ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নিভৃত নতুন | রাবেয়া বসরী

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৪ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫
নিভৃত নতুন | রাবেয়া বসরী

‘ঘোড়ার ডিম’ কথাটা প্রথম কোথা থেকে জেনেছিলাম বা কার মুখে শুনেছিলাম আজ আর মনে নেই। তখন আমি অনেক ছোট।

ছুটির দিন দুপুর বেলা বাবাকে বলেছিলাম, বাবা আমাকে একটা ঘোড়ার ডিম এঁকে দাও তো। সবাই মিলে তখন বাইরে বেড়াতে যাব, তখনই জেদ ধরলাম এঁকে দেবার জন্য। বাবা বলেছিল, “এখন তো বাইরে যাচ্ছি মা, বাসায় এসে এঁকে দেই?” বাবার মনে তখন কি কৌতুকটাই না খেলা করেছিল তা ভেবে আজ হেসে উঠি নাকি নিজের বোকামির কথা ভেবে হাসি, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। রাতে বাসায় এসেই খাতা পেন্সিল নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিলাম। বাবা, আমার ঘোড়ার ডিম এঁকে দাও। আমি আমার রঙের পেন্সিল নিয়ে বললাম, বাবা কী রঙ হবে এটার? কোন রঙটা দেব বাবা? বাবা হেসে হেসে শুধু বলেছিল, এর কোনো রঙ হয় না মা। এর কোনো আকার হয় না। এর মানে হলো অলীক বস্তু। দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এরপর হয়ত স্বভাবসুলভ আরো কিছুক্ষণ জেদ করেছিলাম কি কেঁদেছিলাম—মনে নেই।

অলীক শব্দটার সাথে ওই বয়সে তখনও আমি পরিচিত হইনি। বুঝতেও পারছিলাম না এসব কী বলছে বাবা। আজ মনে হয়, যা দেখা যায় না, যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই অলীক? কিসের অস্তিত্ব নেই? মনগড়া কিংবা কাল্পনিক কিছু? মায়াময়? কী নেই? যা ছিল তা নেই? যা ছিল না, তা দেখা দিয়ে আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায় সেরকম কিছু?

যা হোক, নেই তো কী হয়েছে? যা নেই, তার বুঝি রঙ থাকতে নেই? আমি বাবাকে বলেছিলাম, তাহলে বাবা আমি যেমন খুশি তেমন আঁকি আর রং করি? বাবা সায় দিয়ে বলেছিল, আচ্ছা। আমি খুশিমনে ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে গেলাম আঁকতে। আমি কোন সে অলীক গল্পরেখা এঁকেছিলাম সে রাতে? কোন অলীক বৃত্ত, যার ভেতর আজও প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খেয়ে যাই কিছু প্রশ্ন নিয়ে, কিছু জিজ্ঞাসা নিয়ে? কোনো মায়াময় মানুষের মুখ, যা ছিল না, যা দেখা দিয়ে হারিয়ে যায়? নাকি আঁকবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, যে প্রস্তুতি শেষহীন আঁকাবাঁকা কোনো এক জীবনপুরের দিগন্ত রেখা, যার প্রস্তুতি নিতে নিতেই জীবন ফুরিয়ে যায়? কিংবা মৃত্যুর মতো নিশ্ছিদ্র শান্তিময় যাপিত কোনো জীবনের মাত্রা এঁকে চলেছিলাম সারারাত ধরে যে মাত্রায় অপেক্ষার কাল থেমে থাকে? কিংবা এমন কোনো মনগড়া জীবন, যেখানে মৃত্যুর মতো কষ্ট আছে বলে সবাই মাটির মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে? অথবা আমি সেই পথিকের পথ এঁকেছিলাম, যে পথ হারিয়ে গেলে পথিককে শুনতে হয়, “পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছো?” যে পথের খোঁজে একদিন আমিও পথে বের হয়ে যাব...

