ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আমাদের ছাড়াতে এসে বাবা শহীদ হন

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা/ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫
আমাদের ছাড়াতে এসে বাবা শহীদ হন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শহীদ মজিবর রহমান কাঞ্চন, পিতা মৃত আহসান উদ্দিন আহম্মেদ, মাতা মৃত তকদিরুন নেছা বেগম। ৫ ভাই ৫ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি।

ছিলেন বরিশাল নগরীর কালিশ চন্ত্র রোডের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালের ১৩ মে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম জীবনে ভালো ফুটবলার ছিলেন, পরে ১ম শ্রেণির ঠিকাদার ও তৎকালীন কালিবাড়ি ইউনিয়নের ১ জন মেম্বার ছিলেন।

শহীদ মজিবর রহমান কাঞ্চনের ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। যাদের মধ্যে মশিউর রহমান কামাল ও শফিউর রহমান জামালও যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হন। আজ সব সন্তান নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে বাবার স্মৃতি আকড়ে রেখে আজও শিওরে ওঠেন কামাল ও জামাল।

বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমনটাই বললেন শফিউর রহমান জামাল। বাকিটাও আমরা শফিউর রহমান জামালের মুখ থেকেই শুনব:

‘আমরা ছিলাম ৭ ভাই ১ বোন। এর মধ্যে বড়ভাই কামাল ৭১ সালে সাড়ে ১০ বছরের আর আমি ছিলাম ৯ বছরের। বাড়ির পাশেই বিএম স্কুল, তাই পড়াশোনায় কখনও কষ্ট হয়নি।

প্রথমত বাবা ছিলেন একজন ভালো ফুটবলার, আর কর্মজীবনে ছিলেন প্রথম শ্রেণির একজন ঠিকাদার। আবার তৎকালীন এই কালিবাড়ি ইউনিয়নের ১ জন নির্বাচিত মেম্বারও ছিলেন তিনি।

একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম একমাস বরিশাল হানাদার মুক্ত ছিল। কিন্তু সে সময়ও মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছে, একের পর এক সরকারি দপ্তরগুলোয় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে সময় বিএম স্কুলে ট্রেনিং হয়েছে, আর অনেক অন্ত্র আমাদের বাসায় রাখা হতো।

যুদ্ধ শুরুর প্রায় একমাস ২০ দিন পরে হঠাৎ করেই বাবা আমাদের লাকুটিয়া চেয়ারম্যান বাড়িতে তার কেরানিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ৭-১০ দিনের মত ছিলাম। লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রশদ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। যেখানে বাবারও হাত রয়েছে।

লাকুটিয়া যাওয়ার পরে জানতে পারি, বাবার অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি লঞ্চ মিস করেছেন—তাই যেতে পারেননি। এ কথা শোনার পর আবার বাড়িতে ফিরে আসি। হঠাৎ একদিন বিমান দিয়ে বোম্বিং করে বরিশালে প্রবেশ করে পাক-হানাদার বাহিনী।

৮ মে দিবাগত রাত ২ টায় পাক হানাদার বাহিনী বাড়িতে আসে। এরআগে বাবা ওই দিন রাতেই বাসায় আসেন। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। ওইদিন রাতে বড়ভাই আর আমি মারামারি করে রাত-৯ টা থেকে ১০ টার দিকে ভাত খেয়েছি। সে সময় বাবাও সাথে ছিল। ভাত খেয়ে বাবা চলে যাওয়ার পরে আমরা ঘুমিয়েছি।

আমি সামনে শোয়া ছিলাম সাদা পায়জামা পরে খালি গায়ে লেপের নিচে। রাত ২ টার দিকে পাক হানাদার বাহিনী দরজায় কড়া নাড়ে। ছোটভাই হেলাল দরজা খোলে। ভেতরে প্রবেশ করেই তারা বাবাকে খোঁজে। এ সময় এক বিহারীও তাদের সঙ্গে ছিল।

