বাংলাদেশের ছোটগল্পে চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বকে মনস্তত্ত্বের জটিল রেখায় বিশ্লেষণে দারুণ দক্ষতার ছাপ রেখেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, মৃত্যু: ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭)। তার সৃষ্ট চরিত্র অনন্যতা পেয়েছে জন্মসূত্রে এবং পরিবেশগতভাবে পাওয়া ভাষা-প্রয়োগের অকৃত্রিমতায়।
‘ভাষার প্রাণবন্ততার জন্য যেমন সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন আছে, তেমনি slang শব্দের প্রয়োজন আছে। উচ্চভাব প্রকাশের গদ্যে slang সুষ্ঠু প্রকাশ দিতে পারে। ’ (সুবোধ ঘোষ, ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তো, দ্বিতীয় প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৮৯,কলকাতা)
মন্তব্যটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পভাষা বিষয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ। প্রকৃত অর্থে, তিনি মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি থেকে অবতরণ করে নিম্নকোটির মানুষের মধ্যে গিয়ে হাজির হয়েছেন, প্রচলিত সাহিত্যভাষা ত্যাগ করে স্ল্যাং, চলতি দেহাতি শব্দ, আঞ্চলিক বা শহুরে গলির শব্দ, গালিগালাজ, মুদ্রাদোষ-- সবকিছুর মিশ্রণে ভেঙে ফেলেছেন তথাকথিত আদর্শ সাহিত্যিকভাষা ও রুচি। দৃষ্টান্ত :
পুলিসের বাপে আছিলো বে তোতলাচোদা। দেখলি না লম্বা চুল, জুলফিআলা মস্তানগুলি হালায় ফাইব ফিফটি ফাইব মারতাছে। হ্যারা পুলিসের বাপ লাগে, বুঝলি? হালারা ইসটুডেন। ’ ‘ইসটুডেন? ইসটুডেন ক্কি করবো?’ তরে না একখানা চটকানা দিয়া কলতাবাজার পাঠাইয়া দেই তো আরাম পাই, বুঝলি? ডামলালু খুব বিরক্ত হয়েছে, ‘ইসটুডেন হালারা কি করবো তুমি জানো না, না? কেলাব থাইকা, হোটেল থাইকা সাহেবরা বারাইবো মাল টাইনা, হ্যারা হেই গাড়িগুলি ধইরা মালপানি কামায়, মাগীউগি পছন্দ হইলে ময়দানের মইদ্যে লইয়া হেইগুলিরে লাগায়। অহন বুঝলি বাঙ্গুচোদা, বুঝলি, দিন তো অহন হালায় ইসটুডেন গো, হালায় ইসটুডেনের মারে বাপ। (ফেরারী : অন্য ঘরে অন্য স্বর)
ব্যক্তির পারিবারিক-সামাজিক অবস্থান আর মানসিক ভ্রান্তি-বিভ্রমকে ইলিয়াস তাঁর গল্পে প্রকাশ করতে গিয়ে চরিত্রের আন্তঃধর্ম এবং আত্মবিবৃতির ওপর নির্ভর করেছেন। কল্পনায় সাজানো মানুষের সমাজসত্যকে পরিবেশন করেছেন তার মানোবাস্তবিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। ‘উৎসব’ গল্পে মানসিকবিকৃতি, দাম্পত্যজীবনের অসাড়তা আর তা থেকে শোভন-পাটাতনে উত্তরণের-- আড়মোরার আওয়াজ নির্মাণ করতে গিয়ে একটি সামাজিক কৃত্রিম অনুষ্ঠান ও অন্য একটি অকৃত্রিম আপাত অসামাজিক উপভোগ্য দৃশ্যকে