ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একজন ভ্যাম্পায়ার | জাহিদুল ইসলাম

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
একজন ভ্যাম্পায়ার | জাহিদুল ইসলাম

আব্দুল হক সাহেব একজন সাদাসিধে সুখি মানুষ। বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন সরকারি চাকুরে।

প্রায় সাত-আট বছর হলো রিটায়ার্ড করেছেন। রিটায়ার্ডের সময় হাউজ বিল, পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বাড়তি ছুটির টাকা সব মিলিয়ে একসঙ্গে বেশকিছু টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছেন। মাসে যা ইন্টারেস্ট পান সে টাকা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়। বয়স এখন ষাটোর্ধ্ব, অথচ স্বাস্থ্য ভালো, কোনো রোগবালাই নেই। পাঁচটা মেয়েকেই ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছেন। দুজন প্রবাসী। বাকি দুজনের মধ্যে একজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা প্রফেসরের কাছে এবং অন্যজনকে চট্টগ্রাম বন্দরের সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। স্ত্রী গত হয়েছে দু-তিন বছর হলো। আব্দুল হক সাহেব একা থাকেন। তাই, নিরিবিলি দেখে পুরনো একটা বাড়ি কিনেছেন। গত কয়েকবছর একা থেকে মানিয়ে নিয়েছেন চারপাশের পরিবেশের সাথে। দিনেরবেলাটা শরৎচন্দ্রের বই পড়েই কাটিয়ে দেন। দুপুরে নিরিবিলি দেখে আশেপাশের হোটেলে বসে খেয়ে নেন। কোলাহল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্ট করেন। রাতে কিছু খান না। কোনোদিন একটা আপেল কিংবা কোনোদিন এক কাপ গ্রিন টি খেয়ে শুয়ে পড়েন। এক ঘুমে এর পরদিন ফজরের আযান পর্যন্ত।

আষাঢ়-শ্রাবণের এক মাস। বেলা প্রায় দশটা-এগারোটা। আব্দুল হক সাহেব বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রর লাইব্রেরি দেখে ঢুকে পড়লেন। লাইব্রেরির ভেতরটা একদম ফাঁকা। মনে মনে আক্ষেপে বললেন, এখনকার আধুনিক যুগে বইপড়া একদমই ছেড়ে দিয়েছে যুবসমাজ। একদিকে হক সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন। বই পড়াটা প্রধান না, নিরিবিলি থাকাটাই প্রধান তাঁর কাছে। লাইব্রেরিয়ানরা হয়ত বা দুপুরের খাবার খেতে গেছে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটা হাতে নিয়ে হক সাহেব নিরিবিলিতে একটু পড়তে বসেছেন। তখন, লাইব্রেরিতে আরেকজন ভদ্রলোক ঢুকলেন।



রোদে বৃষ্টিতে সাইনবোর্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু মুচকি হেঁসে ফার্মেসির দিকে হাঁটতে থাকলেন। প্যারাসিটামল না হলে আজ চলছে না। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো পিছু পিছু কেউ আসছে। পকেট থেকে ক্যাপস্টন সিগারেটের প্যাকেটা বের করে একটা সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ধরালেন। অদ্ভুত মাদকতাময় স্বাদ।
“দেয়াশলাই হবে!”
কিছুটা চমকে উঠলেন আব্দুল হক সাহেব। পাশেই ক্যাথলিক চার্চ তাই এদিক দিয়ে নিতান্ত বেশি প্রয়োজন না হলে এ সময়ে কেউ আসে না।



অচেনা ভদ্রলোকের দৈহিক অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি প্রচুর কথা বলবেন।
‘একটা দেয়াশলাই হবে?’
কথা না বাড়িয়ে হক সাহেব দেয়াশলাইটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দিলেন।
‘আশাকরি সিগারেটের ধোঁয়ায় আপনার অসুবিধে হচ্ছে না। ’
‘জ্বি, না। ’
‘ধন্যবাদ,আপনি কি সিগারেট খাবেন?’
আব্দুল হক সাহেব বিরক্তস্বরে আঙ্গুল দিয়ে ‘লাইব্রেরির ভেতরে ধূমপান করা নিষেধ’ সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে দিলেন। লোকটা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। এহেন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আব্দুল হক সাহেবও মন খারাপ করে বেরিয়ে এলেন লাইব্রেরি থেকে।

বিকেল হয়ে গেছে। পাখিরা যার যার মতো নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে রুগ্ন এক ব্যক্তিকে কিছু বড়বড় আকারের রূপচাঁদা মাছ বিক্রি করতে দেখলেন। সদাই কিনতে এসে কখনোই দরদাম করেননি হক সাহেব। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় পরশি শওকত সাহেবের সাথে দেখা হলো। শওকত সাহেবের হাতে লাল কাগজে মোড়া প্রশস্ত চারকোণা একটা সন্দেহজনক জিনিস। বক্সের ভিতর কী আছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র নন হক সাহেব। তবে, এই লোকটার সমস্যা হলো, একটা কথা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বারবার বলেন।
‘আসসালামু আলাইকুম। ’
‘ওয়ালাইকুমুস-সালাম, কোথাও যাচ্ছেন?’
‘না, এমনি। চলেন চা খাই। ’
“না, অন্যদিন। ”