এইসব কী ভাবছি আমি, এমনই হয় ছুটির অলস দিনগুলোতে। আমার এই এক চিলতে বারান্দায় এসে বসলেই কোথা থেকে যে এতসব ভাবনারা চলে আসে, মনের ভেতর কেউ একজন কথা বলে যেতেই থাকে। সারাক্ষণ। ক্লান্তি নেই, অভিযোগ নেই। কথার পর কথা বলে চলে। আমি শুনি। কথা শুনতে শুনতে আমি চা বানাই, রিক্সা নিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াই, ছাদে শেষ বিকেলের আলোয় হাটি, কাজ করি আর এক সময় কথা শুনতে শুনতেই  ঘুমিয়ে যাই। আর যদি কথা না শুনি, ডেকে সারা না পাই, তো বলি, কি ঘুমিয়ে গেলে বুঝি? নাহ, আবার তার কথা বলা শুরু হয়। আমি শুনি।

আজকের আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে সকাল থেকেই। ছুটির দিন। সারারাত ঘুম হয়নি। শুধু বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলে চলেছে, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো? ভোরের আলো দেখা দিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। চোখে মুখে পানি দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে এসে বসেছি বারান্দায়। ভোরের আলো অন্ধকারে কি কোন বোধ কাজ করে, মাথার ভিতরে? স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে কি কোন এক বোধ জন্ম নেয়, যার কথা লিখেছিলেন জীবনানন্দ?  চা জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি চুপচাপ বসে থাকি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো সহজ মহৎ বিশাল গভীর... পেছন থেকে মিলিবুবু এসে দাঁড়ান। আমি তার দিকে তাকালে বলেন, “একি চোখের নিচে এমন কালি পড়ে আছে? ঘুম হয়নি বুঝি? তা হবে কেন? সারাক্ষণ তো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা আর মনে মনে কী সব ভেবে চলা। অত ভাবলে কি চলে? আমি যাই, আমার তো কাজ আছে, টেবিলে নাস্তা খেতে খেতে কথা হবে। ”

একগাদা কথা বলে মিলিবুবু চলে গেলে আমি আবার ভাবনায় হারাই। এই যে মিলিবুবু, আমি তো কিছুদিন আগেও জানতে পারিনি পৃথিবিতে এমন মানুষও আছেন, অন্তত মানুষের পক্ষেও যে মিলিবুবুর মতো মানুষ হওয়া সম্ভব, আমি এখানে না এলে কিংবা কে জানে, জীবন আমাকে এখানে না নিয়ে এলে জানা হতো না। আর চাচা-চাচী? মানুষ বুঝি এমন সাধারণ হতে পারে, অনিশ্চিত এই জীবনটা বুঝি এতটাই সুস্থির হতে পারে, মানুষ এত নিভৃতভাবে জীবনকে যাপন করতে পারে, তা তাদের সাথে দেখা না হলে জানা হতো না। তাদেরকে দেখার পর থেকে  জীবনটাকে বরং এখন ওই চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডির ভেতর না রেখে জানা-অজানার ভেতর দেখতে ইচ্ছে করে।

যে জীবনে চাওয়ার সাথে পাওয়ার কোনো যোগাযোগ হয়নি, যা চাইতে পারিনি, তাও পেয়ে গেছি আবার যা পেয়েছি তা যেন আসলে পাইনি কোনোদিন। আর যা চেয়েছিলাম, তা তো পুর্ব জীবনের কথা। যার যা দেবার কথা ছিল, যাকে যা দেবার কথা ছিল, তা অন্য কেউ এসে দিয়ে যায়, হিসেব মতো আমারও অন্যকাউকেই দেবার প্রশ্ন চলে আসে। জীবনে কতবার যে নিশ্চিন্ত হলাম। কতবার বুক ভরে শ্বাস নিলাম। তা সেই নিশ্চয়তাই বা কোথায় রইল আর আমিই বা কোথায় চলে এলাম! পেছনের জীবনের বাঁকে বাঁকে যা কিছু চোরাস্রোতে হারিয়ে গ্যাছে, যা কিছু প্রবল বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষায় ছিল, সেই জীবনের ঘোর যেন কেটে গ্যাছে। নতুন করে যেন আর চাইবার কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই। কাউকে বিশ্বাস করবার মতো আর অবশিষ্ট কিছু থাকে না শেষ পর্যন্ত। তাই অবিশ্বাসও করি না। কেবল মনে হয়, জীবনটাকে এতখানি জেনে নিলাম, চিনে নিলাম। না হয় আরো নতুন কোনো অর্থ জেনে যাব জীবন যখন যেখানে যেমন করে যাপিত হতে থাকবে।

