মৃতিতে মোজাফফর স্যার

অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন, আমাদের মোজাফফর স্যার, গত ৭ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। সকাল সাড়ে ১১টার পর স্যারের ভাই সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু আমাকে ফোন করে দুঃসংবাদটি জানান।

দিন পনের ধরে এই সংবাদটি কখন ফোনে কেঁদে ওঠে সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম যেন। কারণ এর বেশ কদিন আগে থেকেই মারাত্মক স্ট্রোকে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। আপনজনেরা তার ফেরার আশা যেন ছেড়েই দিয়েছিলেন।   মুহূর্তেই মোজাফফর স্যারের সামান্য জ্যেষ্ঠ বন্ধু এবং অনুগ্রাহী অধ্যাপক সমরেন্দ্র সরকারকে নিয়ে ধানমণ্ডি থেকে মহাখালীর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে সিএনজি নেই। ফোন অনুযায়ী পথে যুক্ত হলেন লেখক জাহাঙ্গীর সেলিম। আর ঘণ্টা দুয়েক পরে মরদেহ নিয়ে আমরা যখন স্যারের ধানমণ্ডরি বাসায় এলাম, ক্রমে ক্রমে এসে যুক্ত হলেন বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের কাদের ভাই, সুরধ্বনির ডা. খালেদা আপা, দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের সাংবাদিক শুভ্র, আমাদের আরেক বন্ধু ওয়ালীউজ্জামান, তরুণ কর্মী পাপড়ি এবং মঞ্জু ভাইয়ের সংবাদপত্রের একগুচ্ছ সহকর্মী।

প্রয়াত মোজাফফর স্যারকে নিয়ে লিখতে যেয়ে অন্য সকল কথা বলে ভূমিকা সম্পন্ন করার কারণ হলো পাঠককে এটুকু বোঝানো যে স্যারের সাথে সম্পৃক্তরা সবাই আমরা এত সাধারণ! সেখানে কোনো সেলিব্রেটির প্রবেশ ঘটেনি। কর্মী পর্যায়ের আমাদের কেউ কেউ ছিলেন বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের সাথে যুক্ত। কেউ কেউ বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টারের সদস্য।

বিজ্ঞান ও সাহিত্যবিষয়ক ক্ষুদ্র এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল তাঁর আত্মার যোগ। সংযোগ ছিল সুরধ্বনির সাথেও। স্থাপনা-শূন্য সে প্রতিষ্ঠানটিও মাটি-ঘেঁষা। ধানমণ্ডির লেক পাড়ের দ্বীপ চত্বরে নান্দনিকতা পরিবেষ্টিত সুরধ্বনির মানুষদের সাথে মিলিত হতে রাবীন্দ্রিক ব্যাগ কাঁধে স্যার যেতেন যতদিন শরীর তাকে যেতে নিষেধ করেনি।

মোজাফফর স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা  হয়েছিল বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক এক বৈঠকে। ১৯৯৮ সালের ২২ অক্টোবর তারিখের সে বৈঠকের তারিখটি আমার মনে আছে কেননা সে দিনটির অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার লেখাটি ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে। বক্তা ছিলেন অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী। ক্ষুদ্র পরিসরের বিজ্ঞান চেতনায় বৃহতের যে নিরলস প্রয়াস তা আমাকে সেদিন বিমুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা আজ এত বছর পরও বর্তমান। মুগ্ধতা এ জন্যে যে ক্ষীণতনুর মানুষটির ভেতর এমন প্রতিবাদী চেতনা, সে চেতনায় এমন অপ্রচলের সমাহার! সে সমাহারের এমন ঋদ্ধতা। প্রচলের বাইরের সেই ঋদ্ধ চেতনার সাথে আমার দীর্ঘ বারো বছর বসবাস ছিল। কত শত বৈঠক করেছি তাঁর সাথে, তাঁর কত কাজে নিজেকে যুক্ত করেছি, নিজেদের কত কাজে তাঁকে সম্পৃক্ত করেছি!

একদিন জানলাম জর্জ টমসনের Marxism and Poetry বইটির তিনি অনুবাদক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কালের উল্লেখযোগ্য সে পাঠের বাংলা ভাষান্তর করেছেন আমাদের এত চেনা মোজাফফর স্যার! ১৯৮৬ সালে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে সে বই বেরুনোর পর ১৯৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি পাবলিশার্স প্রকাশ করেছিল তাঁর আরেকটি অনুবাদ গ্রন্থ Islam। ফরাসি চিন্তাবিদ আলফ্রেড গিয়োমের ‌‌`ইসলাম` তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলেই আমি মনে করি।