প্রায় পাশাপাশি দাঁড় করানোর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে গল্পবর্ণনাকারী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। জীবনে চলার পথে ‘সোনালি ফসল’ কুড়াতে ব্যর্থ এক আপাতসংকুচিত পুরুষ তার কৈশোরবন্ধুর বিবাহজনিত অভ্যর্থনা-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যায়, যোগ দিতে যায় বিবর্ণমনে ব্যাকুল-চাওয়ার তে ‘ভালো ভালো মেয়ে’ দেখার আনন্দ-মাখা প্রলেপ বুলানো মাতোয়ারা সান্ধ্যবাসরে। উচ্চবিত্তের অনুষ্ঠান-সভার আলো-আঁধারি আর নারীপুরুষের কথালাপ-নিবিড় চলাচলের অন্তরালে মধ্যবয়সী অসুখী-ক্লান্ত এই পুরুষ খুঁজতে থাকে মেয়েমানুষের গন্ধ আর নির্ঘুম রাত্রিযাপনের ছায়াসঙ্গীর কোমল-অস্পষ্ট সান্নিধ্য। সন্ধ্যায় মেয়েমানুষ দেখার সুখ-সুখ অনুভূতি নিয়ে বিছানায় অপেক্ষারত স্ত্রীর নিরানন্দ স্পর্শ আর গভীর রাতে সিনেমা শোফেরত-পসরা বন্ধকারী অবসর নিম্নবর্গের মানুষের কুকরের রতিক্রিয়া দর্শনের ভালোলাগা অনুভবের সাথে একাত্ম হয়ে আপাতবিবশ স্ত্রীর গায়ে সুগন্ধের আকর্ষণ পেতে চাওয়ার বিচ্ছিন্ন চিত্রভাষ্যে গল্পকার তৈরি করেছেন মনোবিকলনের এক স্বপ্ন-বাস্তবের গল্পদেহ। গল্পনির্মাতার বিবরণ :
শুয়ে পড়তে পড়তে আনোয়ার আলি তার স্ত্রীর প্রশ্নমালার সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর দেয়। এখন নিয়মিত প্রাক-নিদ্রা রতিক্রিয়ার পালা। এই মেয়েটিকে অন্তত মিনিট বিশেক ভালোবাসতে হবে। ভয় হয়, সালেহা তার মূল্যবান সন্ধেবেলাটা তছনছ না করে ফেলে। তবে ভালো ভালো মেয়ে দ্যাখা গেছে বহু, সুখ তো আজ ওদের নিয়ে, সালেহা উপলক্ষ মাত্র।
অস্তিত্বভাবনা আর নিয়তির অমোঘ বিধানের অনতিক্রম্য সত্যাসত্য উপস্থাপনের জন্য ইলিয়াস আশ্রয় করেছেন লৌকিকতা-অলৌকিকতার বিষয়াদির ওপর; মানুষের সীমাবদ্ধতা আঁকতে গিয়ে পরিবেশন করেছেন সৃষ্টিরহস্যের অসীমতার আবছাআলো। ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’ স্বপ্ন-বাস্তবের মায়াজালে বাঁধা, প্রকৃতির অকৃত্রিমতায় ঝুলে-থাকা মেয়াদ-উত্তীর্ণ মানুষের গল্প। বেঁচে থাকার মতো স্বাভাবিক শারীরিক-মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলা অধিক বয়সের মানুষ সামাজিক-পারিবারিকভাবে কী রকম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে, তার বিশ্বাসযোগ্য বাণীরূপ বর্তমান গল্পটি। কামালউদ্দিন বয়সের ভারে নুয়ে-পড়া জীবনঅন্বেষণী এক অভিমানী-প্রতিবাদী পুরুষ। গল্পের দীর্ঘ পরিসরে কামালউদ্দিনের আরো দীর্ঘ যাপিতজীবনের দিনলিপি ও ভাবনাভাষ্য লেখক পরিবেশন করেছেন বিবেচনা ও উপলব্ধির বিচিত্র কৌণিকতায়। বর্ণিত বৃদ্ধের অতিক্রান্ত সময়ের প্রমাণিত