এই শহরে একা একজন নারী তার মতো করে বাস করছে, এ তো কেবল গল্প, সিনেমায় সম্ভব বলেই জানতাম। আমিও কি ভেবেছিলাম, আমি একটা ঘর খুঁজে পাব নিজের মতন করে বেঁচে থাকার জন্য অন্তত যতদিন আয়ু আছে কিংবা ছোট শিশিতে জমানো সেই আমার অগনিত ঘুমের ঔষধগুলো যতদিন না খেয়ে ঘুমিয়ে যাই... একদিন অফিস থেকে আসবার পথে বাসের ভেতর চাচীর সাথে প্রথম দেখা। কেন জানি, তিনি আমার সাথে এক কথা দু কথা বলে গল্প জুড়ে দিলেন। তাঁর প্রথম জীবনের কথা, সন্তানদের কথা আর এই জীবনের শেষ বিকেলে এসে এখন কেমন দিন পাড়ি দিচ্ছেন, সেইসব কথাই বলে চললেন। সেদিন খুব বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় জ্যাম বেঁধে গিয়েছিল। বাদাম ভাজা, ঝালমুড়ি নিয়ে বাসে উঠছে বিক্রেতা কিছুটা বাড়তি লাভের আশায়। চাচী বাদাম কিনে কথা শুরু করলেন। কেমন করে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেই তাঁর বিয়ে হয়ে গেল, অথচ চাচার কোনো চাকরি ছিল না,  জীবন শুরু করবার ঘোর লাগা সেইসব মাতাল দিন, তারপর জীবনের সেইসব সংগ্রাম, সুখের দিন দেখবেন বলে কষ্ট স্বীকার, তাঁর দুই সন্তানের কথা, যারা আজ আর দেশে নেই। দুজনেই বিয়ে করে প্রবাসী জীবন যাপন করছেন, আর চাচা-চাচী ছ’মাস কিংবা বছরে একবার সেখানে ঘুরতে যান। সেখানে তাদের সন্তানেরা রেখে দিতে চাইলেও ফিরে আসেন এই শহরে, তাদের ছায়াঘেরা একতলা বাড়িটিতে।

আর মিলিবুবু যখন অনেক ছোট, তখনই বাবা মাকে হারান। সেই থেকে মিলিবুবুকে চাচা-চাচী নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছেন। মিলিবুবু শাসন করলেই তাঁরা বলেন, “আল্লাহ তো আমাদের নিজেদের ঘরে মেয়ে দেননি, তা মিলিকেই পাঠিয়ে দিলেন। ” মিলিবুবু এখন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। মিলিবুবুর বিয়ে হয়েছিল বছর ছয় আগে। দু বছর না পেরুতেই সন্তান না হওয়ায় দোহাইয়ে মিলিবুবুর স্বামী আবার বিয়ে করে। অথচ দুজনেই জানত সমস্যা মিলিবুবুর নয়, স্বামীর। মিলিবুবু তাঁর নিজের আত্মসম্মান নিয়ে চলে আসেন চাচা-চাচীর কাছে। আর ফিরে যাননি। অথচ মিলিবুবু চলে আসবার দু মাসের মাথায় জানতে পারে সেই মেয়েটিও চলে গিয়েছিল, লোকটার ওই বিশেষ অক্ষমতার জন্য। মিলিবুবুর স্বামী কতবার যে এসেছিল পরে, তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু মিলিবুবু যাননি। সেই এক কথাই মিলিবুবুর, “আমি তো তার সব জেনে নিয়েও কখনো কিছু বলিনি, উল্টো আমাকেই তার পরিবারের সবার কাছ থেকে কত খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। তবুও আমি তার দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিয়েছিলাম।   আর সেই লোকটা যে কিনা কখনো প্রতিবাদ তো করেই নি, উল্টো  তার মা-বাবার কথায় আরেকটা বিয়েই করে বসল! তাহলে সেই দুবছর কী ছিল!”

