ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হাসি-কান্নার পাল | আহমদ জসিম

বৈশাখের আয়োজন / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
হাসি-কান্নার পাল | আহমদ জসিম

একজন ইমানদার নামাজি রুমমেট আবশ্যক’—ঠিক বুঝতে পারছি না কী কী শর্ত পূরণ হলে একজন মানুষকে ইমানদার মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই বাজারে চাকরি পাওয়া যদি হয় সোনার হরিণ হাতে পাওয়া, তবে একজন ব্যাচেলরের জন্য—একটা রুম খুঁজে পাওয়া তার চেয়েও বেশি বৈ কম নয়! তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আপাতত ইমানের সঙ্গে বেঈমানি করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।

বাংলামোটরের আন্ডারগ্রাউন্ডে বিক্রি হচ্ছে নামাজের নানা উপকরণ, সেখান থেকে কিনে নিলাম একটা দপদপে সাদা টুপি, সেটা পকেটে এমনভাবে ভাঁজ করে রাখলাম যাতে রুমমেট কর্তার সহজে দৃষ্টি গোচর হয়! এবার ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম ২৩ এফ/বি চতুর্থ তলার দিকে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, চল্লিশ ছুঁই ছুঁই শ্যাম বর্ণ মাঝারি উচ্চতার এক ভদ্রলোক। রাশভারী কণ্ঠে: ‘কী চাই?’ আমি অতি বিনয়ের স্বরে: ‘জ্বি, আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন...’ ভদ্রলোক এবার দরজাটা পুরো খুলে দিয়ে চোখের ইশারাই ঘরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। আমি সুবোধ বালকের মত ঘরে ঢুকে একটা খাটের ওপর বসলাম। ভদ্রলোক আমার মুখোমুখি বসে বলল: ‘বলতে পারেন এই রুমের কর্তা আমি, নিয়েছিলাম একা থাকব বলে, কিন্তু এত বড় ঘরে একা থাকলে কেমন হাঁপিয়ে উঠি, তাই একটা রুম রেখে বাকি দুই রুম ভাড়া দেওয়া। একটা রুম ইতিমধ্যে তিনজন মিলে নিয়েছে, তিনজনেই ঢাবি’র স্টুডেন্ট। আপনে চাইলে দুইজন মেম্বার নিতে পারেন, সে ক্ষেত্রে ভাড়া দুই হাজার করে। আর পুরো রুম নিলে ভাড়া হবে পাঁচ হাজার টাকা। ’ আমি দ্রুত বলে উঠলাম: ‘আমার পুরো রুম প্রয়োজন। ’ ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তক এক নজর পর্যবেক্ষণ করে  জানতে চাইল: ‘কী করা হয়?’ আমি নিচু স্বরে: ‘একটা সাপ্তাহিক সাহিত্য-পত্রিকার সাব এডিটর। ’ ভদ্রলোক এবার উদাস ভাবে: ‘ও আচ্ছা’—কথাটি এমন ভাবে বলল, মনে হলো আমার কাজটা যেন সিনেমার ব্ল্যাকে টিকেট বিক্রির মত কোনও কাজ। নিজের ক্ষোভকে চেপে রেখে জানতে চাইলাম: ‘আপনার পেশা?’ ভদ্রলোকের রহস্যময় উত্তর: ‘সময় হলে সব জানতে পারবেন, আগে রুম পছন্দ হয় কিনা দেখুন। ’ আমার আপাতত রুম হলেই চলে, তদুপরি নিজের গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য ভদ্রলোকের পিছু পিছু রুমটা দেখতে গেলাম। ‘কোন এটাস্ট বার্থ নেই?’ জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে: ‘নেই তা তো দেখতেই পারছেন, শুধু আমারটা তে আছে আপনাদের জন্য কমনবার্থ। ’ আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই, তাই কোনও রকম চিন্তা না করে বলে  ফেললাম: ‘ঘর আমার পছন্দ হয়েছে। ’ ভদ্রলোক এবার গম্ভীরভাবে: ‘হু, তবে চলুন এবার কন্ডিশনগুলো জানিয়ে দিই। ’ আবারও সেই খাটে মুখোমুখি বসে শুনলাম শর্তগুলো: ‘১/ এক মাসের ভাড়া এডভান্স দিতে হবে। ২/ চলিত মাসের দশ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে। ৩/ ঘরে ধূমপান করা যাবে না। ৪/ নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে। ’ জানতে চাইলাম: ‘নামাজ কি আপনাদের সাথে পড়তে হবে?’ ‘আপনার সুবিধামতো পড়ে নেবেন’—ভদ্রলোক বললেন। আমি রাজি, কাল এসে এডভান্সটা দিতে চাই। ভদ্রলোক জানিয়ে দিল: ‘ কাল ঠিক এতক্ষণের দিকে আসতে হবে। ’ আমি বিদায় নিলাম।