বাসায় ঢুকে মাছটা রান্নাঘরে রেখে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। চশমাটা পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন। কাজের বুয়া তাকে নাশতা দিয়ে গেল। একটা পিরিচে কয়েক টুকরো আপেল, মালাই চা আর পাঁচ-ছয়টা বাটার টোস্ট। আপেলগুলো খেতে কেমন যেন তিতকুটে লাগছিল। বিস্কুটগুলো মিইয়ে গেছে। দাঁতের চাপে রবারের মতো চেপ্টে যাচ্ছে। মাথাটা একটু ধরেছে।

আব্দুল হক সাহেব প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খোঁজে শোবার ঘরে ঢুকলেন। কিছুই পাওয়া গেল না। বাইরে
পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শোনা গেল। বাইরে থেকে পড়শিদের ফুল বাগানের মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগল। কাজের বুয়াটা রান্নাঘর থেকে বলে উঠল,
“ভাইজান!”
“জ্বি, বল। ”
“শইলডা ভালো ঠেকতেছে না। ”
“কী করতে চাও?”
“কাইল রাইন্ধা দিয়া যামু। ”
“আচ্ছা, তাহলে বাসায় চলে যাও। ”

কাজের বুয়া চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আব্দুল হক সাহেবও ঘরে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘর থেকে উঠোনে দাঁড়াতেই ছাতিম গাছে ঝুলন্ত সাইনবোর্ডটার দিকে চোখ পড়ল,
‘চিশতীরহমান ফকির
জ্বিনসাধক, পরীসাধক
তাবিজ, যাদু-টোনা, বাটি চালান
তেল পড়া, চুন পড়া, বান মারা
(বিফলে মূল্য ফেরত)’
রোদে বৃষ্টিতে সাইনবোর্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু মুচকি হেঁসে ফার্মেসির দিকে হাঁটতে থাকলেন। প্যারাসিটামল না হলে আজ চলছে না। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো পিছু পিছু কেউ আসছে। পকেট থেকে ক্যাপস্টন সিগারেটের প্যাকেটা বের করে একটা সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ধরালেন। অদ্ভুত মাদকতাময় স্বাদ।
“দেয়াশলাই হবে!”
কিছুটা চমকে উঠলেন আব্দুল হক সাহেব। পাশেই ক্যাথলিক চার্চ তাই এদিক দিয়ে নিতান্ত বেশি প্রয়োজন না হলে এ সময়ে কেউ আসে না। কিন্তু, আব্দুল হক সাহেব চমকে উঠলেন সকালের লাইব্রেরিতে দেখা লোকটার মতন দৈহিক আকার-আকৃতি-অঙ্গভঙ্গি দেখে। এবারও হক সাহেব কথা না বাড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেয়াশলাইটা এগিয়ে দিলেন।
“আপনি আমার সাথে কথা বলতে মনে হচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছেন। আমার পরিচয় পেলে মনে হয় আপনি আর বিরক্ত হবেন না। আমি একজন ভ্যাম্পায়ার। ”
আব্দুল হক সাহেব এবার লোকটার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। তাকিয়ে মনে মনে বললেন, দিনে দিনে
ভ্যাম্পায়ারদের অস্তিত্বও শেষকালে বিপর্যয়ের মুখে।
“কী, বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না। আপনার চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না। ”
আব্দুল হক আনমনে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন।
“আপনি ভ্যাম্পায়ার ভালো তো। অসুবিধা কোথায়?”
“ট্রান্সেলভেনিয়ার বিখ্যাত কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প পড়েননি?”
হাস্যোজ্জ্বলভাবে হক সাহেব প্রশ্ন করলেন, “ড্রাকুলারা তো রোদ লাগলে মারা যায়?”
“হা হা হা, মিডিয়াগুলোর এমনই ধারণা। আসলে তেমন কিছু না। ”
“তো থাকেন কোথায়, কফিনে?”
এবার আব্দুল হক সাহেবের এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথায় কিঞ্চিৎ ব্যথিত হতে দেখা গেল লোকটাকে।
“আপনি কি কখনো ভ্যাম্পায়ার দেখেছেন?”
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে, আব্দুল হক সাহেব চুপসে গেলেন। তার তাচ্ছিল্যপূর্ণ চেহেরাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি কোনো নতুন তথ্য জানার কৌতূহলী মনোভাব নিয়ে আছেন। অচেনা লোকটা এবার ধীরে ধীরে বলা শুরু করল। আব্দুল হক সাহেব এবার আর বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন না।

