ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে | আবু রাকিব

স্মরণ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৫
সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে | আবু রাকিব

ঝিনুক নীরবে সহো
৪ আগস্ট ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

মাত্র ২৮ বছরের জীবৎকালে তিনি রচনা করেন অসাধারণ অনেক পঙক্তি। আবুল হাসানের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। তবে তাঁর জন্ম নানার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপড়ার বর্নী গ্রামে। প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া, সাহিত্যক নাম আবুল হাসান। ছিলেন এক ভিন্ন জাতের কবি—আধুনিক বাংলা কবিতায় মাত্র এক দশকের সৃষ্টিতেই হাসান নিঃসঙ্গ চেতনার তরঙ্গ তুলেছিলেন, নৈঃশব্দ্যের এক অনন্য ও মুগ্ধকর বৈচিত্র্য তৈরি করেছিলেন। আবুল হাসানের কবিতায় আমরা পাই দুঃখবোধ, আত্ম-অস্বীকৃতি, একাকিত্বের ভাবনা, স্মৃতিকাতরতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই আবুল হাসান বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কবিতায় তাঁর কল্পিত মানুষগুলো মায়া-মমতা, মৃত্যচিন্তা, বিছিন্নতার ভাবনায় নিমগ্ন থাকতেন। এ সত্যের প্রমাণ মিলবে তাঁর রচিত বিখ্যাত এ পঙক্তিতে—‘ঝিনুক নীরবে সহো;/ ঝিনুক নীরবে সহো,/ ঝিনুক নীরবে সহে যাও;/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও। ’ (ঝিনুক নীরবে সহো,পৃথক পালঙ্ক)



...কবি শাসসুর রাহমান ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন—“একজন খাঁটি কবির জন্ম হলো। এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলোয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন অবলীলায়। যিনি সর্বক্ষণ কবিতার ধ্যানে মগ্ন নন তার পক্ষে অসম্ভব এই কবিতা-আহরণ। ”...



আবুল হাসানের জীবন, সৃষ্টি ও স্বীকৃতি
শৈশব ও কৈশোরে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ থাকায় তাঁর কবিতায় গাছ ও নদীর ঘ্রাণ মিশেছিল। কিন্তু হাসান ছিলেন শেষ পর্যন্ত একজন নাগরিক কবি। ফলে তাঁর কবিতায় গ্রাম আর শহরের অভিজ্ঞতার এক অপরূপ মিশ্রণ দেখা যায়। আবুল হাসানের কবিতায় নিঃসঙ্গতা, দীর্ঘশ্বাস, দৈনন্দিন জীবনের দহন বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু এজন্য তাঁকে একবাক্যে বিষণ্ণতার বা সমাজবিমুখ কবিও বলা যাবে না। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে বহুমাত্রিক সংশয়, উদ্বেগ। বিচিত্র  চিত্রকল্প, উপমা এবং শব্দের ব্যবহার সবকিছুতেই ছিল জীবনেরই জয়গান। শব্দ ব্যবহারে হাসান ছিলেন অতি সচেতন। শব্দকে প্রচলিত অর্থ থেকে মুক্ত করে নতুন অর্থে ঋদ্ধ করা ও নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি করা ছিল তাঁর কবিতার একটি মৌলিক দিক। কবিতার পাণ্ডুলিপির ওপর আঁকাআঁকি করার অভ্যাস ছিল হাসানের। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও হাসান পরিকল্পনা করেছিলেন স্কেচের প্রদশর্নী করবেন। চিত্রকলার পদ্ধতিগত শিক্ষা না থাকলেও তাঁর ছিল অনন্ত কল্পনাশক্তি আর অসাধারণ শিল্পবোধ। ‘আবুল হাসান’ নামের একটি কবিতায় তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন—“সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আদ্র, মায়াবী করুণ; এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই? এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা? (আবুল হাসান; রাজা যায় রাজা আসে)

আবুল হাসান ছিলেন সাহসী, আত্মবিশ্বাসী এবং ব্যতিক্রমধর্মী একজন কবি। প্রথম বই ‘রাজা যায় রাজা আসে’র প্রথম কবিতার নাম ‘আবুল হাসান’ দেখে উপলব্ধি করা যায় নিজের জগতে তিনি কতটুকু স্বতন্ত্র। কী পরিমাণ সাহসী হলে একজন কবি মাত্র ২১ বছর বয়সে ‘সব ভালো কবিতাই আমার কবিতা!’—বাক্যটি উচ্চারণ করে তাঁর চিন্তাচেতনার স্বকীয়তা দেখিয়ে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও আলোড়ন তোলেন। কবি শাসসুর রাহমান ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন—“একজন খাঁটি কবির জন্ম হলো। এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলোয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন অবলীলায়। যিনি সর্বক্ষণ কবিতার ধ্যানে মগ্ন নন তার পক্ষে অসম্ভব এই কবিতা-আহরণ। ”