এসব কথাই শুনেছিলাম পরে মিলিবুবুর মুখে। প্রায়ই রাত জেগে মিলিবুবু আমার মাথায় বিলি কেটে দেন, গল্প করেন। মিলিবুবুরও রাত জেগে গল্প করার নেশা। অথচ এই মিলিবুবুই যখন সকালে বের হয়ে যান নিজের কাজে, যেন এক অন্য গ্রহের মানুষ, অনেক দূরের, যার সামনে দাঁড়াতেও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। মিলিবুবু তার অবসর সময়ে নিজের গড়ে তোলা স্বপ্ন নিয়ে থাকেন। অসহায় মহিলাদের কাজ করবার, থাকবার, নতুন করে শিক্ষা লাভের পথ করে দিয়েছেন। মিলিবুবু বলেন, “তোমরা তো সবাই কষ্ট করছিলে এতদিন, কারো ছেলে কষ্ট দিত তো কারো স্বামী। ওটা কি বেঁচে থাকা? তার চেয়ে এমন কষ্ট করো যা সস্তি বয়ে আনবে, উপার্জন করো। সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকো। ওই পড়ে পড়ে মার খেয়ে যে কষ্ট, তা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, জীবনের দিকে নয়। ওটা বেঁচে থাকার পথ হতে পারে না। ”

এই যে এত কিছু করছেন মিলিবুবু, আবার যতক্ষণ বাড়িতে আছেন, মজার মজার নতুন খাবার বানানো, সবাইকে নিয়ে নতুন ভালো কোনো সিনেমা দেখতে বসে যাওয়া আরো কত কী! অথচ নিজের এত সব কাজের কোনো প্রচারণা নেই। যদি বলি, “বুবু, এই যে তুমি অসহায় নারীদের জন্য এমন কাজ করছো, এটাই তো আসল নারী আন্দোলন। মাইকে চিৎকার করে, মিটিং মিছিল আর দিবস পালন করে কি নারীমুক্তি আসে? সংসারে নিজেকে যোগ্য করে নিতে জানলে তখনই তার পেছনেই ভিড় হয়, তা সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক। আজ তোমার গড়ে তোলা এই সংগঠনে প্রায় পনেরশ’ মহিলা আছেন। যারা প্রত্যেকেই এখন ভালো আছেন। অথচ তোমার কোনো প্রচারণা নেই কেন?” মিলিবুবুর সেই এক কথা, “আত্মপ্রচারণা আর নিজেকে নিজের হাতে নগ্ন করা একই মনে হয় আমার কাছে। আমি যদি ভালো কিছু করেই থাকি, যাদের জন্য করছি তারাই বলবে বলার মতো হলে। ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার মহৎ হবার বাসনা নেই। নামের প্রয়োজন নেই। আমি সুস্থির এই জীবনটাকে শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চাই। ”

মিলিবুবুকে দেখে দেখে হঠাৎ একটা কথা মনে হলো, বিশ্ব-সংসারে তিন ধরনের লোক আসে। মিলিবুবুর মতন, যারা সামনের আঁধার, জঞ্জাল কেটে কেটে পথ তৈরি করে আর তার পেছনে ভিড় করে আসে অসংখ্য মানুষ, আর ওই ভিড়ে মিশে যাওয়া মানুষ হলো আরেক ধরনের। আর কিছু মানুষ আসে, যারা পথ তৈরি করে না, ভিড়েও ঠিক ঠিক মিশে যেতে পারে না, দূরে বসে বসে দেখে বিশ্ব-সংসারের খেলা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, এরা যেন যাপিত জীবনে কোথাও নেই, অথচ এরাই হেঁটে বেড়ায় জীবনের অলি গলিতে। সেই যেন বিশ্বসংসার একটা শেষহীন খেলার মাঠ। কেউ খেলায়, কেউ খেলে আর কেউ বসে বসে খেলা দেখে।