সময়টা আজ থেকে অনেক বছর আগের। আমরাও সাধারণ মানুষ ছিলাম। আমার বাবা-মা আর আমি। খুব সুন্দর একটা ছোট্ট পরিবার। ঐ সময়টাতে সভ্যতা এতটা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল না, এখন চারপাশ যতটা উন্নত। আমরা ছিলাম ভেনিজুয়েলান আমাজানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ইন্ডিয়ান শ্যামেইন উপজাতির ধ্বংসাবশেষ। আমাদের জীবন-ব্যবস্থা এখনকার মতো এতটা উন্নত ছিল না। আমরা বরাবরই মাটির নিচে ঘর তৈরি করে থাকতাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা লোকালয় পছন্দ করতেন না। এটা অনেকটা ট্যাবুর মতো হয়ে গিয়েছিল আমাদের শ্যামেইনদের মধ্যে। তাই, আমাদের জীবনকালও ওভাবেই কেটে গিয়েছে। জঙ্গলের বিশাল বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস, বোয়া কিংবা শেরমান-ট্রি’র গুঁড়ির নিচে ঘর বানাতাম। আমাদের জীবন-ব্যবস্থাও অদ্ভুত ছিল। আমাদের জনগোষ্ঠী ভ্যাটিক্যান সিটির এক বুড়ো পাদ্রীর কথা খুব মানত। তখনকার সময় ইউরোপে বিপ্লব চলছিল। চারপাশে জনগণের হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ আর ইউরোপিয়ান সৈনিকদের বিদ্রোহ চলছিল।

আব্দুল হক সাহেব এবার রীতিমত খেঁকিয়ে উঠলেন। “ভ্যাম্পায়ারদের সাথে এদের সম্পর্ক কী?”
“আছে, আছে। পুরোটা শুনুন। ”
“সেটা তো দেখা যাচ্ছে, আমার সময় নেই। আমি চলি...”
“আহ! শুনুন না..”



আব্দুল হক সাহেব অস্ফুটস্বরে বললেন, “হঠাৎ অচেনা একটা লোক আপনাদের সাথে থাকছে অথচ আপনারা তার পরিচয় জানতে চাইছেন না, অদ্ভুত!”
“লোকটা ছিল একজন গবেষক। ”
“কী নিয়ে গবেষণা করত, ট্রাইব নিয়ে?”
“জ্বি না। মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে!”
“তাই বুঝি?”



আমাদের জনগোষ্ঠীতে হঠাৎ একজন অচেনা লোকের আগমন ঘটল। লোকটা রীতিমত অস্বাভাবিক এবং
ভয়ংকর চেহেরার। কিন্তু, লোকটাকে দেখে আমাদের সকলের মাঝে কোনো এক অজানা কারণে কেমন যেন মায়া হয়েছিল। লোকটা নিজে নিজেই অনেক দুঃসাহসিক কাজ সমাধা করত। কিন্তু, লোকটার বদঅভ্যেস ছিল, সে রাত্রে হাঁটাহাটি করত। দিন কয়েক যেতেই আমরা উপলব্ধি করলাম, লোকটা সাধারণ কোনো মানুষ নয়। লোকটা পেশায় একজন ফিজিশিয়ান ছিল। আমাদের অনেকের বিভিন্ন শারীরিক অসুখ যা নিরাময়যোগ্য ছিল না, লোকটা খুব সহজেই সেসব রোগের নিরাময় ঘটিয়ে দিত। একটা সময় আমরা তাকে বিশ্বাস করতে থাকি। আমাদের একজন বলেই তাঁকে মেনে নিই।

আব্দুল হক সাহেব অস্ফুটস্বরে বললেন, “হঠাৎ অচেনা একটা লোক আপনাদের সাথে থাকছে অথচ আপনারা তার পরিচয় জানতে চাইছেন না, অদ্ভুত!”
“লোকটা ছিল একজন গবেষক। ”
“কী নিয়ে গবেষণা করত, ট্রাইব নিয়ে?”
“জ্বি না। মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে!”
“তাই বুঝি?”

একদিন নিশুতি রাতে লোকটাকে পাশের কবর থেকে উঠে আসতে দেখে আমাদের পাদ্রী। মুখে হলদে চর্বি। এছাড়াও, অন্য আরেকদিন ঘুমন্ত মানুষের শরীর থেকে রক্ত চুষে খাওয়া দেখে ফেলেন পাদ্রীসাহেব। লোকটা ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিত কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে থাকে ধীরে ধীরে। একসময় লোকটা আমাদের সকলকে তাঁর বশে এনে ফেলে। লোকটা আমাদের বেশিরভাগ সাধারণদের দিয়েই রক্তচোষা বাদুড় সংগ্রহ করাত। রক্তচোষা বাদুড় খুব দুষ্প্রাপ্য প্রাণী। সহজে ওদের দেখতে পাওয়া যায় না। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার চ্যাগ্রোস উপত্যকায় আছে। এরা থাকে এক পাহাড়ি গুহাতে। খুব দুর্গম অঞ্চল। সহজে সেখানে যাওয়া যায় না। জায়গাটা পানামাতে। ঐ উপত্যকার আশেপাশের এলাকা জনমানবশূন্য। আমরা পরে জানলাম, লোকটার প্রাচীন বাসস্থানের কথা। সে পানামার অধিবাসী।