সাফল্য, স্বপ্ন, মৃত্যুভাবনা আর টিকে থাকার আকুলতা এই কাহিনীর আপাত ক্যানভাস। স্বল্প-আয়নির্ভর অতিবাহিত পারিবারিক জীবন কামালউদ্দিনের। গল্পকার লিখছেন-- ‘ইসলামপুরের ছাতা ও খেলার সরঞ্জামের দোকানের বারান্দায় সিঙ্গার মেশিনে লুঙি, বালিশের অড় ও মশারি সেলাই করে তার জীবন কাটলো’। স্ত্রীর দেহাবসান, স্মৃতিলগ্নতা, বিবর্ণ-বিষন্নতা কামালউদ্দিনকে মাঝে মাঝে ক্লান্ত করলেও বাঁচবার অধিকারবোধে সে দারুণ প্রত্যয়ী। তার বাঁচবার স্বপ্ন, স্বপ্নে স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ-আলাপ, মেয়ের কাছে স্বপ্নের ব্যাপারটি গোপন রাখার চিন্তা আর শেষপর্যন্ত সত্য প্রকাশ করার বিষয়াদি গল্পকার পাঠকের সামনে হাজির করেছেন বৃদ্ধের পরনির্ভরতা এবং জীবনের স্বাদ আরো খানিকটা চেখে নেবার বাসনার উপর আশ্রয় করে। কাহিনীকারের ভাষ্য :
বাবার কপালে হাত দিয়ে খোদেজা নিজেও ভয় পায়, ‘ইস, ঘাইমা এক্কেরে নাহাইয়া উঠছেন। আব্বা, কি খোয়াব দেখছেন?’ খোলা দরজা দিয়ে একটু একটু হাওয়া আসছিলো, কপালে ও মাথায় মেয়ের হাতের স্পর্শে কামালউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন দুপুরবেলা বাপকে ভাত খাওয়াবার সময় কথায় কথায় খোদেজা সব জেনে নেয়। স্ত্রীর দৈনিক যাতায়াতের খবরটি গোপন রাখাই ভালো। আকবরের মায়ের ডাকে সাড়া দিতে না পারায় এমনি সে কুঁকড়ে আছে, এইসব ফাঁস করে সকলের সামনে জড়সড় হওয়ার দরকারটা কী? তবে কি-না সেদিন কৈমাছের ঝোল ছিলো, আলু ঝিঙা দিয়ে মাখামাখা করে রাঁধা, এক চিমটি মাছে আঠালো জিভে স্বাদটিকে আরো চটচটে করে নেওয়ার লোভে সে বলে, ‘তর মায়ে আইছিলো। ’
সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতা, তার অন্যায় অপকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান আর শেষত পুনরায় স্নেহবশত মা প্রদান প্রভৃতি প্রসঙ্গ পরিবেশনের জন্য গল্পকার নির্বাচন করেছেন এক বিশ্বাসযোগ্য বিবৃতিভাষ্য। অবাধ্য ছেলেকে একদিন যে মা ঘরে ঢুকতে দেয়নি, তার প্রতি দীর্ঘদিনের গোপন-লালিত কষ্টবোধ আর কাছে টানবার অভিপ্রায়কে গল্পকার তুলে ধরেছেন মরণযন্ত্রণাকাতর মায়ের, ছেলের শৈশব স্মৃতিনির্ভর, বিলাপ-প্রলাপের মোহময় মোড়কে :
আকবরের মা মরলো সপ্তাহখানেকের জ্বরে, কিন্তু ঐ ৭/৮ দিন জ্বরের ঘোরে তার মুখে আকর ছাড়া আর কথা শোনা যায় নাই। -- ‘আকবর, বাবা, ও আব্বা, দুধ খাইবি না?’ ‘ও আকবরের বাপ, দেইখা যাও, তোমার পোলায় তোমার টুপি পইরা কেমুন হাসতাছে!’ ‘আকবর, আব্বা, আমার সোনাটা, আয়, নাহাইয়া দেই ভাত খাইয়া খেলবি, অহন আয় বাবা!’ ‘হায় হায়,! আকবরে আউজকা নারিন্দার মোচড়ে গেছিলো গিয়া, পোলায় কেমুন বিচ্ছু হইছে, কুনদিন গাড়ির নিচে পড়বো!’