এইসব যখন বসে বসে ভাবছি, মিলিবুবু এসে পেছন থেকে আমার কাঁধে তার হাত রাখতেই চমকে উঠলাম। বাইরে চেয়ে দেখি, জমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আজকের সকালটাই কেমন যেন। আঁধার করে আছে চারিদিক। আমি মিলিবুবুর সাথে খাবার ঘরের দিকে গেলাম। দেখি চাচা-চাচী দুজনেই বসে আছেন। আমি গিয়ে টেবিলে বসতেই চাচা আমাকে বললেন, “বুঝলে চিত্র, কাল রাতে চমৎকার একটা বই পড়েছি। ” চাচী স্বভাব মতো বলে উঠলেন, “নাস্তা করে তারপর গল্প করো না কেন, সারাদিন তো পরেই আছে। চাচা চাচীর দিকে তারও স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে নাস্তা খেতে খেতে তার কথা বলে চললেন, “গল্পে তেরজন চরিত্র যারা একদিন বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় শহরের এক রেস্তোরায় বসেছিল। সবাই অপরিচিত।   হঠাৎ একজন টেবিলে একটা সংবাদপত্রের খবর পড়তে পড়তে শব্দ করে কিছু বলে ওঠে। একজন এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘কী খবর’, তা সেই খবরের বক্তব্যে দুজন দুরকম মন্তব্য করে, আশে পাশে যারা ছিল, তারাও একে একে আসতে থাকে। তাঁদের কথায় কথায় বুঝলে মা, লেখক জীবনের একটা ঘটনার যে কত রকম দিক হতে পারে, মত হতে পারে, তা বলে দিল। কারো সাথে কারো মত মেলে না, অথচ সবারটাই যেন ঠিক। এমন করে নানা বিষয়ে কথা চলে সারারাত। হয়ত একটা কথা তুমি বললে, সেই কথার প্রেক্ষিতে জীবনের গতিপথই বদলে গেল, আবার হয়ত তুমি বললে না কিছুই, তাহলে যেমন চলছিল তেমনই চলবে। আমাদের প্রতিটা কথা, চিন্তা, কাজ প্রতিমুহূর্তে আমাদের জীবনের মাত্রা বদলে দিচ্ছে, পথ বদলে দিচ্ছে, বেঁচে থাকার ধরন বদলে দিচ্ছে। রাত শেষে সেই এক ভোর আসে, সেই দিন হতে রেস্তোরায় বসে থাকা সেই তেরজনের জীবন বদলে যায়। তখন তারা যে কোনো কিছুতে সমস্যায় পড়লেই ওই রেস্তোরায় এসে বসে। তেরজন ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে। আর তখনই সমস্যা হয়, কোনটা মেনে নেবে, সবগুলোই তো ঠিক! তারপর আর বলব না মা, এরপর সেই অবস্থা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসে, তা তুমিই পড়ে দেখো। চমৎকার সব কথা বুঝলে!” আমি হাসি মুখে মাথা নাড়ি। বইয়ের নাম জিগ্যেস করি, আরও কিছু প্রশ্ন করে বলি, আচ্ছা চাচা নাস্তা শেষ করেই আমি বইটা নেব আপনার কাছ থেকে। এমনই হয় একেকটা দিন। খাবার টেবিলেই বসে বসে পুরনো দিনের কথা, নতুন পড়া কোনো বইয়ের কথা, ভালো কোনো সিনেমার কথা এইসব নিয়ে কত কথাই যে চাচা বলেন! বেশ চলে যায় দিনগুলি। চাচী বলেন, “তুমি আমাদের কাছে এসে ভালো আছো তো মা? মাঝে মাঝে দেখি, তুমি কেমন যেন হয়ে যাও। ” আমি চাচীর হাত ধরে বলি, “এর চেয়ে ভালো আর কিভাবে থাকে মানুষ! কিছু মানুষ যে শান্তি খুঁজে বেড়ায় আজীবন, সেই শান্তিই আজ আমার কাছে আছে। আমার কোনো কষ্ট নেই চাচী। আমি ভালো আছি। ”