লোকটা একসময় ধীরে ধীরে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিল। কেমন জবুথবু হয়ে বসে থাকত। দিনের বেলায়
কম বের হতো। রক্ত চেটে খাওয়াটা একসময় তার কাছে নেশা-পেশা দু’-ই হয়েই দাঁড়ায়। শ্যামেইনের পুরো জনগোষ্ঠী দলবদ্ধ হয়ে একসময় লোকটাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে। ফল সুবিধাজনক হয় না। লোকটা সবার ঘাড়ের কাছে দাঁত ঢুকিয়ে রক্ত পান করতে থাকে। আমাদের বেশিরভাগ সঙ্গীই মারা যায়। এ ঘটনার পর, পাদ্রী একদিন অভিযান চালান মাটির তলার সব মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য। অভিযানে একমাত্র নেতৃত্ব দেয় পাদ্রীসাহেব নিজেই। আমিসহ দশ-বারোজনকে নিয়ে পালিয়ে যায় পাদ্রীসাহেব। পথিমধ্যেই, রোগ-শোকে অর্ধেকের বেশিই মারা যায়। আমি চুপিসারে লোকালয়ে ঢুকে পড়ি। আমি উলঙ্গ ছিলাম আর গায়ে প্রচুর দুর্গন্ধ ছিল। তাই, বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটু গোসলের জন্য অনুরোধ করলাম, মানুষ আমাকে পাগল ভাবল। দীর্ঘদিন গোসল করিনি। শরীরের ভেতরগত আকৃতি অনুভব করলাম কেমন যেন অচেনা লোকটার রক্তচোষা বাদুড়গুলোর মতো হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবার কাজ চাইলাম। আধুনিক স্থাপত্যের এক বাড়িতে গিয়ে একইভাবে দাবি তুললে বাড়ির মালিক জনসন আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। প্রচণ্ড মারও দিতে থাকেন। অবশ্য মার খাওয়ার প্রধানতম কারণ মালিকের স্ত্রী ক্যাথেরিনের সাথে জনসনের সেদিন ভালো কাটেনি। আমার মধ্যে হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকল। মনে পড়ল, এই ক্যাথেরিনের সাথে অতীতে আমার কোনো একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এর ফলে যা হয় তা হলো জনসন আর ক্যাথেরিনের মাঝে একধরনের ভুল বোঝাবোঝি তৈরি হয়। একসময় ক্যাথেরিন জনসনকে না জানিয়েই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে জায়গা দিয়ে দেয় তার বাড়িতে। সুস্থ হয়ে উঠলে চলে যেতে বলে। কিন্তু যখন আমি চলে যেতে চাই তখন ক্যাথেরিনই আমাকে আটকায়, অন্য কোনোভাবে আমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করে এই বাড়িতে।

একদিকে আমার কোনো ঠিকানা ছিল না। তাই, অজানা কারণেই বাড়িটিতে ঠিকানা গেড়ে বসে পড়লাম। জনসন অবশ্য কিছুই জানত না। বেশকিছুদিন পরে, হঠাৎ বাড়ির পেছনের দিকটায় আমার সেই মাটির নিচের একজনের সাথে পরিচয় হলো। দিনের বেলায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাত্রে তাঁকে আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করলাম। দুজনে ভাবলাম এ বাড়িতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে কোনো একটা বুদ্ধি নিশ্চয়ই আঁটতে হবে। যার ফলশ্রুতিতে আমি আর আমার বন্ধুর সহায়তায় বাড়ির বৃদ্ধ গার্ডেনার আর তার স্ত্রীকে মেরে একটা জলায় ফেলে দিই। একজন গার্ডেনার হিসেবেই আমি ঐ বাড়িতে ঢুকি, সম্পূর্ণ অন্য এক লেবাসে। গার্ডেনারকে অবশ্য আমরা কামড়ে মারিনি। বাড়ির প্রাক্তন গার্ডেনার ও তার স্ত্রীর মাথায় সিমেন্টের পুর দিয়ে জলায় ফেলে দেয়া হয়। এতে করে, তারা পানিতে ডুবেই মারা যায়। রক্তের নেশা পরে একসময় আমার আর আমার বন্ধুর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। লোকালয়ের ক্লাবগুলোতে আমাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। নারীদের কোমলমতি দেহগুলোতে আমাদের কামনা উপচে পড়ে। বিভিন্ন রক্তের নেশায় আমরা ব্যাকুল হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে চারপাশে ঘুরতে থাকি। আমাদের দলটা ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে। নতুন লেবাসে আমাকে চিনতে পারেনি জনসন আর না চেনার ফলেই পুরো বাগানটা নতুন করে সংস্কারের কাজ দেয়। নিজ থেকেই জনসন আমাকে থাকার জায়গা দেয় এবার তার নিজের বাড়ির প্রধান রুমগুলোতে। দলভারী হওয়ার কারণে একদিন আমি জনসনকে অনুরোধ জানাই বাগান করতে আরো লোক প্রয়োজন। জনসন মত দিলে আমি মাটির তলায় থাকা বন্ধু ও ক্লাবের কিছু স্ট্রিপ ডান্সারদের নিয়ে আসি বাগানের কাজ সমাধা করতে। এর মাঝে একটা ঘটনা চলতে থাকে। প্রতিরাতে ক্যাথেরিন যখন ঘুমের মধ্যে থাকে আমি নীরবে এসে ক্যাথেরিনের শরীরের ওপর বসে থাকি। সারারাত ধরে ক্যাথেরিনের সাথে যৌনসঙ্গম করতে থাকি কিন্তু ক্যাথেরিন তখন গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে থাকত। আমি ভোরসকালে বিছানার ওপর থেকে চলে এলে ঘুম ভাঙত ক্যাথেরিনের।