ইতোমধ্যে আমার নিজের প্রথম দিককার বইও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ২০০২ সালে ঐতিহ্য থেকে বেরোল আমার ‌`বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য`। স্যার আগ্রহ প্রকাশ করলেন তাঁর আরেকটি পান্ডুলিপি নিয়ে। সেটিও অনুবাদ  কর্ম। টমাস হার্ডির উপন্যাস `দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ`। ২০০৩ সালে ঐতিহ্য প্রকাশনীর কর্ণধার নাঈম সাহেব সেটি সাদরে প্রকাশ করলেন। গ্রন্থটি প্রকাশে আমার সে অনুল্লেখ্য সহযোগিতার কারণেই স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয় দৃঢ়।

অধ্যাপক মোজাফফর হোসেনের গোপন অভীপ্সা ছিল বাংলা থেকে কিছু ইংরেজি কাজও করার। দু-একবার ডেইলি স্টার-এ লেখাও ছাপিয়েছেন, কিন্তু পত্রিকার সাথে লেখকের সংযোগটি প্রয়োজনমতো না হওয়ায় বেশি এগোনো হয়নি তাঁর। তবে তাগিদটা ছিল বেশ। আর সে সবের ফলেই দুজন মিলে একসাথে করলাম নজরুলের ইংরেজি অভিভাষণগুলোর অনুবাদ। ২০০৫ সালে নজরুল ইনস্টটিটিউট প্রকাশ করে Kazi Nazrul Islam: Speeches। ২০০৯ এ দুজনে মিলে করলাম ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস  Parobaas। অনুবাদ নিয়ে আমাদের দুজনের এমন আরও অনেক কাজ চলছিল।

ইতোমধ্যে ২০০৩ সালে বাংলাদেশের উপন্যাসভিত্তিক আমার ওয়েবসাইট বাংলাদেশিনভেলসডটকম-কে আশ্রয় করে আমরা একটি সাহিত্য সংগঠন করার প্রচেষ্টা শুরু করি। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে পরিচিতি ও বন্ধুজনেরা সবাই মোজাফফর হোসেনের নামই বললেন।   উঁচু মননের একজন সৎ বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হিসেবে মোজাফফর স্যারকে মনোনীত করতে পেরে আমরা সবাই খুশিই হয়েছিলাম। সংগঠনের নামকরণ করা হলো বাংলাদেশ লিটারারি রিসোর্স সেন্টার (বিএলআরসি)। ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট বিএলআরসি-র  পক্ষ থেকে আয়োজন করা হলো লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হানে-রুথ থম্পসনের বক্তৃতা। ২০১০-এর ৩০ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার কোড়কদীর ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে আয়োজন করা হয় ‘কোড়কদী সমাবেশ’। সমাবেশের পূর্বে ২৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় সংবাদ সম্মেলন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী। কোড়কদী সমাবেশে আরও যুক্ত ছিলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য ড. সঞ্জয় অধিকারী, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, প্রবীণ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ভূতপূর্ব মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।   উভয় অনুষ্ঠানেই মোজাফফর স্যার সভাপতিত্ব করেন ।

একসময় স্যারের আরও একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গেল। দর্শনের মানুষদের নিয়ে সে পাণ্ডুলিপিতে অন্তর্ভুক্ত হলেন গিয়োর্দানো ব্রুনো, হাইপেশিয়া, স্পিনোজা, ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা প্রমুখ। কম পরিচিত লেখকের জ্বালা স্যারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। যখন আমরা দুজনে মিলে সে পাণ্ডুলিপি করি তখন ধানমণ্ডি থেকে এসে পাশে দাঁড়ালেন কে কে আরিফ। বইয়ের নাম হলো ‌`আরো কয়েকজন সক্রেটিস`। উদারতা এবং প্রজ্ঞায় পুষ্ট মোজাফফর হোসেনের চিন্তারাশিকে দুই মলাটে আনতে কে কে আরিফের ঔদার্যের কথা মোজাফফর স্যার প্রায়ই আলাপকালে উল্লেখ করতেন।

এভাবেই ক্রমে ক্রমে দুজনে নতুন নতুন কাজে সম্পৃক্ত হয়েছি। কখনো যৌথভাবে, কখনো একাকী। একাকীর কাজগুলোও যৌথই হয়ে যেত, যেহেতু মোজাফফর স্যারের সাথে সাক্ষাৎগুলোতে সেসব কাজ নিয়েই চলত আলোচনা-পর্যালোচনা। আর এমন করেই একসময় নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিনির্ভর রচনাগুলোকে দুই মলাটে বাঁধার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হলেন স্যার। ক্ষীণতণুর মানুষটির দৃঢ় প্রত্যয়কে ডিজিটালাইজ করলেন আমাদের দীর্ঘদিনের সহযাত্রী  খুরশীদ আলম লিটন। আর গ্রন্থপ্রাণ সুকান্ত সৈকত পাণ্ডুলিপি নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলেন। বই করাতে রাজি করালেন তক্ষশীলার সালমা আপাকে। আপার বোধি প্রকাশন থেকে মোজাফফর স্যারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‌`পাতা উল্টাই` বেরুলো ২০১০-এর বইমেলার শেষ দিনটিতে।