আমি গোসল সেরে নিয়ে আজ সকালে গল্প করা বইটা নিয়ে বসি। পাতা উল্টাই। নতুন একটা বই হাতে নিলেই ভালো লাগে। কেমন যেন একটা বোধ হয়। কিন্তু তবু বুঝতে পারি, আজ আমার কী যেন হয়েছে, আমি কি আবার পথ হারিয়ে ফেলেছি! যে একবার পথ হারায় সে কি সারাজীবন পথ হারিয়ে খুঁজে বেড়ায়! একদিন তো ওই পথেই দেখা এই চাচীর সাথে। সেদিন চাচী কত কথাই না বললেন, শেষে বললেন, “খুব ভালো লাগছে। মনটা ঝরঝরে লাগছে। কত কিছু বললাম মা তোমাকে, কিছু মনে করো না যেন। ” বাস থেকে নেমে যাবার আগে ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাগজ আর কলম বের করে ঠিকানা লিখে দিলেন। কে জানত, কাগজের ওই ঠিকানায় একদিন আমায় পৌঁছুতে হবে! সেদিন চাচী চলে গেল। বাস আমায় আমার গন্তব্যে নামিয়ে দিলে আমি বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হয়েছিল, প্রচণ্ড ক্লান্তি এসে আমার ওপর ভর করেছে। আমি যেন অপরিচিত শহরের কোনো এক হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে কেউ আমায় চেনে না আর আমিও, যাদের আমি চিনতে পারিনি অথবা প্রতিদিন যাদের নতুন করে চিনতে হতো! যেখানে এমন মাত্রার জীবন ছিল, যে মাত্রায় আমি কোনোদিন পৌছুতে চাইনি, পৌছুতে পারিনি। ওটা যদি বেঁচে থাকা হয়, তবে আমি বেঁচে ছিলাম কি? ওভাবে বেঁচে থাকা যদি স্বাভাবিক হয়, তবে আমি অস্বাভাবিকভাবে বেঁচে ছিলাম! ওরা সুস্থ মস্তিষ্কে সবাই সচেতনভাবেই অন্যকে ঠকিয়ে হলেও, কারো সরল ভালোবাসাকে ব্যবহার করে হলেও ওরাই যদি ভালো হয়, তবে আমি মন্দ! এমন করেই তো জীবনের অর্ধেক বোধহয় পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম মানুষে মানুষে অথবা নতুন নতুন মুখোশে। রাতের বেলা গান গাইতাম, ও মাগো মা, অন্য কিছুর গল্প বল, এক যে ছিল রাজা রাণী অনেক হলো... মনে হতো, পৃথিবীটা আসলে যে নিয়মে চলে, জীবন যেমন, তার বিপরীত কথাই ছোট বেলায় বইয়ে পড়ে পড়ে বিশ্বাস করে শেষ পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে চলেছি একের পর এক। বাস্তবতা আর ওই সব শিক্ষার বিপ্রতীপে পড়ে পড়ে হোঁচট খেয়ে খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি একসময়। অথচ ছোট বেলায় যদি শেখানো হতো, তবে কি সরল বিশ্বাসেরা ভেঙ্গে যাবার কষ্ট পেত! জীবনের সব রকম সম্পর্কের ভেতর যে ভাঙন, যে খাঁদ, তা একদিন নজরে এলো। আমি জানি না, কী করব। একটা শিশিতে রোজ ঘুমের ঔষধ সঞ্চয় করতে থাকি। রোজ ছুঁয়ে আশ্বস্ত হই, পথ তো আছেই। চাইলেই ঘুমিয়ে যেতে পারি এই অজীবনের বেহিসেবি ভার বহন করা ছেড়ে দিয়ে।