প্রতি রাতেই এমনটা হতো। আর প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম ভাঙার পর জনসনের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে ক্যাথেরিন। কারণ ক্যাথেরিন স্বপ্নে দেখে জনসন তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ তেমন কিছুই ঘটত না। জনসন একসময় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যায় তার জীবন নিয়ে, যে জীবন কিছুদিন আগেও ছিল নির্ভেজাল আর আনন্দের। পাশাপাশি জনসন-ক্যাথেরিনের বাচ্চা আর তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা নাতাশাও আমার আর আমাদের বন্ধুদের মায়াজালে আটকা পড়ে। যেন রূপকথার ডাইনীদের মতো জাদু করা হয় ওদের। এক রাতে জনসনের পানীয়তে বিষ মিশিয়ে দেয় ক্যাথেরিন। আমাদের প্ল্যান যেন বাস্তবে রূপ নেয়। ক্যাথেরিনও বাদ যায় না মৃত্যুর হাত থেকে। আমি আর আমার সাথের বন্ধুরা মিলে পরদিনই বাড়ির বাচ্চা ও নাতাশাকে নিয়ে বের হয়ে যাই আবার আমাদের জঙ্গলের পথে। ভেবেছিলাম লোকালয়ে থাকব কিন্তু ইচ্ছে করছিল না। এত কোলাহোলে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। অচেনা লোকটাকে আর কোথাও পাওয়া গেল না। আমার আর নাতাশার সংসার ভালোই কাটছিল। হঠাৎ একদিন জঙ্গলে কিছু মানুষ দেখা গেল। আমাদের মাটির ঘরগুলোর ভিতরে আগুন দিয়ে তারা পুড়িয়ে দিল সবকিছু। এরপর থেকেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দেশ-বিদেশে ঘুরছি।

হাঁফছেড়ে উঠলেন আব্দুল হক সাহেব। চোখে তার আতঙ্ক।
“আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
“না। আপনি আবার কোন সময় আমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খাবেন কে জানে!”
“আমরা আর এখন সেভাবে রক্ত খাই না। ব্ল্যাড ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণের পছন্দের রক্ত কিনে নিয়ে
আসি। চলে যায় মাসখানেক। ”
“শুনে শান্তি পেলাম। ”
“আমার এ-পজেটিভ রক্ত খুব ভালো লাগে। হালকা মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আছে। ”
“ওহ!”
“আপনার রক্তের গ্রুপ কি?”
“জানি না। কখনো পরীক্ষা করাইনি। ”
“পরীক্ষা করিয়ে রাখা ভালো। কখন কী হয় বলা যায় না। ”
“তার মানে কি ভ্যাম্পায়ার আলাদা কোনো প্রাণী নয়?”
“জ্বি, সেটাই। একটা ভাইরাসের কারণেই এমনটা হয়েছে। বুঝিয়ে বলছি...”
“ব্যাপারটা বোঝার কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না। ”
লোকটা তবুও অনর্গল বলে চলেছে:

ভাইরাসগুলো অদ্ভুত ধরনের। এরা মানুষের জীনকে বাদুড়ের মতো করে দেয়। সেই তের শতকের অচেনা লোকটাই রক্তচোষা বাদুড় থেকে প্রথম ভাইরাসটা মানুষের গায়ে নিয়ে এসেছিল। আমাদের যে রক্ত খেতে হয় সেটা ঐ ভাইরাসটার জন্যই খেতে হয়। রক্তটা ওদের জন্যই প্রয়োজন। ভাইরাসটা এক প্রকার সেনসিটিভ। সবসময় একজনের গাঁয়ে থেকে অন্যজনের গায়ে সংক্রমিত করে।



