ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মেড ইন চায়না | সালাহ উদ্দিন শুভ্র

বৈশাখের আয়োজন / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
মেড ইন চায়না | সালাহ উদ্দিন শুভ্র

জগতের সকল ওষুধ বিক্রেতার তিনটা বৈশিষ্ট্য থাকে। এক তাদের চোখ খারাপ থাকে।

হয় চোখে চশমা থাকে, নয় চোখের চাহনি খারাপ। দুই তারা হয় খুঁতখুঁতে। অনেকটা প্রুফরিডারের মত। ডাক্তারদের জটিল হাতে লেখা দুবোর্ধ্য সব লিপির পাঠ উদ্ধার করে ফেলতে পারে তারা। এবং প্রুফরিডারদের মতই একটা ভাব নিয়া চলে। মানে কিছু না কিছু জানে তারা। ভাব নেয়ার জন্য আর কী লাগে? তিন নম্বরে তারা স্বভাবে গোয়েন্দা। কার বাড়িতে কী চলতেছে সেটা অনুমানে বুঝে নিতে পারে। নিছক আলুপটল বেচার মত আর তারা মাল বেচতে পারে না। তারে প্রেসক্রিপশনটা দেখতে হয়, রোগীর দিকে তাকাইতে হয়। ওষুধ দেইখা রোগীর নাড়ির খবর সে বইলা দিতে পারে। কার বাড়িতে ডায়রিয়া কি কার বাড়িতে ব্লিডিং হইতেছে এটা তারা সহজে বুঝতে পারে। বলতে গেল এটা তাদের ব্যবসার অংশ।

তওফিক যখন এই ব্যবসায় প্রথম দিকে বসে তখন আমরা স্কুলে পড়ি। স্কুলের শেষ দিকে প্রায়। তওফিকের বাবা তার ছেলেরে নজরে নজরে রাখার জন্য ডিসপেন্সারিতে বসায়া দিছিলেন। শুরুর দিকে কোনটা কিসের ওষুধ, সেসব বুঝায়া দিতেছিলেন। তিনি মোহাম্মদপুর টাউনহলের পাশে এক ডাক্তারের সহযোগী ছিলেন। পরে সেই ডাক্তার চলে গেলেন ধানমণ্ডি। কিন্তু তওফিকের বাবার নিজ মহল্লা ছেড়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তখন কি আর এই মোহাম্মদপুর ছিল। আমরা তখন এটারে মহল্লাই বলতাম। বিহারিদের খুব ভিড় থাকত যদিও। কিন্তু আমাগো লগে তাদের বচসা হয় নাই। মোহাম্মদপুর যে বদলায়া যাইতেছিল, এর দুইটা লক্ষণ আমরা টের করতেছিলাম। একটা ইমরানের ভদ্র হয়ে যাওয়া আরেকটা এই ফার্মেসি।

ভিড়টিড়ও বাড়তেছিল তখন। আমরাও বড় হইতেছিলাম। স্কুলে সবাই এক লগে পড়‌‌‌লেও পরে কলেজে আলাদা-আলাদা। কিন্তু তওফিকের বাপের রকমারি ফার্মেসি টিকা থাকল আমাদের জন্য। এর নাম রকমারি রাখার কারণ হিসাবে ওর বাপের একটা ব্যাখ্যা ছিল। তার দোকানে তিনি অনেক কিছু রাখার প্ল্যান করছিলেন শুরুর দিকে। ব্যবসা যত বাড়বে তত তিনি আইটেম বাড়াবেন বইলা ঠিক করছিলেন। যাই হোক, আমরা সেখানে কলেজের পরে আড্ডা দিতাম মাঝে মাঝে। তওফিকের বাবা মানে তমিজুদ্দিন সাহেব থাকলে যাইতাম না। আমরা দূর থিকা খেয়াল করতাম তিনি আছেন কিনা। যদি না থাকেন তো আমাদের বিকালটা বেশ ভালোই যাইত বলতে গেলে। চাপ-পরোটা, জালি, শিক, ঘুঘনি, ভট, পয়সা কম থাকলে পুরি—মানে বিকালটা আমরা কিছুতেই চাইতাম না যে ফার্মেসিতে আমরা না যাইতে পারি।