এমন করে সাত মাস কেটে গেল। আমি বাসা খুঁজতে লাগলাম। আমার কাঁধের ব্যাগে তখন চাচীর দেয়া সেই ছোট কাগজে লেখা আমার পথের ঠিকানা দুমড়ে মুচড়ে আছে। একদিন ব্যাগের ভেতর হাতরে হাতরে কাগজটা এসে হাতে পড়ল। আমি সেই চাচীর সাথে দেখা করলাম, কেমন যেন নির্দ্বিধায় সব খুলে বললাম। চাচা আর মিলিবুবুও ছিলেন। আমার সব কথা শুনে মিলিবুবু নিজে আমার সাথে সেদিন বাড়িতে এসে আমার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে আমায় এখানে নিয়ে আসলেন। কথা হলো, আমি দক্ষিণ দিকের এক চিলতে বারান্দা লাগোয়া ওই ছোট রুমে থাকব আর প্রতিমাসে একটা খরচ দেব, তারা বললেন, তা হবে, তবে খেতে হবে একসাথে। আমরা তিনজন ছিলাম, তুমি এলে পরিবারে একজন নতুন কেউ এলো। সেই থেকে এখানে আছি। আর ওই বাড়িতে প্রতিমাসে খরচ পাঠিয়ে দিই। ওদের তো ওটাই প্রয়োজন, আমাকে নয়। এইসব কথা ভাবতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতেও পারব না। মিলিবুবু এসে ডাক দিলেন, দুপুরের খাবার খেতে। আমি কিছু খেতে পারলাম না। সবরকম অনুভূতি, বোধ, কথা শূন্য হয়ে পড়েছে। বুঝতে পারলাম পথ হারিয়ে ফেলেছি। কী করব, আলমারি খুলে লুকানো ঔষধের শিশিটা বের করে নেব নাকি আমার সেই পথে যাব, যে পথ হারালেই রিক্সায় চরে ঘুরে বেড়াই শহরের পথে পথে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে।

আমি বের হই বাসা থেকে। শহরে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল আর সোনালু মিলে শহরের পথে পথে যেন ফুলের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। চারুকলায় যাই। মেঘের আঁধার যে শহরে নেমে আসে, সে শহরের সব কিছুই বড় অন্যরকম লাগে। দেখি একটা মেয়ে, মনে হলো অনার্সের ফার্স্ট ইয়ারেই পড়ছে, বকুল তলায় এসে বসে কিছুক্ষণ, আবার কিছু বকুল কুঁড়ায়, কাঁঠাল চাপা কুঁড়ায়। আমি ওখানে হেটে বেড়াই, চুপচাপ পৃথিবীতে। বাতাসে শিরশির করে ওঠে গাছের পাতা। আর কোনো শব্দ নেই পৃথিবীতে। আমি বুক ভরে শ্বাস নেই। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকাই। সেখানে কিচ্ছু নেই যা কিছু সব তার নিচে, এই মাটির ওপরে। মাটির উপর যত হানাহানি, কুরুক্ষেত্র, মহাভারত আর সাতকাহন, আকাশে তার কিছু নেই। অথচ আকাশ অসীম, এই পৃথিবী নয়। হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির ক্যান্টিনের ভেতর এক কাপ চা নিয়ে বসি। কিছুক্ষণ পর দেখি, সেই ফুল কুড়ানো মেয়েটাও এসে বসেছে। সে তার ফুলগুলো সাজায় আপনমনে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমি বইয়ের দোকানে যাই। আমি জানি, এখানে এলেই হারানো পথ আবার খুঁজে পাই। নতুন বইয়ের পাতায় চোখ রাখি, নতুন কোনো শব্দ, নতুন কোনো কথার সাথে পরিচয় হয়। এক একটা নতুন শব্দ পড়ি, আমার বুকের ভেতর যেন সুবাতাস বয়ে যায়। শব্দগুলো কি অক্সিজেনের কাজ করে? আমি যেন আবার বেঁচে উঠতে থাকি, তবে কি আমি মাটির দিকে এলিয়ে পড়ছিলাম? আমার স্নায়ু যেন আবার কাজ করছে। শক্তি পাচ্ছে কথা বলার। আমি আরো বই দেখি, পড়ি। এর মধ্যে থেকে কয়েকটা বই কিনে নিয়ে আবার রিক্সায় উঠি।

