ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইতিহাসের অমরত্বে বঙ্গবন্ধু | আমির হোসেন

শ্রদ্ধাঞ্জলি / জাতীয় শোক দিবস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৫
ইতিহাসের অমরত্বে বঙ্গবন্ধু | আমির হোসেন

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পরে সন্ধ্যায় বিবিসির এক সংবাদ ভাষ্যে মন্তব্য করা হয়েছিল; “বাংলাদেশে যা কিছুই ঘটুক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সেই মানুষটি হিসেবে, যিনি না হলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। ”

পরম সত্যেরই প্রকাশ ঘটেছিল বিবিসির সেই মন্তব্যে। কিন্তু এই সত্যকে অস্বীকার করার, বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার, তার ঘাতকদের রক্ষা করার  নির্লজ্জ চেষ্টার অন্ত ছিল না পঁচাত্তর পরবর্তী শাসকদের তরফ থেকে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি হয়েছে, আজ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধু জাতির জনকের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত, তার আদর্শের ধারাতেই চলছে দেশ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের চল্লিশ বছরের মাথায় এবারের এই জাতীয় শোক দিবসে নিঃসীম বেদনার মধ্যেও এটা এক সান্ত্বনা।



গল্পের আমেজে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার হাতে ছিল একটি ছড়ি। একবার হাতের ছড়িটা উপরে তুলে বললেন,  “অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। এবার এই ডাণ্ডা দিয়েই আমি অন্যায় আর অনাচার ঠাণ্ডা করব। ” কী ভেবে ছড়িটি মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, “অবশ্য ডাণ্ডা আমার মাথায়ও পড়তে পারে। ” সেটা হয়ত কথার কথাই ছিল। আবার এমনও হতে পারে তিনি কোনো সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা থেকেই এ কথা বলেছিলেন।



সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল সৈকতে দাঁড়িয়ে অসীম সমুদ্র দেখার মতো। বঙ্গবন্ধুকে শেষবার দেখেছি ১৯৭৫ সালের ২৬ জুলাই। ডাক্তার তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করতে বলেছিলেন। রুটিন মাফিক সেটা শেষ করে তিনি বসে ছিলেন গণভবনের উন্মুক্ত চত্বরে, খোলা আকাশের নিচে। আশেপাশে উপবিষ্ট ছিলেন দলের কয়েকজন নেতা, নবনিযুক্ত কয়েকজন জেলা গভর্নর।

গল্পের আমেজে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার হাতে ছিল একটি ছড়ি। একবার হাতের ছড়িটা উপরে তুলে বললেন,  “অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। এবার এই ডাণ্ডা দিয়েই আমি অন্যায় আর অনাচার ঠাণ্ডা করব। ” কী ভেবে ছড়িটি মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, “অবশ্য ডাণ্ডা আমার মাথায়ও পড়তে পারে। ” সেটা হয়ত কথার কথাই ছিল। আবার এমনও হতে পারে তিনি কোনো সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা থেকেই এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেটা বুঝবার উপায় ছিল না। মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পর তাকে এভাবে হত্যা করা হবে, এটা তখন কল্পনাও করা যায়নি।

সেদিন নানা প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু। এক ফাঁকে একজন প্রবীণ দলীয় নেতা বললেন, “বঙ্গবন্ধু, আপনার ধানমণ্ডির বাড়িটা তো অরক্ষিত। তবু আপনি গণভবনে না থেকে সেখানে থাকেন কেন?” হাসলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, “ঐ বাড়িতে আমার সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অনেক সংগ্রাম-আন্দোলনের সূতিকাগার ঐ বাড়ি। ঐ বাড়িতে বসে আমি সহকর্মীদের নিয়ে দিনের পর দিন বৈঠক করেছি, আলোচনা করেছি, সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আজো যখনি ঐ বাড়িতে কক্ষে কক্ষে ঘুরি, অতীতের অনেক দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, অনেক কথা আমার মনে পড়ে, আমি অতীতের সাথে নিজের যোগসূত্র খুঁজে পাই। তাই তো ওখানে পড়ে আছি। ”