শুরুর দিকে আর সব ওষুধের চাইতে কনডমের দিকেই আমাদের ঝোঁক ছিল খুব। কেউ আমাদের সামনে এ জিনিসটা কোনওদিন কিনে নাই যদিও, কিন্তু আমরা বইসা থাকতাম। তখন রাইতের দিকে এই প্রতিরোধক বেশি বেচা হইত বইলা তওফিক একদিন আবিষ্কার করল। তার ভাষায়, সে যখন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরা গেছিল, তার আগে বাপ দোকানে না-থাকা অবস্থায় সে গুনে গেছিল কয়টা আছে। দুপুরে যখন আবার ফিরল, তখন গুইনা দেখল প্যাকেট কম আছে। তার মানে রাইতেই সেল হইছে। আমি কইলাম,
- সকালেও তো সেল হইতে পারে।
তওফিক কিছুতেই মানবে না। তার কথা হইল এটা তো আর টেট্টাসাইক্লিন না যে সকাল বেলায় পেট ছুটবে আর লোকে সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিয়ে যাবে।
- বুঝলি না এসব কাম তো মাইনষে রাইতে করে।
আমি ভাবলাম কথা সত্য। আর বইসা থাকতাম তেমন কোনও খদ্দেরের আশায়। সে আশা সহসা মিটতেছিল না। তওফিকের বাবা মিডফোর্ডে মাল কিনতে গেলে কোনও দিন রাইত হইত, কোনওদিন তার শরীর খারাপ হইলে তওফিক রাইতে ফার্মেসিতে বসত। আমার বাসা থিকা ছুটি মিলত না। ইমরান দুয়েকদিন বসছিল। কিন্তু লাভ হয় নাই। কেউ ওই জিনিস কিনতে আসে নাই আমাদের কাছে।

কিন্তু পরে আমরা ধরতে পারছি। আমাগো পোলাপানের কাছে কেউ এ জিনিস নিতে আইব না। তওফিকের বাপের কাছ থিকাই তারা জিনিসটা কিনে। তওফিক ছেলেটা আসলেই প্রতিভাবান। সে ধরে ফেলল কেমনে এটার বিক্রি চলে। পরিচিতজনরা তার বাবারে আগেই বইলা রাখত হয়ত। বাবা সেটা প্যাকেট কইরা রাখত, এবং ওই লোকটা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবা প্যাকেট বাইর কইরা দিত। বা দোকানে থাকলেও ইশারা দিত। প্রথম প্রথম তওফিক বুঝতে পারে নাই, কী এটা। একই ঘটনা কয়েকবার ঘটে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল বিষয়টা কী। এভাবে এই অপরিহার্য এবং গোপন জিনিসটার বেচাকেনা চলে।

তবে জিনিসগুলা বরাবরই লুকায়া রাখা হইত। মানে কেউ তওফিকের কাছে চাইলেও সে দিতে পারত না। জিনিসটা দোকানে আছে, কিন্তু তওফিকের জন্য নাই। এরপর আমি আর ও দুইজনেই পরীক্ষা নিয়া ব্যস্ত হয়া গেলাম। দেখা হইলেও ফার্মেসির কথা ভুইলা গেছিলাম। পরীক্ষা শেষ হইলে আবার ঘুরতেও যাওয়া হইছিল এদিক-সেদিক। একবার ফার্মেসি থিকা রেহাই পাওয়ার পর তওফিকও আর বসতে চাইতেছিল না। তার বাবা একা একা রোগবালাইয়ের ওষুধ বেচে। আমরা শ্যামলীতে সিনামা দেখতাম লুকায়া। ওয়ারিশের বাপের পকেট মারার অভ্যাস ছিল। আমারও স্বভাবে এমন দোষ ছিল। তয় শ্যামলীও যাইতে হইত সবার নজর এড়ায়া। আশপাশে একটাই সিনামা হল বিধায় পরিচিত জনের দেখা পাওয়া একটা কমন বিষয় ছিল। লুকায়া সিনামা দেখা আর বিড়ি ফুঁকার তালে তালে আমাদের শরীরে অযাচিত বাসনা গজাইতেছিল। বেশ ফুরফুরা থাকতাম। পাশটাশ কইরা আবারও আমরা কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হইলাম। ইমরান ঢাকায়। আমি সিটি আর তওফিক মিরপুরে। তিনজন তিন জায়গায়। দেখা হওয়ার উপায় নাই। ফলে কলেজ শেষ কইরা আবারও রকমারি ফার্মেসিতে গিয়া বসা হইত। কিন্তু ততদিনে মোহাম্মদপুরে ধুলার পরিমাণ বাড়তে আছে। এখানে-সেখানে কনস্ট্রাকশানের কাজ শুরু হইছে। অপরিচিত মুখের সংখ্যা বাড়তেছে। এগুলা আসলে আগেও ঘটতেছিল, কিন্তু আমাদের খেয়াল করা হইতেছিল না। ইমরান দেখি খুব ভদ্র হয়া যাইতেছে। তারে একদিন ধরলাম আমি আর তওফিক, আসাদ গেটের রাস্তায়। হালায় দেখি প্যান্ট ইন কইরা কই যাইতেছে। জানতে চাইলে কইল পড়াইতে যায়। আমরা কইলাম তুই তো ওস্তাদ চেঞ্জ হয়া যাইতেছস। ইমরানের তাতে আপত্তি নাই।
- বুঝিস না। এখন কি আর আগের মত থাকা যায়? নতুন নতুন মানুষ আসতেছে এলাকায়। নিজেরা নিজেরা একটা না হয় ছিলাম। কিন্তু এখন তো আগের মত চলা যায় না।