 ক্রমে ক্রমে এলো ২০ মে। আমরা ঘরোয়াভাবে স্যারের ৭৪তম জন্মদিন করলাম। আমাদের সকলের প্রত্যয় ৭৫তমটি পালন করব অনেক বেশি সুসংগঠিতভাবে। ২০ মে-র আগে থেকেই স্যারের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। হাজার উৎসাহ দিয়েও যেন সজীব রাখতে পারতাম না। কিন্তু সে সবের ভেতর দিয়ে স্যারের মোট চারটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ফেলি আমরা। দর্শন ও বিজ্ঞান, বিচিত্র ভাবনা, সমাজ ও সাহিত্য ও রম্যব্যঙ্গ  শিরোনামে কম্পোজও শেষ করে ফেলি সেগুলোর ।

নভেম্বর আসতে আসতে স্যার যেন নুইয়ে পড়লেন একেবারে। বাসাতে গেলে বেড রুম থেকে উঠে এসে দেখা করার শক্তিও হ্রাস পেয়ে গেল। তাঁর অলস সন্ধ্যায় খোঁজ নিতে গেলে প্রায়ই প্রশ্ন আসতো সে সব পাণ্ডুলিপির কোনো প্রকাশক জোগাড় করতে পেরেছি কিনা। আশ্বস্ত করতাম এই বলে যে তাড়াতাড়িই পেয়ে যাব। সে মিথ্যাভাষণ আজ এ লেখার মধ্য দিয়ে শুধরে বলি, স্যার, প্রকাশক আপনার পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু জেনে পরামর্শ দিয়ে বলেছে যেহেতু বাংলদেশে দর্শন বিষয়ে পাঠের মানুষ নাই, তাই ভালো হয় অন্য বিষয়ে বই লিখলে। স্যার, যে সমাজ দর্শন পাঠ করে না সে সমাজে মানুষ কজন?

এক পর্যায়ে হাসপাতালে নেওয়া হল তাকে। বাসায় ফিরিয়ে আনা হলেও আবার সেই হাসপাতাল। তারপর আর স্যারের ফিরে আসা হয়নি। সেলিব্রেটি-সম্পৃক্ততাহীন হলেও মোজাফফর হোসেনের নামটি কিন্তু সেলিব্রেটি-বিভ্রান্তি ছড়াত মাঝে মাঝেই। কাছাকাছি নামের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ যিনি বাংলাদেশের বর্তমান বুদ্ধিজীবী সমাজে নিজ প্রভায় উজ্জ্বল, তার নামের সাথে মোজাফফর হোসেনের নামের বিভ্রান্তি করার মানুষের অভাব ছিল না। এতগুলো বই লিখে এবং নিয়মিত কলাম লিখেও তাকে যে নিজের নামে অনেক পাঠকই চিনতে পারতেন না, সে দুঃখ বোধ করি চেতন অবস্থার শেষ ক্ষণ পর্যন্ত স্যারের ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পরেও সেলিব্রেটি বিভ্রান্তি তাঁকে ছাড়েনি। লাশ তাঁর বাসায় পৌছানোর পরপরই সেখানে উপস্থিত হন এক সেলিব্রেটি আবৃত্তি সংগঠক। তিনি মোজাফফর হোসেনকে চিনতেন না, আবার মোজাফফর আহমেদের বাসার অবস্থানও জানতেন না। স্যারের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মোজাফফর সাহেব মারা গেছেন জেনে অতি উৎসাহে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে মোজাফফর আহমেদের (তিনি দীর্ঘজীবী হউন-ঈশ্বরের কাছে এই কামনা করি) মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে দিলেন।   টিভি ক্যামেরাগুলোর গাড়ি রওনা দিল মোজাফফর সাহেবের লাশের উদ্দেশ্যে। বহু কষ্টে সেগুলোকে নিবৃত করেছিলেন মঞ্জু ভাই।

ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রচলিত ঘরানায় অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন ছিলেন না। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। কোরআন-হাদিসের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর দখল ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। বেদ-উপনিষদ-গৌতমবুদ্ধ-বাইবেল সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধান্বিত বিশ্লেষণ ছিল অনুকরণীয়।

এ লেখার মাধ্যমে মোজাফফর স্যারের প্রতি আমার প্রণতি জানাই।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯০০, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।