আব্বা অনেক আগে শিখিয়ে রেখেছেন কোনওদিন যদি পাক হানাদার বাহিনী আসে, তারা জিজ্ঞাসা করবে, ওয়ালিদ কিদার হায়? উত্তরে খেপুপাড়ারা কথা বলবা, ওয়াবদার কাজের বিষয়ের কথা বলবা। আমরা সেটাই করেছি।

আব্বা সব অস্ত্রই চিনত, স্টেনগান, ভেটাগান, টমিগান, চাইনিজ রাইফেল, টমিগান। এসব অস্ত্রের বিষয়ে মৌখিক প্রশিক্ষণ আমাদেরও দিয়েছেন। পুরো ঘরে তল্লাশি চালিয়ে অনেক কিছুই জ্বালিয়ে দেয় ওরা। রিভলবার মাথায় ধরে বারবার জিজ্ঞাসা করেছে বাবা কোথায়। তারপর ৯ মে প্রায় সকালে আমাকে ও আমার বড় ভাই কামালকে তারা ধরে নিয়ে যায়।

ছোট ভাই সাইফুর রহমান বিপ্লবের বয়স তখন মাত্র ১২ দিন।

আমাকে এবং আমার ভাইকে এখান থেকে মসজিদের কোণায় নেয়ার পর বুঝতে পারি পুরো এলাকা কর্ডন করে রেখেছে ওরা। গাড়িতে উঠিয়ে শীতলাখোলা  দিয়ে ওয়াপদা কলোনির দিকে নিয়ে রওয়ানা হয়। মাঝপথে গুলির শব্দও শুনতে পাই আমরা।

ওয়াপদা কলোনিতে প্রবেশ করার সময় নিজের কাছে নিজেকে আর খুঁজে পাইনি। যে কক্ষে আটককৃতদের রাখা হয়, আমাদের আগে সেখানে মাত্র ১ জন ছিলেন। ২ দিন আটকে রেখে তৃতীয় দিন আমাদের ছাড়া হয়। ওই সময় বড় ভাইকে ওরা বারবার নিয়ে গেছে। মারধর করার জন্য।

তবে একটা বিষয়, ওরা আমাদের গাওয়া ঘি, পাকিস্তানি দুধ দিয়ে সুজি ও রুটি সহ নানান ভালো খাবার খাইয়ে বাবার কথা জিজ্ঞেস করত, বলত, তোমার বাবার কোথায় আছে বললে আরও ভালো খাবার দিব, মাংস খেতে দিব। কিন্তু আমরা অনড় ছিলাম, কিছুই বলিনি।

বরিশালে সে সময় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পেতে মাইকিং করা হয়। যে মাইকিংয়ে বলা হয়, ছেলেদের ফিরে পেতে হলে মজিবর রহমান কাঞ্চনকে সারেন্ডার করতে হবে।

১১ মে ওরা বাবাকে আটক করে। মানে বাবাই সারেন্ডার করেন। মায়ের অনুরোধে বাবা নিজে ওয়াপদা কলোনিতে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে আমাদের ছাড়াতে যান। পরে শুনেছি, বাবা যেদিন আমাদের ছাড়িয়ে আনতে যান, বুঝতে পেরেছিলেন তাকে মেরে ফেলবে, তাই সেদিন বরই পাতা দিয়ে গোসল করে, হুজুরের কাছে তওবা পড়ে পরেই আমাদের ছাড়াতে যান বাবা।

শুনেছি, ১১ মে বাবা ওয়াপদা কলোনির গেটে গেলে পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। কাঞ্চন এসেছে, এটা তাদের কিছুতেই বিশ্বাস হয়নি। কারণ ওদের ধারণা ছিল বরিশালের নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে আগে কাঞ্চনকে ধরতে হবে। আর সেই কাঞ্চন নিজে এসে ধরা দেবে তা ওরা ভাবতেই পারে নি।

বাবা ধরা দেয়ার পর এক লোক আমাদের রুমে গিয়ে উর্দুতে বলল, তোমাদের বাবা এসেছে, তোমাদের এবার ছেড়ে দেয়া হবে।