মনে করো যেন আমি সেই মেঘ, যে একদিন হঠাৎ দলছুট হয়ে আকাশে ভেসে হারিয়ে যায়। মনে করো যেন আমি আকাশের সেই লুকিয়ে থাকা কোনো এক নক্ষত্র, পৃথিবীর আলোয় যা ঢাকা পড়ে যায়, অথচ সে ছিল। মনে করো যেন আমি অনেক মানুষের ভিড়ে থাকা একাকী কেউ, যার ভেতর নিঃসঙ্গতা নেই। হঠাৎ মনে হতে থাকে, আমি সৃষ্টির শুরু হতে চিৎকার করে চলেছি, বলছি, তোমরা থামো। অথবা আমাকে মুক্তি দাও। পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চারিদিকে জীবনের যত উত্থান পতন, যত রকম মানুষ সব যেন একইরকম স্থানভেদে, সময়ভেদে। সব জীবন শেষে একইরকম, সব মানুষও।   আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমি কোন এক মেহজাবিন হয়ে যাই, বলি আমাকে নিয়ে যাও বাবা। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। আমি কোন এক লুসি হয়ে যাই, যার ভেতর জীবনের সব অনুভূতি মরে গ্যাছে। যে খালি পায়ে শহরের পথে পথে হেটে বেড়ায় যেদিকে দু চোখ যায় যখন আর কিছুই তার ভালো লাগে না। অথবা রাতের আকাশের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি কোন এক পিতার সন্তান হয়ে যাই, যার বাবাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয় একজন, যার জীবন আমার বাবা রক্ষা করেছিল। আমি কি এই সবশেষ স্তরের মানুষ, যে নিজেও জানতে পারে না, সে খেলছে। তাকে নিয়ে উপরে বসে খেলাচ্ছে অন্য কেউ! আমি কি সেই যে জীবনের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে জীবনকে দেখছি এখন... দেখছি, কেমন করে কেউ খেলার ছক কাটে সবার উপরে বসে, কেমন করে কেউ সেই খেলার আয়োজন করে আর বাকি সব খেলতে বাধ্য হয়। খেলোয়াড়েরা নিজেদের ভেতর হানাহানি করে মরে, সেই মৃত্যুর কারণ নিয়ে কেউ চিৎকার করে, যে চিৎকার উপরের স্তরে পৌঁছায় না কোনোদিনই। সমাজে একটা চোর ধরা পড়লে তাকে কিছু মানুষ মেরে সুখ পায়, কেউ কেন সে চোর হলো, তার পেছনে ছোটে আর যারা চোরটাকে মেরে ফেলল, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। অনেকেই আবার এই মানুষটার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করে ওঠে। আর এক শ্রেণীর মানুষ সমাজের এসব কারণ খুঁজে বেড়ায়, পণ্ডিত হয়। তাঁর লেখা বড় বড় জ্ঞানের কথা শিখে আমরা শিক্ষিত হই। তার উপরে বসে থাকা আরো এক শ্রেণীর মানুষ, যারা এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এইভাবেই কি চলে আসছে না পৃথিবী সেই শুরু থেকে। ইতিহাস কী বলে? আজ আমি তবে খেলে যাচ্ছি নাকি সেই নষ্ট জীবনের ভেতর হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছি! আমি কি সেই ঘুমের ওষুধগুলো হাতে তুলে নেব শেষবারের মতো খেলতে? শেষ বারের মতো বিকেলের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে নেব? নাকি নতুন বইয়ের নতুন একটা শব্দে আবার বেঁচে উঠব? আমি আকাশের দিকে তাকাই। কিছু নেই সেখানে। কত প্রশান্তি। কখনো ধূসর মেঘ, কখনো নির্মেঘ নীল আকাশ। আমি বিড়বিড় করি, ‘নট টুডে’, ‘নট টুডে’, ‘নট টুডে’...  রিকশাচালক চাচা আমার দিকে ফিরে বলে, “কিছু বললেন মা?” আমি বলি, “নাহ চাচা। আপনি রিক্সা চালান। ” মাঝপথে নেমে তিনি একটা পান কিনে নেন। আমি বলি, “আমাকেও একটা পান দিন তো চাচা। পান মুখে দিয়ে শেষ বিকেলের মেঘ দেখতে দেখতে আর হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমার ঘরে ফিরি, সেই এক চিলতে বারান্দার কাছে, বুকের কাছে ধরে রাখা নতুন বইয়ে শব্দের ভেতর জীবনের নতুন পথের কাছে। নিভৃতভাবে বেঁচে থাকা মাটির মানুষগুলোর কাছে। আমি কি তবে পথ হারিয়েছিলাম নতুন পথ খুঁজে পেতে?



বাংলাদেশ সময়: ১৯১৪ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।