ওর কথা বুইঝা উঠতে আমাদের সময় লাগল অনেক। আমরা ওরে গালিটালি দিয়া রকমারিতে গিয়া বসলাম। সেখানেও একটা চেঞ্জ দেখলাম। তওফিকের আর প্রটেকশন বেচাতে বাধা নাই এখন। কারণ বিক্রি বাড়ছে। দিনের যেকোন সময় এসব বেচা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হইছে। তওফিকের বাপ আমাদের বসায়া দিয়া চইলা গেল। কী যেন একটা ব্যাপারে তওফিক চুপ আছে। আমারও কেমন কেমন লাগতেছিল। ঠিক যুইতের যাইতেছিল না আরকি সময়টা। কলেজটাই এখন যেন বেশি টানে আমাদের। মহল্লায় মানুষের যাওয়া-আসা বাড়তে থাকে। মানুষ কত কী সব ওষুধ চায় যেগুলা থাকে না ফার্মেসিতে। ফলে ঘন ঘন তওফিকরেও মিডফোর্ড যাইতে হয়। সে কখন যায়-আসে বুঝি না। কলেজেও আমরা আগায়ে গেছিলাম অকেদূর তখন। সেখানকার বন্ধুরা যারা পাশাপাশি থাকে, তাগো লগে আড্ডা দেই। মুস্তাকিমে বসি বা রিংরোডে ফুচকা খাই। বসিলার ওইদিকটায় যাওয়া হইত। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরনের তাগাদা কইমা আসতেছিল।

তওফিকের লগে যদিও আমি যোগাযোগ রাখি। রকমারিতে গিয়া বসি। তওফিক এখন অনেক ওষুধ চিনে। ওষুধের জটিল ব্যবসা সে বুঝে নিতে পারছে অনেকটা। আমারে মাঝে মাঝে বুঝায়। সময় কাটে আরকি। তাছাড়া আমরা অনেকদিনের বন্ধু, যেকোন বিষয়ে আলাপ করতে ভাল্লাগে। তওফিক তার দোকানের আশপাশের, বাড়ি-ঘরের কে কী সমস্যায় আছে সেগুলা আমারে বুঝায়া দিতে থাকে। তার বাবারে সব হিসাব বুঝায়া দিতে হয়। দোকানে একটা লোকও রাখছে তারা। তাদের বয়সী একটা ছেলে। কিন্তু মালিক বিধায় খাতিরটা সীমানার মধ্যেই আছে। তওফিক তার কলেজের কথা বলে। বান্ধবীদের কথা বলে। শরীর এখন নাকি কোনও বিষয়ই না। যেহেতু প্রটেকশন আছে। তওফিকও চাইলে পারে। কিন্তু দোকানের ছেলেটার জন্য এসব কথা বেশি বলা যায় না। নিজেদের গোপনীয়তা কইমা আসায় কিছুটা হতাশও হইতেছিলাম আমরা। আবদমন কইরা চলতে হয় বেশিরভাগ সময়।

আমার যদিও সময় আছে কিন্তু তওফিকের সময় হয় না। রিপ্রেজেন্টিটিভরা আসে নিয়মিত। তারা ইদানীং চায়নিজ মালের তারিফ করে খুব। সেগুলা গছায়া দিতে চায়। কিন্তু তওফিকের বাবার খুব নিষেধ আছে—উল্টাপাল্টা ওষুধ কিনার ব্যাপারে। মিডফোর্ডেই নাকি ভেজাল ওষুধ বানানি হয়। তবু দুই-একটা চায়নিজ ওষুধ কিনতে হয়, এতে লাভ থাকে কিছু। লং লাস্টিং জন্মনিরোধকও। তবে এসবেরও দামের তফাত আছে। কেউ বেশি দামিটা কিনে, কেউ কম দামিটা। কিছু কিছু রিপ্রেজেন্টিটিভ আবার ফ্রি দিয়া যায়। তারা আশপাশে বইলা বেড়ায় যেন প্রতিরোধক পইরা নেয়। তাইলে অমুক রোগ-তমুক রোগ হবে না। ফলে এ ব্যবসায় বেশ ভালোই লাভ দেখা যাইতেছে। এর মধ্যে আবার লং লাস্টিংয়ের বিক্রি বেশি।

একবার বিকালে কোনও কাজ নাই দেইখা গেলাম রকমারিতে। ওয়ারিশ একা বইসা হাসতেছে দেখি। আমারে দেইখা হাসি উচ্চকিত হইল। কইল দোস্ত ইদানীং দুই-একটা লং লাস্টিং চুরি যাইতেছে নিয়মিত। একটা-দুইটা হইলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু  কয়েকবার এমন হওনে হিসাব মিলল না। তা আমি ছাড়া তো দোকানে আর থাকে ওই পোলাডা। অরে জিগাইলাম। সুরসুর কইরা বইলা দিল ঘটনা। লং লাস্টিংয়ের ব্যাপারটা তো এখন ধর সবাই জানে। তা বুঝলি না, হা হা। কিন্তু আমি হাসতেছিলাম কী জন্য জানস?
- হা হা হা, জানুম না আবার।
- আমরা ধর সারাক্ষণ এসব নিয়াই বইসা থাকি। কিন্তু, বিলাতিতেও নাই, চায়নিজেও নাই। হা হা হা...



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।