আবুল হাসান তাঁর কাব্য-দক্ষতায় বয়সের সীমানাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। তরুণ অবস্থাতেই তাঁর কবিতার কাঠামো, শব্দবিন্যাস, প্রকরণ, বিষয় নির্বাচন, স্বর ও প্রতীকের ভিন্নতা এবং বাক্যের অভিনব ব্যঞ্জনা এবং শিল্পের ঋদ্ধতা তাঁকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। হাসানের কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা অত্যন্ত সাবলীল ও জীবনঘনিষ্ঠ। তাঁর কবিতায় এক ধরনের স্নিগ্ধতার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।   ‘সবুজ দিঘির ঘন শিহরণ? হলুদ মাটির বন?’, ‘বোনের মতন লাজুক পাড়া গাঁ’, ‘নয়নের মাঝখান থেকে নেমে আসা এই নিমফল’ কিংবা ‘আর পৃথিবীতে এখনো আমার মাতৃভাষা ক্ষুধা!’ ইত্যাদি  অসাধারণ সব চিত্রকল্প সম্পর্কে অনেক সাহিত্য সমালোচক বলেছেন, এমন উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও নান্দনিক উপস্থাপনা বিশ্বসাহিত্যেও বিরল। তাছাড়া আবুল হাসানের  ‘সাতশো সুন্দর শাদা দুরন্ত ঘোড়া’, ‘ সারারাত হীরক জয়ন্তি নয়, সারারাত শুধু বৃষ্টি হলো!’, ‘ফুল ছিঁড়তেই হয়ে গেলাম মানুষ’, ‘কুমারীর কালো খোঁপা খুললেই কাঁপাও কুসুম’—এসব মুগ্ধ করা কবিতার অনুপ্রাসগুলিও আমাদের বাংলা-সাহিত্যের দুর্লভ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাঁর কবিতার অনুপ্রাসেও ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। আবুল হাসান মাত্র এক দশক কবিতা লেখার আয়ু পান। তা দিয়েই আধুনিক বাংলা কবিতায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও বাংলাদেশের কবিতার আলোচনায় তাকে স্মরণ করা হয়। আজও আবুল হাসানের কবিতার মুগ্ধতা, হাহাকার, আনন্দ-বেদনার প্রতিধ্বনি পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে শোনা যায়।

জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছিল। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ (১৯৭২)-তে হাসান যেন নিসর্গলগ্ন, রোমান্টিক এক মগ্ন প্রেমিক; ‘যে তুমি হরণ করো’ (১৯৭৪)-তে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ক্ষুণ্ণতা আর মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত  আর ‘পৃথক পালংক’(১৯৭৫)-তে আসন্ন মৃত্যুচিন্তা, কিছুটা ব্যথর্তাবোধে আক্রান্ত, অনেকটা স্থির এবং সংহত এক হাসান। হাসানের মৃত্যুর পর তার কাব্য নাট্য ‘ওরা কয়েকজন’ (১৯৮৮), ‘আবুল হাসান গল্প সংগ্রহ’(১৯৯০), এবং ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’ (১৯৯৪) প্রকাশিত হয়। রচনা সমগ্রে তাঁর ১৩০টি অগ্রন্থিত কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার জন্য হাসান মরণোত্তর ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’(১৯৭৫) এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’(১৯৮২) লাভ করেন।

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়
১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে পিজি হাসপাতালের বেডে কবি আবুল হাসান মারা যান। হাসান মাত্র ২৮ বছর ৩ মাস ২০ দিন  ছিলেন এই পৃথিবীতে। একজন কবির জন্য এই বয়স কি খুব বেশি? হাসান তাঁর ‘কালো কৃষকের গান’ কবিতাটি শুরু করেছিলেন এইভাবে—“দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখব না আর আমার ভেতর; সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি”... (কালো কৃষকের গান, যে তুমি হরণ করো)—তাই বুঝি হাসান দুঃখের জমিতে আবাদ করতে বড্ড তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন ভিন্ন গন্তব্যে। কিন্তু কোথায় সেই শুভ্র হাসি? শুভ্র হাসির বদলে হাসান বুনলেন ধূসর বেদনা। হাসান বেঁচে থাকলে হয়ত আরও অনেক কবিতা ও গদ্য  পেতাম। তাঁর অকাল মৃত্যুতে নিশ্চয়ই আমরা সেগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছি। হাসানের কবিতা, বন্ধুত্ব আর প্রেম এ দেশের কবিতা পাঠকদের কাছে মিথের মতো। হাসানের কাছে প্রেম অমোঘ এবং অনতিক্রম্য। মৃত্যুও অপরাজেয়। জন্মদিনে আজ হাসানকে স্মরণ করি তাঁরই কবিতার কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে—“এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া/তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,/তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হব/ কালিমা রাখব না!’ (তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না;  যে তুমি হরণ করো)



বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।