২.
তেল চিটচিটে বালিশ আর ছারপোকা কিলবিল করা একটা চৌকিতে শুয়ে আছে আজম মামা, অর্থাৎ এই ঘরের সর্বময় কর্তা। যে আমার কাছে দয়া করে ঘরটা ভাড়া দিয়েছেন। তার খাটের একপাশে জাকির রুবেল আর ফারুক তিনজনেরই বয়স ১৮/১৯ এর বেশি হবার কথা নয়। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। মুখে এক ধরনের সারল্য আর বোকা বোকা ভাব। সদ্য গ্রাম থেকে আসা তরুণদের যা হয়। তিনজনেই ভদ্রলোককে মামা বলে সম্মোধন করে, বাধ্য হয়ে আমাকেও তাই বলতে হচ্ছে। তার রুমে গিয়েছিলাম দুপুরে খাব না বিষয়টা জানাতে, গিয়ে দেখি আজম মামা বলছে আর তিন যুবক গোগ্রাসে তার কথা গিলছে! আমাকে দেখেই দ্রুত বলে উঠল: ‘সাংবাদিক সাহেব আসুন, বসুন। ’ আমি জানতে চাইলাম: ‘আপনাদের বিরক্ত করলাম না তো?’ আজম  দ্রুত বলে উঠল: ‘না না, তা হবে কেন? দেখুন না, এই প্রজন্মের  ছেলেরা কেমন বেকুব—নোবেল পুরস্কার কারা পায় জানতে চাইলাম, তাও বলতে পারল না! ছেলেগুলো আমার সামনে তাদের মূর্খতা উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে দেখে লজ্জাই মুখ-মলিন করে ফেলল। আমি ছেলেদের হতাশা কাটাতে বলে উঠলাম: ‘ও আচ্ছা, আমারও তো ঠিক জানা নেই নোবেল কেন পায়। ’ ছেলেগুলো এবার যেন একটু স্বস্তি পেল। তারপর দুপুরে খাব না—বিষয়টা জানিয়ে দ্রুত বিদায় নিলাম। এভাবেই সময় অতিক্রমের সাথে সাথে আমিও এই পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। কিন্তু সময় অতিক্রমের সাথে সাথে আজম ক্রমশ আমার আছে আরও দুর্বোধ্য রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল! রহস্য অন্যকিছু  নিয়ে নয়, তার ভাবলেশহীন নিশ্চিত জীবন আর অর্থের উৎস নিয়ে! চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন, আর সারাদিনের আঠার থেকে উনিশ ঘণ্টাই আজম  তার রুমের  খাটে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়, যদিও সপ্তাহে দু’একদিন ওই রুমের বন্ধন ছেড়ে বের হয়, তবে সেটা কোনও ক্রমেই  ঘণ্টা চারেকের বেশি সময়ের জন্য নয়।