একদিন রাতে পড়শি শওকত সাহেব হন্তদন্ত হয়ে হক সাহেবের রুমে ঢুকলেন। তাঁর হাত ধরে টেনে ওঠালেন। বললেন, “আপনার অতি জরুরী জিনিসগুলো নিয়ে নিন। আপনাকে এক্ষুণি যেতে হবে। ”
হক সাহেব বিস্ময়ভরে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না।
“কোথায় যাব আমি?”
শওকত সাহেব বললেন,
“প্রশ্ন নয়, তাড়াতাড়ি। ”



“তাহলে এখন কেন ভ্যাম্পায়ারদের সংখ্যা বাড়ছে না?”
“মানুষ তুলনায় কম। আমাদের রক্ত প্রয়োজন! ব্লাডব্যাংক রক্ত দিচ্ছে। তাহলে, কী প্রয়োজন মানুষ হত্যা করার!”
“ও, আচ্ছা। ”
“রাস্তায় অনেক সহজাতের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। যেমন আজকে যখন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম তখন আপনাকে কিছু একটা মনে হয়েছিল। ”
আব্দুল হক সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, “আমাকে ভ্যাম্পায়ার ভেবেছিলেন?”
“জ্বি না। অনেকদিন পর দেখে আপনাকে সেই জনসনের মতো মনে হচ্ছিল। ”
“কেন?”
“আপনার দাড়ি-গোঁফ আর মুখের কাটিংটা পুরোপুরি জনসনের মতোই। ”
“হা হা হা। ”

অচেনা লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে এ-পজেটিভ রক্তের একটা ছোটখাটো, সহজেই বহনযোগ্য প্যাকেট বের করে চেটে খেতে লাগল। আব্দুল হক সাহেব হাঁ করে দেখছেন, অচেনা লোকটা রক্ত নামক প্রোটিন মহানন্দে খেয়ে চলেছে।
“আমার তো খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন, আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট নিন!”
“না, সিগারেট এখন খাব না। ”
“পান খাবেন। ঢাকার ঈসা খাঁ হোটেলের পাশ থেকে নিয়ে এসেছি। চমন বাহার দিয়ে, মিষ্টি পান। শুকনো
মুখে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে কিছু চিবুনো ভালো। ”
“না, পান খাব না। ”
“ও, আচ্ছা। ”
“আপনাদের জমাটবাঁধা রক্ত খেতে খারাপ লাগে না?”
“রক্ত থেকে আমি ফাইব্রিন আলাদা করে ফেলি। ”
আব্দুল হক সাহেব এবার মুখ নামিয়ে বললেন,
“ভ্যাম্পায়ারের লক্ষণ কী?”
“লক্ষণ খুব সহজ। ভ্যাম্পায়ারদের রোদে ছায়া পড়ে না। ”
“কেন?”
“কেন সেটা জানি না। ছায়া পড়ে না এইটুকুই জানি। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। ”
হঠাৎ অচেনা লোকটা চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল, “এখান থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ খোঁজেন। ”
আব্দুল হক সাহেব মনে মনে হাস্যোজ্জ্বলভাবে বললেন, ‘তোমাকে ছেড়ে যাওয়া যে সম্ভব না। ’ কিন্তু, মুখে কিছু বললেন না।

এর পর থেকে প্রতি রাতেই হক সাহেবের মনে হতে থাকে, কোনো এক অশুভ শক্তি তাঁকে তাড়া করছে, পরক্ষণেই কেউ আবার তাঁকে রক্ষা করছে। এখন ভালো করে দো’আ পড়ে তারপর ঘুমোতে যান। বাড়িতে একা থাকা যেন তাঁর জন্য অভিশপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন কোনো কিছু খেতে পারছেন না, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছেন। চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে। এমন করেই দিন যাচ্ছে। রাস্তায় বের হলে সবসময় মানুষের ছায়া খুঁজতে থাকে।