“তবু বঙ্গবন্ধু ঐ বাড়িতে থাকা আপনার নিরাপদ নয়”—বললেন আরেকজন দলীয় নেতা।

বঙ্গবন্ধু হাসলেন ম্লান হাসি। আবৃত্তি করলেন ধীরে ধীরে; “জীবনেরে কে রাখিতে পারে আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে, তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে। ”

প্রিয় পাইপটা হাতেই ছিল। তামাকে অগ্নিসংযোগ করে মুখে নিলেন। বাতাসে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমি জানি। সাম্রাজ্যবাদী, দেশদ্রোহী আর প্রতিক্রিয়াশীলরা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। কিন্তু তাদের কোনো সুযোগ আমি দেব না। একবার যদি ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেতে পারি, যদি নতুন সিস্টেম চালু করে দিতে পারি, তারপর দেখা যাবে কে কত ষড়যন্ত্র করতে পারে। ”

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার পাইপে টান দিয়ে মুখভর্তি  ধোঁয়া ছেড়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমি যদি মারা যাই তোরা এক কাজ করিস। বাংলার কোনো গ্রামে, ধান ক্ষেতের পাশে কিংবা বাঁশ বাগানে আমার কবর দিস। কবরে শুয়ে যেন বাংলার মাটির স্পর্শ পাই, বাংলার পাখির গান শুনি, আর বাংলার সোনালি ধানের ঘ্রাণ পাই। ”

বঙ্গবন্ধুকে এমন অভিমানী ও আবেগপ্রবণ হয়ে কথা বলতে আগে  কখনো দেখিনি। তবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে একথা তিনি আগেও বলেছেন। ষড়যন্ত্র আর প্রতিকূলতার সঙ্গে পাঞ্জা কষে কষেই তিনি এগিয়ে এসেছেন সামনে। তার নিজের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে, দেশবাসীর বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র হয়েছে। সেসবের মোকাবেলা করেই তিনি নেতা হয়েছেন।

মধ্যবিত্ত ঘরের দুঃসাহসী তরুণ শেখ মুজিব যেদিন বাংলার মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত আর নিঃসহায়দের যুগযন্ত্রণা বুকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে নামেন, সেদিন থেকেই শুরু এক অন্তহীন দুর্গম পথে অভিযাত্রা। তখনও বাংলার রাজনীতি অভিজাত বিত্তবানদের বৈঠকখানায় অলস সময়ের সরস আলোচনার উপকরণ। রাজনীতি তখনও উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, মোক্তারদের রবিবাসরীয় সৌখিন বিলাস। সেই আসরে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা সমঝদার হতে পারতেন, নায়ক হবার উপায় ছিল না।

কিন্তু শেখ মুজিব ছিলেন যুগার্জিত সেই ট্র্যাডিশনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। রাজনীতিকে তিনি গণরাজনীতি হিসেবেই দেখেছেন। নিজেকে একাত্ম করে দিয়েছেন জনগণের সঙ্গে। এই একাত্মতা যত নিবিড় হয়েছে, সামনে বাধা এসেছে কঠিনতর, ষড়যন্ত্র হয়েছে গভীর। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লী থেকে ঢাকায় গণভবনে উঠে আসতে শেখ মুজিবকে শুধুই সংগ্রাম করতে হয়েছে, করতে হয়েছে দুঃসহ দুঃখের তপস্যা। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত চলেছে সেই একই অবস্থা।