আজমের রহস্যময় জীবন উন্মোচনের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছি, প্রত্যকবারই তার রহস্যময় জবাব আর চতুরালি এড়িয়ে চলার কাছে আমি ব্যর্থ! বলে রাখা ভালো, আজম তরুণদের সাথে যতটা অন্তরঙ্গ আমার কাছে ঠিক ততটা রাশভারী! আজম যেন এই তিন তরুণের কাছে এক মহামানব! অস্বীকার করব না: আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে, কোথাকার ওই আজম তিন তরুণের কাছে আইডল হয়ে ওঠাতে আমি প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছি, সেই সাথে এটাও জানি, তাদের কাছে আইডল হবার কারণ আজমের ভাবনাহীন নিশ্চিত জীবন। আজমকে ঘর ভাড়া কিংবা খাবারের বিল পরিশোধ নিয়ে, চিন্তা করতে আমরা  কখনও দেখি নিই, বরং সবার আগে তার টাকা পরিশোধ হয়! কিন্তু সময় অতিক্রমের সাথে সাথে লোকটার প্রতি আমার সন্দেহ আর ঈর্ষা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে! দুঃখের কথা সেই সন্দেহ প্রকাশের কোনও সুযোগই পাচ্ছি না। পাচ্ছি না, কারণ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত কোনও তথ্যই আমার হাতে নেই। তবুও দু’একবার যে চেষ্টা করিনি তা নয়, যতবার বলতে গেছি, ততবার সেই তরুদের কাছে উল্টা অপদস্ত হয়েছি!  যেমন, একবার রুবেলকে বলেছিলাম: ‘আজম মামা মানুষটাকে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়! সাথে সাথেই পুঁচকে ছেলেটা আমাকে উপদেশ বাণী শুনিয়ে বলল: ‘কারণ ছাড়া মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ। ’ সত্যিই তো, তাকে অবিশ্বাস করার কারণ কী? কিন্তু আমার মন যে মানতে চায় না। আরেকদিন ফারুকের সামনে বলেছিলাম: ‘আচ্ছা আজম মামার আয়ের উৎস কী?’ ফারুক আমার দিকে বিরক্তভাবে তাকিয়ে বলল: ‘চুরি যে করে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ’ তার কথায় আমি লজ্জা পেলাম, সত্যিই তো চুরি যে করে না, সে ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত। খুব ভালো হতো যদি তার পারিবারিক অবস্থাটা না জানতাম। কিন্তু ঘটনাচক্রে তার পারিবারিক অবস্থাও আমার জানা হয়ে গেছে। সেদিন আমার অফ ডে। ফারুক, রুবেল, জাকির বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু আমিই ছিলাম ঘরে। সকাল এগারোটার দিকে দরজায় টোকা পড়তেই দ্রুত খুলে দিলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আধপাকা চুল দাড়িওয়ালা ৫০/৫৫ বছর বয়স্ক এক ভদ্রলোক। সরল মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারলাম গ্রাম থেকে আসা। আমাকে বলল আজমের কাছে এসেছে। বাইরে দাঁড়ানো অবস্থায় আমি তাকে বললাম: ‘তিনি বাইরে গেছেন, তবে কোথায় গেছেন ঠিক বলতে পারব না, আপনি চাইলে ঘরে বসতে পারেন। ’ ভদ্রলোক আমার কথা শুনে গর্জন করে বলে উঠল: ‘অপেক্ষা করার সময় আমার নেই, ঢাকায় নিজের কাজে এসেছি বলেই আজমের মায়ের অনুরোধ রক্ষা করতে আসলাম। ও ঢাকায় বাবুগিরি করে বেড়াচ্ছে আর গ্রামে তার মা উপোস করে মরছে!’ আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে হতবিহ্বল ভাবে তাকিয়ে আছে দেখে বলল: ‘তুমি কি আজমের বন্ধু?’ আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে খেই হারিয়ে কোনও উত্তর দিতে পরছি না দেখে  ভদ্রলোক আবারও বলল: ‘এমন কুপুত্র যেন খোদ শত্রুর পেটেও না দেয়!’ কথাটা বলেই ভদ্রলোক দ্রুত চলে গেলেন। ভদ্রলোক যাবার পর নিজের ভিতর কেমন যেন  উৎফুল্ল ভাব এসে গেল, এই ভেবে যে: হাটে হাড়ি ভাঙার একটা উপলক্ষ হাতে পেলাম! কিন্তু সেই অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে গিয়ে যা ঘটল:

অন্ধভক্ত সেই তিন তরুণ রুমমেট নিয়ে আজম যখন স্বভাবসুলব চাপাবাজিতে মত্ত, ঠিক সেই সময় আমি উপস্থিত হলাম। মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, তিনজনই উপস্থিত আছে। আমাকে দেখেই আজম তার চাপাবাজি থামিয়ে: ‘বসুন সাংবাদিক সাহেব, আমাদের আলাপে যোগ দেন। ’ আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললাম: ‘হাতে সময় নেই। ’ তারপর বললাম গ্রাম থেকে আসা সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটার কথা এবং একই সাথে তার মায়ের করুণ অবস্থার বিষয়! আমার কথা শুনে তিন জোড়া চোখ আজমের মুখের দিকে হতবিহ্বলভাবে তাকিয়ে আছে, এবং সেই সাথে আজমের মুখেও একটা কালোছায়া রেখাপাত করল। কাজ হয়েছে ভেবে যেই আমার হাসিটা চওড়া হতে শুরু করল, তখনই আজম হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল! এমন কথাতেও মানুষ হাসতে পারে? আমার প্রশ্নটা প্রকাশের আগেই আজম বলতে শুরু করল: ‘সেই সমির পাগলাটা আবার এসেছিল?’ কোনও রকম উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবারও বলল: ‘ঢাকায় আসলেই আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে যায়, কাল আমাকে না পেয়ে আপনাকে কিছু গল্প শুনিয়ে গেল। শালা পাগল না হয়ে সাহিত্যিক হলে অনেক ভালো গল্প-উপন্যাস লিখতে পারত, যা হোক আপনার সাথে কোনও বেয়াদবি করে নাই তো?’ এ যেন ইট মারতে গিয়ে পাটকেলের আঘাতে আহত হয়ে ফেরা। শালা কথার মারপ্যাঁচে সাহিত্যিক আর পাগলকে এক বানিয়ে ফেলল! আজমের এক কথাতেই সেই তিন তরুণের বিস্ময়বোধও সঙ্গে সঙ্গেই কেটে গেল।

৩.
ফারুক, রুবেল, জাকির আমার সামনে এসেই একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। আজম  আজ তাদেরকে একটা হোটেলে ডিনার করিয়েছে। অবশ্য আমারও নিমন্ত্রণ ছিল, মানুষটা আমার কাছে ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠেছে বলে সে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি নি। রুবেলের মুখেই শোনা গেল হঠাৎ এই আয়োজনের কারণ। ‘আজম মামার এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি যিনি গতকাল মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন এবং যিনি আজম মামার কাছ থেকে নিয়মিত বুদ্ধি ক্রয় করেন, এবং যে কিনা আজম মামার খাঁটি শিষ্য—সেই শিষ্যের মন্ত্রী হওয়াকে সেলিব্রেট করতেই এই আয়োজন। ’

এই লোকের বুদ্ধি কেনে মন্ত্রী! এটা আজমের কোনও ফাঁদ নয় তো? নিজের ভাবনাগুলো নিজের মনেই রাখলাম। কারণ জানি আজমের অন্ধ মুরিদ এই ছেলেদের কাছে আমার কোনও কথাই ধোপে টিকবে না। আমার সন্দেহ আরও গভীর হলো, যখন দেখলাম আজমের এই মন্ত্রীকে নিয়ে তিন তরুণ তিন রকমের স্বপ্ন দেখা শুরু করল। রুবেল ভাবনা, তার বিএ পাস বেকার খালাত ভাইয়ের চাকরির, ফারুকের আবার ইউরোপে যাবার স্বপ্ন, জাকিরের উদাসীনতায় বলে দিচ্ছে তার স্বপ্ন হয়ত আরও বড় কিছু। আমি শুধু একবার জানতে চাইলাম: ‘আজম মামা কি তোমাদের কোনও আশ্বাস দিয়েছে?’ সঙ্গে সঙ্গে তিন জোড় রক্তচক্ষু আমার মুখের ওপর নিক্ষেপ হলো, মুখে কিছু না বললেও বুকের ভিতর আমাকে যেন পিষে ফেলছে। ওদের অবস্থা দেখে আমি চোখে মুখে অসহায়ত্বের ভাব আনলাম, তখন রুবেল বলে উঠল: ‘আজম মামাকে আশ্বাস দিতে হবে কেন, আমরাই তার কাছে আশ্বাস চাইব। আমি হালকাভাবে বললাম: ‘ও আচ্ছা। ’ মনে মনে বললাম: ‘শালা মরবি। ’

৪.
আমাকে এতদিন পাত্তা না দেওয়া রুবেল আজ হঠাৎ করেই কেমন বিনয় আর অসহায়ভাবে আবদার করল, গ্রাম থেকে তার এক বড় ভাই বেড়াতে এসেছে যদি আমার রুমে এক-রাত থাকতে দিই। জানি, এক-রুমে তিনজন থাকে চতুর্থজনের ভার নেওয়াটা মুশকিলই বটে, আর আজম এলিট মানুষ, তার সাথে আরেকজন রাখার সাহস পাবে কোথায়! হ্যাঁ-না কিছুই না বলে শুধু জানতে চাইলাম: ‘এটাই কি তোমার সেই বিএ পাস খালাত ভাই, যার জন্য চাকরির কথা ভাবছিলে?’ আমার কথা শুনে রুবেল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল: ‘থাকতে দেবেন কিনা সেটা বলেন, এত কিছু জানার আপনার কাজ কী?’ আমি নিমরাজিতে বললাম: ‘থাকবে, সমস্যা কী। ’ না, রুবেলের সেই জনৈক বড় ভাই আমার রুমে আর ছিল না, কারণ এরমধ্যে খবর এলো ফারুক  রাতের ট্রেনেই বাড়ি যাচ্ছে।