একদিন রাতে পড়শি শওকত সাহেব হন্তদন্ত হয়ে হক সাহেবের রুমে ঢুকলেন। তাঁর হাত ধরে টেনে ওঠালেন। বললেন, “আপনার অতি জরুরী জিনিসগুলো নিয়ে নিন। আপনাকে এক্ষুণি যেতে হবে। ”
হক সাহেব বিস্ময়ভরে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না।
“কোথায় যাব আমি?”
শওকত সাহেব বললেন,
“প্রশ্ন নয়, তাড়াতাড়ি। ”
এই বলে তড়িঘড়ি করে হক সাহেবের ব্যাগ গোছাতে লাগলেন। শওকত সাহেব পাগলের মতো হক সাহেবকে টানতে টানতে রীতিমত দৌড়াতে লাগল। মুখ ফসকে হক সাহেব বলে উঠলেন,
“ওরে বাবা, আপনার গাঁয়ে যেন ভ্যাম্পায়ারের শক্তি। আমাকে প্রায় উড়িয়েই নিয়ে চলছেন। ”
অন্ধকারে চার্চের রাস্তার দিকে দুজনে ছুটে চলছেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
অনেক্ষণ পর শওকত সাহেব বলে উঠলেন, “সামনেই রাস্তার পাশে একটা বড় চার্চ আছে, রাতটুকু সেখানে পার করে ভোরের ট্রেনে বাড়িতে ফিরে যাবেন। আর এখানকার ঘটে যাওয়া কোনো কথা কাউকে কোনোদিনও বলবেন না। আব্দুল হক সাহেব চিৎকার করে বললেন,
“আমার বাড়ি ছেড়ে আমি কোথায় যাব!”
শওকত সাহেব ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে যা বললেন তাতে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, তিনি ও তার পরিবারের কেউ মানুষ নন। অনেক বছর আগে উনারা মারা গেছেন। আজকের এই দিনটিতে। তাই এই দিনটিতে উনারা কোনো না কোনো মানুষকে টুকরো টুকরো করে কেটে খেয়ে, নিজেদের জ্বালা কমায়। হক সাহেবকে ওরা অনেক আগেই খেয়ে ফেলত, শওকত সাহেব বাধা দিয়েছেন। বলেছেন, আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে।
“কিন্তু, আজ আমার কোনো কথাই কেউ শুনবে না, আজ সেই অভিশপ্ত দিন। আজ পুরো লাইকেন জনগোষ্ঠী পাগল হয়ে গেছে। আপনাকে শেষ রক্ষা করতেই আমি চেষ্টা করছি। এই বলে, আরো জোরে উড়িয়ে নিয়ে চলল। আর তখনই হক সাহেব শুনতে পেলেন পেছনে জোরে জোরে গাছপালা ভাঙ্গার আওয়াজ। শওকত সাহেব বললেন, “আর বুঝি পারলাম না। ওরা এসে পড়েছে। যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। চার্চটার বাম পাশে একটা ঘর আছে। সেখানে ফাদার থাকেন। তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। আব্দুল হক সাহেব যেন মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারছিলেন না। পেছনের শব্দগুলো বাড়তে লাগল, কোনোমতে রাস্তা পার হয়েই শওকত সাহেব আব্দুল হক সাহেবকে এক মুহূর্ত চেপে ধরলেন। তারপর দূরে ছুড়ে ফেললেন। চিৎকার করে বললেন, “পালান!”
আব্দুল হক সাহেব প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন। হঠাৎ সেই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারটা সামনে দাঁড়িয়ে দাত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলতে থাকল, “সাহায্য লাগবে...?”
“হুম। ”

প্রচণ্ড শব্দে আব্দুল হক সাহেব পেছন ফিরে দেখলেন তিনটা দানব যেন লড়াই করছে। গাছগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। আব্দুল হক সাহেব সব শক্তি দিয়ে ছুটছেন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টায়। ওই তো চার্চ দেখা যাচ্ছে। বাম পাশের ঘরটাও দেখতে পারছেন। শওকত সাহেব আর অচেনা লোকটা লড়াই করে চলছে। এক পর্যায়ে দশ বারোটা লাইকেন মিলে শওকত সাহেব আর অচেনা লোকটার শরীর থেকে দুজনের মাথাটা আলাদা করে ফেলল। আব্দুল হক সাহেব কোনো রকমে ফাদারের দরজায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করেই জ্ঞানশূন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।



আব্দুল হক সাহেব যেন মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারছিলেন না। পেছনের শব্দগুলো বাড়তে লাগল, কোনোমতে রাস্তা পার হয়েই শওকত সাহেব আব্দুল হক সাহেবকে এক মুহূর্ত চেপে ধরলেন। তারপর দূরে ছুড়ে ফেললেন। চিৎকার করে বললেন, “পালান!”
আব্দুল হক সাহেব প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন। হঠাৎ সেই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারটা সামনে দাঁড়িয়ে দাত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলতে থাকল, “সাহায্য লাগবে...?”