বাবাকে যখন শেষবার দেখি, তখন ১০-১২ জন মিলে তাকে চাইনিজ রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে ধরে রেখেছে। ডান হাতে বড়ভাইকে আর বাম হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে এবং কপালে চুমু খেয়ে বাবা বলল, যাও ঘরে চলে যাও। মা ভাইবোনদের নিয়ে সংসার কইরো। আর দেশ কিন্তু স্বাধীন হবেই। স্বাধীন দেশের জন্য পারলে কিছু কইরো, যাও।

শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলে শেখ কামাল আর শেখ জামালের নামেই আমাদের নাম রাখা হয়েছিল। শেখ মুজিবর রহমান বরিশালে আসলে বাবাকে খুঁজত—“পাগলা কই”—বলে।

ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটেছিল হয়ত, বাবা আটকের ১ দিন পরে এক আনসার কমান্ডার বিকেলে এসে বলেন বাবাকে ছেড়ে দেয়া হবে।

কিন্তু ছেড়ে না দিয়ে ১৩ মে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যখন লাশ পাই তখন তার শরীরে তিনটি গুলির চিহ্ন। শুনেছি, বাবার গুলির অর্ডার হলে তিনি পাক হানাদারের সৈনিকদের ওপর হামলার চেষ্টা চালান। তাই প্রথমে তার পায়ে গুলি করা হয়।

সাগরদী খাল দিয়ে বাবার লাশ ভেসে যাওয়ার সময় বাজারের ঘাটলায় বসে স্থানীয়রা দেখে তৎকালীন ওহেদ চেয়ারম্যানকে খবর দেয়। সে সময় তার গায়ে ওই সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ছিল। উনি শরীর দেখে বাবার মৃতদেহ মনে করে পাশে উঠিয়ে নিশ্চিত করেন। কিন্তু এরই মধ্যে মিলিটারিরা দেখতে পেয়ে লাশ আটকে ফেলে। পরে আবার স্থানীয়রাই লাশটি ছাড়িয়ে নেয়।

সন্ধ্যার আগে এ ঘটনা ঘটলে লাশ নিয়ে সেখান থেকে গোরস্থানে রফাদফা করে আনতে রাত ১১ টা বেজে যায়। আমরাও বাসা থেকে পালিয়ে পালিয়ে সেখানে যাই। কোনওভাবে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়। বড়ভাই বাবার লাশ নাড়িয়ে দেখেছে। আমি ভয়ে কাছে যাইনি।

আমি জানতাম না, স্বাধীনতার আগেই বরিশালে যে সংগ্রাম কমিটি হয়েছে, কমিটির ৩০ জনের মধ্যে আব্বাও একজন ছিলেন। বাবার সম্পর্কে জানতে হলে মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস হোসেনের কাছে যেতে হবে। যেতে হবে তার সহযোদ্ধাদের কাছে।

বাবার মৃত্যু আর দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে মা আর বড়ভাইরা জীবনযুদ্ধে নেমে যান।

স্বাধীনতার পর ১-২ বছর শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে, এরপর আবার বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হলো। এরপরে তো মানুষের কাছে নিজেকে কাঞ্চন মিয়ার ছেলে পরিচয় দিতেই ভয় লাগত। ’

আমার বাবা দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন এটাই বড় পাওয়া। তবে স্বাভাবিক জীবনে অবহেলা ছাড়া কিছুই পাইনি। রাষ্ট্র থেকে কয়েকটি সার্টিফিকেট ছাড়া কিছুই পাইনি। তবে বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন, তার কথায় প্রশাসন ওই আমলে বাবার কবর বাঁধিয়ে দিয়েছে। তিনি থাকলে হয়ত অনেক কিছুই হতো। দোষ হয়ত আমাদের ভাগ্যের, নয়ত ৭৫-এ কেন বঙ্গবন্ধুকেও জীবন দিতে হলো। তারপরও অনেকের কাছে গেছি আবার যাইওনি। বেশিরভাগই ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে সত্যি বলতে কী, যারা সতিক্যারের মুক্তিযোদ্ধা—তারা বা তাদের পরিবার ভালো নেই। ’



বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।