পরিবাবেরর অনেকে গত হয়েছে, কিন্তু আপাতভাবে ‘মেয়াদের ওপর দুনিয়ায় বসবাসের শাস্তি’ ভোগ করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়ছে কামালউদ্দিন। তার শরীরের একাংশ পাঘাতগ্রস্ত- নিথর; অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় প্রস্রাব-পায়খানা-থুথুফেলা-খাবার-চলাফেরার জন্য। দুনিয়ার এই গোরআজাব থেকে সে মুক্তিও কামনা করে; তবে ইচ্ছামৃত্যু যে সাধারণ মানুষের কর্ম নয়, তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। নতুন-পুরনো প্রজন্মের দ্বন্দ্ব, পীরসাহেবদের কেরামতি আর প্রত্যাশিত কোনো রমণীর অবহেলা কামালউদ্দিনকে অবসন্নতায় ডুবতে থাকা মানসিক ভ্রান্তি থেকে ‘সিঁধা হইয়া খাড়া’বার শক্তি সঞ্চয় করতে সাহস জোগায়। মরতে সে চায় না; বাঁচবার অধিকার কি তার নেই! মধ্যে মধ্যে মরে-যাওয়ার বাসনা জাগে কামালউদ্দিনের মনে, ‘কিন্তু আলার কেরামতি বোঝে কে?’ অবশ্য কামালউদ্দিনের এক ছোট্ট নাতনির অবস্থান ও পরিক্রমভাবনায় লেখক পাঠককে জানান দেন বৃদ্ধের নিশ্চিত মৃত্যুর খবর :
কামালউদ্দিন তার মরণের আশ্বাস পায় কেবল রুমার কাছে, নানার মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্বন্ধে আস্থা আছে কেবল এই মেয়েটির মনেই। খোদেজার এই মেয়েটি তার ঘরে এলেই একবার বলবে, ‘নানা তুমি মরলে এই ঘরে থাকুম আমি আর আপা। আমাগো ঘরে এমুন গরম!
সামাজিক-ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতাবোধ আর সম্পর্কনির্ভর স্নেহমমতার বাঁধনমাধূর্য পরিবেশন করতে গিয়ে ইলিয়াস ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পে ঘুমপ্রকাশক হাইতোলা দৃশ্যের পৌনঃপুনিক ব্যবহার, স্মৃতিলগ্নতা, ভাবনার তালরহিত পরিস্থিতি আর পরাবাস্তব পরিবেশ প্রয়োগ করেছেন সতর্কদৃষ্টিতে। মনের অস্থির-পরিবর্তনপ্রবণ অবস্থা নির্দেশের জন্য আছে ধ্বনি ও গন্ধের পরিবেশনা-- ‘ঘরের দরজা থেকে পিসীমা চলে যাওয়ার সময় চন্দনের, শশার, কলার ও কর্পূরের ঝাপশা গন্ধ প্রদীপের নাকের সামনে একবার তুড়ি বাজিয়ে পিসীমার চুলের মধ্যে ডাইভ দিয়ে পিসীমার সঙ্গেই ফিরে গেলো। ’ আর জাতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটকে তিনি উপস্থাপন করেছেন রঙের প্রয়োগচাতুর্যের আলোকে; রঙ-আলো-ধ্বনির আবহ তৈরির মধ্য দিয়ে। ‘খোঁয়ারি’ গল্পে ভ্যাপসা-ভিজে-পুরনো জীবনের সুড়সুড়ি-লাগা ঠিকঠিক অনুভূতি নির্মিতি লাভ করেছে আওয়াজ-আলো-রঙ-অন্ধকারের প্রাত্যহিক খেলার বিবরে। সুরকি-ঝরা দেওয়ালের ঝাপসা রঙ, ‘ঘরের দেওয়ালে খিঁচিয়ে-থাকা দাঁতের গোড়ার ছ্যাতলার মতো হলুদ জ্যোৎস্না’ কিংবা ‘উঠানকে হলদে রঙের নোংরা চাদর-পতা বিছানা’ মনে করা আর টিনের চালে জল-পড়ার শব্দ অথবা জল গড়াবার ঢকঢক আওয়াজ গল্পেবর্ণিত চরিত্রগুলোর মতোই সংকুচিত করে রাখে দিনযাপনের যাবতীয পরিবৃত্ত।