ফারুকের হঠাৎ করে বাড়ি যাবার কারণ—কৌতূহল হলেও জানতে চাইনি, রুবেলকে নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে! জাকিরের বাড়ি যাওয়া কিংবা তার খালাত ভাইয়ের আসবে বলেও না আসা, এবং তার বাবার ছেলেকে দেখতে আসার পরিমাণ হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া—ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমি স্পষ্টত একটা সর্বনাশের গন্ধ পাচ্ছি। উপদেশ দিলে কাজ হবে না, কিংবা এই সর্বনাশ আমাকে কোনও মতেই ছুঁতে পারবে না—জেনে এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি শামুকের মত করে। শুধু একবার ফারুকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম: ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, ক্লাস চলছে নিয়মিত, হঠাৎ করে বাড়ি গিয়ে এতদিন থেকে আসার কারণ কী?’ সে আমাকে বিরক্তি-মাখানো কণ্ঠে  বলল:  একটু কাজ ছিল। ’ তাদের কাজের ধরনটা আমার কাছে আরও স্পষ্ট হলো। সেদিন অফিসে কাজ ছিল না বলে, স্রেফ হাজিরা খাতাতে সই দিয়ে রুমে ফিরলাম। অর্থাৎ বেরোবার এক ঘণ্টার মধ্যেই রুমে হাজির। আমার নিশ্চিত ছয় ঘণ্টা অনুপস্থিত থাকার কথা ভেবেই তারা একান্তে আলাপচারিতায় মজেছিল। অসময়ে আমাকে ঘরে দেখেই, সবাই যেন চমকে উঠল! ওদের মনোভাব বুঝে আমি নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম, যাতে আর কারও চোখাচোখি হতে না হয়।

৫.
ব্যাপারটা কাকতালীয়, আজ আমি আর আজম মামা একসাথেই ঘর থেকে বের হলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে যতটুকু কথা হলো: ‘মামার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’ আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে: ‘একটু সচিবালয়ে যাচ্ছি, মন্ত্রীকে কিছু কাজের কথা বলেছিলাম, দেখি কতদূর করল। ’ কথা শুনে রাগে শরীরটা রি রি করে উঠল, ভাবখানা এমন যেন বেটা নিজে প্রধানমন্ত্রী। কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম: ‘খবরের কাগজে পড়লাম মন্ত্রী সাংগঠনিক সফরের ঢাকার বাইরে আছেন। ’ এবার আমার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল: ‘সমস্যা নেই সচিবকে ফোন করে বলে দিলেই হবে। ’ তারপর নিচে নেমে দুইজনের গন্তব্য দুইদিকে। রুমে ফিরেছি রাত আটটার দিকে। ঘরে ঢুকেই দেখি, তিন তরুণ মলিনমুখে সামনের রুমের খাটের ওপর বসে আছে! তাদের এই মহা দুশ্চিন্তার কারণ জানতে চাইলাম না—বিরক্ত হবে ভেবে। তবে এমন অবস্থা দেখে মনে মনে স্বস্তি পেলাম, শরীরের ওপর একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল এই ভেবে যে, আমার শঙ্কা বোধকরী সত্যি হতে যাচ্ছে। একই সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছি শঙ্কা সত্যি হলে তাদের সামনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেটাকে উপভোগ করব কী ভাবে। কিন্তু না, রাত দশটা পর্যন্ত তাদের মুখ থেকে একটা রা শব্দ বের হলো না।