রাজনীতিতে তিনটি পথ—ডান, বাম আর মধ্যপন্থা। শাসক, শোষক এবং কায়েমী স্বার্থবাদী ছাড়াও ডান আর বামপন্থিদের বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়তে হয়েছে মধ্যপন্থী শেখ মুজিবকে। পাকিস্তান আমলে প্রতিক্রিয়াশীল, ডানপন্থি, সাম্প্রদায়িক শক্তি, হঠকারী বামপন্থী মহল এবং পাঞ্জাবি শাসক-শোষক চক্রের শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাকে প্রাণপণ লড়তে হয়েছে। সে লড়াইতে জয় হয়েছে তারই। সারা জীবনের সাধনা দিয়ে তিনি ছিনিয়ে এনেছেন তার স্বদেশ, স্বজাতির স্বাধীনতা।

তারপর রণক্লান্ত বঙ্গবন্ধু রূপকথার রাখাল রাজার মতোই বসেছেন ক্ষমতার আসনে। কিন্তু সে শুধু জীবন দেওয়ার জন্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে বিস্তর, রূপ হয়েছে হিংস্রতর। তাতে যোগ দিয়েছে বিদেশি শক্তি। কঙ্গোর লুমুম্বাকে, চিলির আলেন্দেকে হত্যা করে বিশ্বজোড়া ষড়যন্ত্রের করাল হাত ছোবল হেনেছে বঙ্গবন্ধুর বুকের ওপর। ছিনিয়ে নিয়েছে তার জীবন। প্রতি বছর বর্ষার সজল ছায়ায় ঘন হয়ে ১৫ আগস্ট বাঙালির দুয়ারে ফিরে ফিরে আসবে। যুগ যুগ ধরে এই দিনে বাংলার আকাশে জমে উঠবে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। বাতাস শোনাবে স্বজন হারানোর ব্যথিত সংগীত। বৃষ্টির কণায় কণায় ঝরে পড়বে কান্নার বিষণ্ণ মূর্ছনা। কিন্তু আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না শুধু একজন—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার কাজল মাটির উষ্ণ বক্ষের নিবিড় সান্নিধ্যে তিনি চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লীতে। পাখিরা তাকে ঘুমের গান শোনায়, তার কবর ধুয়ে দেয় ভোরের শিশির। আর তার আজন্মের সাধনায় গড়া বাংলাদেশ ভেঙে পড়ে ব্যাকুল কান্নায়; ‘স্মৃতিভারে হেথা আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই। ’



কিন্তু তার এই রাজনৈতিক, জাতীয় এবং প্রশাসনিক পরিচয়ের বাইরে আরো একটি পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি, যিনি হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই জাতিকে সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিলেন, তাদের দিয়েছিলেন আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা। তিনি শুধু এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও কালজয়ী নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি ইনস্টিটিউশন।



চিরদিন কেউ বেঁচে থাকেন না। বঙ্গবন্ধুর কোনোদিন মৃত্যু হবে না এমনটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু এ কোন মৃত্যু? এ কোন বাংলাদেশ? নিজের হাতে গড়া দেশের মাটিতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে একদল ক্ষমতালোভী ঘাতকের হাতে। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তার। চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ মৃত্যুর সান্ত্বনা কোথায়? সারাটি জীবন তিনি নিরলস সংগ্রাম করেছেন এই বাংলার মাটি আর মানুষের মুক্তির জন্য। প্রায় এক যুগ তাকে কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানি কারাগারে। পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শাসন ও শোষণের কবল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দুই যুগ ধরে চলেছে তার সংগ্রাম। তারই নেতৃত্বে ত্রিশ লাখ বাঙালির রক্ত,  দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত এবং গোটা জাতির অন্তহীন ত্যাগ আর অশ্রুর কঠিন মূল্যে ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কিন্তু এই দেশে স্বাধীনতার পরে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। বাঙালি জাতির জন্য সারাজীবন বঙ্গবন্ধু যা করেছেন, এই কি তার পুরস্কার?