হঠাৎ দরজার কলিংবেলের শব্দে আব্দুল হক সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। তাঁর পুরো শরীর ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে। কাজের বুয়া এসেছে। দুপুরবেলা বুয়াকে, কালকের আনা রূপচাঁদা মাছগুলো রান্না করতে বললেন। আব্দুল হক সাহেব সকালের নাস্তা খেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর এক ছেলেবেলার বন্ধু জাবেদ বর্তমানে একজন নামি-দামি সাইক্রাটিস।

চেম্বারে যেতেই জাবেদ সাহেব আব্দুল হক সাহেবকে তো রীতিমত জামাই আদর করা শুরু করে দিলেন। সে তো কত কথা! ছোটবেলার কত স্মৃতি আর তাঁর বর্তমান কাজ-পরিবার নিয়ে কথা বলতে বলতে বিকেলে হয়ে গেল। শেষবিকেলে আব্দুল হক সাহেব, জাবেদ সাহেবকে তার সমস্যার কথা বললেন। জাবেদ সাহেব ভ্রুঁ কুচকে আব্দুল হক সাহেবের দিকে তাকালেন।
“তুই ছিলি আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে সাহসী, আর তুই...?”
“সময় খারাপ যাচ্ছে। দেখছিস তো কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছি। ”
“কী হয়েছে খুলে বল তো!”
আব্দুল হক সাহেব সেদিনের ঘটনাসহ সব খুলে বললেন। এরপর, ধীরে ধীরে সব ঘটনা শুনে জাবেদ সাহেব উত্তর দিলেন, “এসবকিছুই তোর হ্যালুসিনেশন। ”
“হ্যালুসিনেশন, কী বলিস!..”
“সারাদিন একা একা থাকিস তো এজন্যই এ অবস্থা। সারাক্ষণ একা একা থাকার কারণে তোর মাঝে একঘেঁয়ে ভাব চলে এসেছে।
জাবেদ সাহেব এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা তুই ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’ বইটা কবে পড়েছিলি?”
“এইতো এক সপ্তাহ...”
“ঘটনা শুরুর কয়দিন আগে?”
“দুই দিন। ”
“তাহলে তো সব পরিষ্কার। দেখ, তুই যখন কাউন্ট ড্রাকুলা বইটা পড়েছিলি, তখন থেকেই তোর মাঝে ভ্যাম্পায়ার নামক একটা কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল। আর, সেদিন যখন লাইব্রেরিতে তোর কাছ থেকে অচেনা একজন লোক দেয়াশলাই চেয়েছে, তুই তাকে নিঃশব্দে দেয়াশলাইটা দিয়ে দিয়েছিস। অথচ তুই তার চেহারা পর্যন্ত দেখিস নি।
“সমস্যা এখানে কী, বলবি..”
“উত্তেজিত হচ্ছিস কেন, বলছি। ”
“বিকেলবেলা যখন তুই মাছ-হাতে একা একা বাসায় ফিরছিলি তখন তোর সাথে শওকত সাহেবের দেখা হয়?”
“হ্যা, তাতে কী?”

ধীরে ধীরে শোন, রাত্রিবেলা চার্চের সামনে দিয়ে ফার্মেসিতে যাওয়ার সময় তুই নীরব জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলি। ঐ সময়টাতেই তোর মাঝে ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’ ঘটছিল। তুই বুঝতেই পারিস নি। আর রাতের স্বপ্নটা ছিল তোর আতঙ্কগ্রস্ত মনের ফলাফল। কিছুদিন আগে কাউন্ট ড্রাকুলা বই আর তোর এই আতঙ্ক থেকেই এই খারাপ স্বপ্নটা দেখেছিস।

আব্দুল হক সাহেব ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেলেন। বাড়ির গ্রাম্য-প্রবাদটা তার মনে পড়ে গেল, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘেই খায়। ’
“থ্রিলার পড়ার নেশা পারলে একটু কমা!”
“কেন?”
“প্রেমের বই টই পড় একটু!”
“আবার আমার পঁচে যাওয়া ফুসফুসটায় গোলাপ জন্মাতে বলছিস! কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মদ খা, সিগারেট খা পারলে একটু গাঞ্জা খা, তবুও প্রেম করিস না!”
“হা হা হা...”

সেদিনের পর থেকে আব্দুল হক সাহেব সুস্থ আছেন। তিনি এখন আর একাকী থাকেন না। সবার সাথে কথা বলতে বলতে রীতিমত মজমা জমিয়ে ফেলতে পারেন। বইপোকার মতো তাঁকে আর এখন লাইব্রেরিতে দেখা যায় না। রাস্তার টংয়ের দোকানগুলোতে চা-পান আর আড্ডা জমাতেই বেশি দেখা যায়। বই পড়েন তবে সেটা সময়মত। সবকাজ এখন নিজেই করেন, বাসায় কাজের বুয়ার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু সমস্যা হলো আরো ক’দিন পরে। বিকেলে কাজ শেষে বাড়ির উঠোনের সামনের সাইনবোর্ডটা খুলে ফেলতে ছাতিম গাছটায় উঠেছেন।
“দেয়াশলাই হবে?”
হঠাৎ এমন শব্দে আব্দুল হক সাহেব পাশ ফিরে তাকালেন।
পরিষ্কার দেখতে পেলেন গাছের ডালে ঝুলে থাকা কালো বাঁদুড়টা একজোড়া চোখ নিয়ে জ্বলজ্বল করে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।