সাধারণত রাতের খাবারের পালা শেষ হয় এগারোটার দিকে। আজ ১০টা বাজেই খেতে গেলাম। যদি এই অজুহাতে তাদের কাছ থেকে কিছু জানা যায়। প্লেট হাতে নিয়ে জানতে চাইলাম: ‘তোমরা কেউ খাবে না?’ ফারুক আমার দিকে একবার ফিরে গম্ভীরভাবে জবাব দিল: ‘না। ’ এরপর আবারও নীরবতা! খেতে খেতে একবার জানতে চাইলাম: ‘মনে হয় তোমাদের সম্মিলিতভাবে মন খারাপ?’ এবার রুবেল এক পলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি খাবার শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বইটা পড়তে শুরু করলাম। এভাবে একটানা ঘণ্টা খানেক পড়ার পর বই থেকে মুখ তুলতেই দেখি, পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফারুক। মুখের ওপর যেন শ্রাবণের ঘন মেঘ জমে আছে। ‘ফারুক কিছু বলবে?’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই শ্রাবণের মেঘ যেন পরিণত হলো ভয়ানক বর্ষণে! আমি হতচকিতভাবে ফারুকের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর তাকে হাত ধরে আমার পাশে বসালাম, তারপর জানতে চাইলাম: ‘কী হয়েছে বল তো?’ ফারুক এবার কান্না জড়িত কণ্ঠে: ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, আজম মামার মোবাইল বন্ধ!’ আমি ঘটনা আঁচ করতে পেরেও না জানার ভঙ্গিতে বললাম: ‘আজম মামার মোবাইলের সাথে তোমাদের সম্পর্ক কী?’ এবার ফারুক আস্তে আস্তে বলে গেল, তার আমেরিকা যাবার ভিসা, রুবেলের খালাত ভাইয়ের চাকরি আর জাকিরদের দখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে তিন পরিবার থেকে মোট নয় লক্ষ টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে, সব কাজ শেষ করে পাঁচটার মধ্যে রুমে ফিরে আসার কথা, অথচ এখন (একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) রাত ১১টা বাজে! ঠিক এমন একটা ঘটনার জন্যই যেন আমি এতদিন অতি আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, ঠিক এমন করুণ কণ্ঠের আকুতি শোনার জন্য! খুশিতে যেন আমি হাওয়াতে ভাসছি, সেই সাথে হাসছি, মনভরে, বুক-ফাটানো হাসি, আমার অট্টহাসির শব্দে যেন পুরো ঘরটাই কেঁপে কেঁপে উঠছে!

আমার হাসি দেখে নিরুপায় তিন তরুণ স্রেফ আমার মুখের দিকে  তাকিয়ে  আছে। হাসিই যেন আমাকে অবহেলা কিংবা অপমানিত করবার সমস্ত হিসাব ওই তিন তরুণকে কড়াই গণ্ডায় বুঝিয়ে দিচ্ছে! ঠিক এই সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে তিন তরুণের মুখ থেকে বিলীন হয়ে গেল শ্রাবণের মেঘ, থেমে গেল আমার হাসি! রুবেল দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল, না, আজম মামা নয়। তিনজন শক্ত-সামর্থ্য তরুণকে নিয়ে ঘরে ঢুকল বুড়া বাড়িওয়ালা। ঘরে ঢুকেই গর্জন করে ডাক দিল আজমকে। আমি ছুটে গিয়ে বললাম: ‘সকালে বেরিয়েছে, এখনও ফিরে নাই। ’ বাড়িওয়ালা এবার গজরাতে গজরাতে বলল: ‘হারামির বাচ্চা, আজ দশটার মধ্যে আমার তিন মাসের ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল, ভাড়া না দিয়ে ভাগছে। তোমরা বাপু আর ঘরে থাকতে পারবা না, ঘরে যা আছে রেখে, এখনই বাহির হও!’ ঘটনার আকস্মিকতায় কী বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। রুবেল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাড়িওয়ালা, গর্জন করে: ‘কোনও কথা শুনতে চাই না’—বলে রুবেলকে থামিয়ে দিল। আমি শুধু টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা নিতে যাচ্ছিলাম, বাড়িওয়ালার  সঙ্গে আসা তরুণদের একজন—মোবাইলটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দিল। তারপর চারজন এক কাপড়ে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় নেমেই হঠাৎ বুক-ফাটা কান্না যেন আমার ওপর ভর করল! আমার আকস্মিক কান্না দেখে তিন তরুণ বিস্ময় নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চাহনি দেখে খুব লজ্জা লাগছে, আবার কান্নাও থামাতে পারছি না।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।