‘দুধভাতে উৎপাত’ গল্পে সুখ-শান্তি আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে দুধভাত-এর প্রসঙ্গ। একটি পরিবারের আর্থিক-অসচ্ছলতা আর কাঙ্ক্ষিত সুখের ব্যাপারাদির আড়ালে নির্মিতি পেয়েছে দেশের-দশের ভালো থাকার বিষয়। মায়ের দুধভাত খাবার শখ বা প্রবল আশার প্রবলতা পরিবেশিত হয়েছে জাতির প্রতিপালকরূপী, স্নেহময়ী, সন্তান লালনকারীর স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত-করার প্রত্যাশার রূপকে। বাংলাদেশের খাদ্য-সংকট, দারিদ্র্য আর বিপুল মানুষের অসহায় দিনযাপনের চিত্র গল্পকার পাঠকের সামনে হাজির করেন। আর নির্মাণ করেন সংকট-উত্তরণের আশাবাদ। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা যে জাতির, তার তো কালোগরু বিক্রি করে বা বন্ধক দিয়েই ভাতের চাল কিনতে হয়-- এ বাস্তবতা আমরা পাই ইলিয়াসের বর্তমান গল্পে। আবার এ জাতি যে চিরকাল অর্র্থ-কষ্টে ভুগেছে, এমনও নয়; সুখের মুখও বাঙালি অবলোকন করেছে। নিচের বর্ণনায় পাওয়া যায় সে চিত্রের আভাস :
নতুন চাল উঠলে ছেলেমেয়েদের জয়নাব একদিন দুধভাত খাওয়ায়। কসিমুদ্দিন অবশ্য তখন তিস্তাতীরের গ্রামে। উঠানে ছেলেমেয়েদের সার করে বসিয়ে জয়নাব হাত দিয়ে মুখে মুখে ভাত তুলে দেয়। দুধ দিয়ে ভাত দিয়ে কলা দিয়ে গুড় দিয়ে।
‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’ জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন ‘মামার বাড়ির আব্দার’-এর মতো কোনো স্বাভাবিক ব্যাপারও নয়। যদিও সন্তানাদি-আত্মীয়-পরিজনের, তাদের মায়ের-নিকটজনের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়, বাস্তবতা-সমর্থিত; গল্পকার জানাচ্ছেন প্রাণন্ত-প্রচেষ্টা আর তৃপ্তি মিথ্যামোড়কের ইতিহাস :
কী করি? পোলাপানেরে খালি দুধভাত খাওয়াতে চাস। কী করি? চাইলের গুড়ি জাল দিয় দিলাম!... ক্যান বৌ? চাইলের গুড়ি পোলাপানেরে কুনোদিন খাওয়াস নাই? দুধ দিছস কয়দিন? দুধের স্বাদ তর পোলাপানে জানে কি?
ইলিয়াস তাঁর গল্প-অবয়বে প্রবেশ করিয়েছেন বিষয়ানুগ মেজাজ ও মনন। বর্ণনায় রয়েছে আড়ম্বর; ডিটেইলের প্রতি আস্থা, গঠনশৈলী আর পর্যবেণভঙ্গিতে আছে বাক্চাতুর্য আর হিউমার-বোধ। উপস্থাপনকৌশলে আছে অপ্রচল ভাবনা ও পরিবেশন-পরিসর। বাংলাভাষায় গল্পনির্মাণের ধারা পরিবর্তন করে আপনমনে পথ চলতে-থাকা, নতুন পথের পথ-না-চেনা পথিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গল্প-পরিবেশন কায়দায় সত্যি সত্যিই সেঁধিয়ে দিলেন এক শিহরণ-জাগা ভালোলাগা।
বাংলাদেশ সময় ১৯৫৬, জানুয়ারি ৪, ২০১১