বঙ্গবন্ধু আজ আর বেঁচে নেই। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনীতির কোলাহল, সব কিছুর অনেক উর্ধ্বে তিনি। পৃথিবীর এক বিস্ময়কর ইতিহাসের  কালজয়ী স্রষ্টা আজ নিজেই এক বিমূর্ত ইতিহাস। তার বিশালত্ব, তার মহত্ব, তার সাফল্য, তার ব্যর্থতা আজ একান্তভাবেই ইতিহাসের উপকরণ। শাসক বঙ্গবন্ধু কালের ধূলি আবরণে ম্লান হতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। ঘাতকেরা তাকে শক্তিপ্রয়োগে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্থান হয়েছে ইতিহাসের অমরত্বে। তাই ইতিহাসকেও চিরকাল কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হবে; ‘যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। ’

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশই তার সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি। যতদিন বাংলাদেশ আছে, বাঙালি জাতি আছে ততদিন তিনি অমর হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু অবিনশ্বর জীবনের মহিমায় একাকার হয়ে থাকবেন এই দেশ, এই মাটি, এই জাতির মাঝে।

বাংলার মাটি আর বাঙালি মানসিকতায় গড়া বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির জনক।

তবু বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার ছিলেন না, শুধু এশিয়ার ছিলেন না, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমগ্র বিশ্বের। তিনি ছিলেন নিপীড়িত, শৃঙ্খলিত বিশ্ব মানবতার বিবেকের কণ্ঠস্বর। পৃথিবীর দেশে দেশে সংগ্রামী মানুষেরা, মুক্তিপাগল মানুষেরা কথা বলেছেন তার কণ্ঠে। দুনিয়ার সকল বন্দি আত্মার শেকল ভাঙার বজ্রশপথ গর্জে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। তারই কণ্ঠে দানবের রণহুংকারের জবাব দিয়েছে শান্তির শ্বেতকপোত।

শেখ মুজিব ছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।

কিন্তু তার এই রাজনৈতিক, জাতীয় এবং প্রশাসনিক পরিচয়ের বাইরে আরো একটি পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি, যিনি হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই জাতিকে সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিলেন, তাদের দিয়েছিলেন আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা। তিনি শুধু এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও কালজয়ী নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি ইনস্টিটিউশন।



নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে ‘নিউজ উইক’ সাময়িকীর সিনিয়র এডিটর আর্নল্ড ডি ব্রচগ্রেভ সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ‘নিউজ উইকের’ ৮ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় এই সাক্ষাৎকারটির বিবরণ প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বলেন, “কোনো কোনো দেশের অনুরোধেই আমি শেখ মুজিবকে গুলি না করে তার বিচারের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু আমার ধারণা, মুজিব যদি ঢাকায় ফিরে যান, তার লোকেরাই  তাকে হত্যা করবে। ”



বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছেন; “দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান, কেউ ইতিহাসের একটি পঙক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউবা একটি অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু এই সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তার জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখণ্ডকে শুধু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুননির্মাণ করেছেন। এখানেই  তার নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। ”

১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে ‘নিউজ উইক’ সাময়িকীর সিনিয়র এডিটর আর্নল্ড ডি ব্রচগ্রেভ সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ‘নিউজ উইকের’ ৮ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় এই সাক্ষাৎকারটির বিবরণ প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বলেন, “কোনো কোনো দেশের অনুরোধেই আমি শেখ মুজিবকে গুলি না করে তার বিচারের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু আমার ধারণা, মুজিব যদি ঢাকায় ফিরে যান, তার লোকেরাই  তাকে হত্যা করবে। ”

এত বছর ধরে বারবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, কিসের ভিত্তিতে ইয়াহিয়া খানের মনে সেদিন এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল? কেন তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন? তবে কি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যা ঘটেছে তার নীল নকশা সেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানে বসেই তৈরি হয়েছিল? তখনই কি ঠিক করা হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের কাজটা পাকিস্তানের মাটিতে নয়, বাংলাদেশের মাটিতে বসে বাঙালিদের দ্বারাই সমাধা করা হবে?

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, ডেইলি সান

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।